স্বাগত হে মাহে রামাদ্বান

মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-রামাদ্বান তো সেই মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন – মানুষের হিদায়াত স্বরূপ, হিদায়াতের নিদর্শন স্বরূপ এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী রূপে। সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫।
প্রিয় পাঠক, অচিরেই আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে রামাদ্বানুল মুবারক। রামাদ্বান সম্পূর্ণরূপে সমহিমায় উজ্জ্বল একটি নাম।
হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম বায়হাকী তার শুয়াবুল ঈমান গ্রন্থে কা’ব ইবনে আহবার এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা আ. এর নিকট এ মর্মে অহী করেন যে, হে মুসা আমি আমার বান্দাদের উপরে রামাদ্বানের রোজা ফরজ করে দিয়েছি। কিয়ামতের দিন যে ব্যক্তির আমলনামায় ১০টি রামাদ্বান (রামাদ্বান মাসের রোজা) থাকবে, সে আবদাল; যার আমলনামায় ২০টি রামাদ্বান থাকবে, সে মুখবিতীনের (বিনয়ী বান্দাদের) অন্তর্গত; যার আমলনামায় ৩০টি রামাদ্বান থাকবে, সে আমার নিকট শহীদের চেয়েও নিকটবর্তী।
রোজার এরূপ বহুবিধ গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজীলতের কথা আলোকপাত হয়েছে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে। মাত্র একটি হাদীসের আলোকে এখানে কিছু আলোকপাত করা হলো।
বিখ্যত হাদীস গ্রন্থ শুয়াবুল ঈমান এর ৩৩৩৬ নং হাদীসে উল্লেখ- হযরত সালমান ফারসী রা. বর্ণনা করেন- শাবান মাসের শেষ তারিখে হযরত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগত রামাদ্বান উপলক্ষে একটি ভাষণ প্রদান করেন। তাতে তিনি বলেন হে লোকসকল, তোমাদের সামনে একটি মহান মাস এসে হাজির হয়েছে। এটা বরকতের মাস। এতে এমন একটি রাত্র আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসের রোজাকে আল্লাহ তায়ালা ফরজ করে দিয়েছেন। রাতের নামাজকে নফল করে দিয়েছেন অর্থাৎ, তারাবীহ নামাজের ব্যবস্থা করেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্যার্জনে কোন ভাল কাজ বা নফল কাজ করলো- সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ কাজ আদায় করলো। এ মাসে যে একটি ফরজ কাজ করলো- সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করলো। এটা ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। এটা সমতার মাস অর্থাৎ ধনী গরীব কোন পার্থক্য নেই। সবাই উপবাস, ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগে একাকার। মোমেনের রিযিক এ মাসে বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে- তাতে তার গুনাসমূহ মাফ হয়ে যাবে। সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে এবং সে রোজাদার ব্যক্তির সমান সাওয়াব পাবে। তাতে ঐ রোজাদারের সাওয়াবের কোন ঘাটতি হবে না।

একথা শুনে সাহাবীরা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের সকলের তো রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। তখন তিনি বললেন- এ সাওয়াব আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে দিবেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সামান্য একটু দুধ কিংবা এক টুকরো খেজুর অথবা একটু পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে আহার করাবে, তাকে আল্লাহ পাক আমার হাওজ থেকে এমন পানীয় পান করাবেন যে, জান্নাতে প্রবেশের আগ পর্যন্ত সে আর তৃষ্ণার্ত হবে না। এটি এমন মাস যার প্রথমাংশ রহমতের, মাঝের অংশ মাগফিরাতের আর শেষের অংশ নাজাত অর্থাৎ, জাহান্নাম থেকে মুক্তির।
এ রকম অনেক হাদীসে রামাদ্বানের অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। যা আমাদেরকে আগত রামাদ্বানকে স্বাগত জানাতে উৎসাহিত করে। সিয়াম সাধনার জন্য প্রস্তুতি নিতে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। তাই আমাদের সবাইকে নানাবিধ ইবাদাতের মাধ্যমে রামাদ্বানের নিয়ামত অর্জনের জন্য তৈরি থাকতে হবে। রামাদ্বানুল মুবারক কুরআন তিলাওয়াতের মধুময় গুঞ্জনের মাস, কুরআন নাযিলের মাস, আসমানের দরজা খুলে দেয়ার মাস, শয়তানকে বন্দী করে রাখার মাস, বেহেশতের দরজা খুলে দেয়ার মাস, দোযখের মুখ বন্ধ করে রাখার মাস, কবরের আযাব বন্ধের মাস, নেক আমলের মর্যাদা বৃদ্ধির মাস, কিয়ামুল লাইলের মাস, সাহরি ও ইফতারির আনন্দের মাস। এ ছাড়াও মুমিন ভাইকে নিমন্ত্রণ জানানো ও ভেদভেদ ভুলে পরস্পরে ভ্রাতৃত্ববন্ধন প্রতিষ্ঠার মাস মাহে রামাদ্বান।
এ রকম শত সহ¯্র কল্যাণ ও মহান নিয়ামত নিয়ে যে রামাদ্বান আমাদের দিকে রওয়ানা হয়েছে, সে যেন বেহেশতী সওগাত বোঝাই একটি জাহাজ। সে আমাদের বন্দরে পুরো একমাস অবস্থান করবে। তাই বাইরের সকল অন্যায় কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করে আমাদেরকে রামাদ্বানের খাজিনা লুটে নেয়ার প্রস্তুতি ও প্রতিযোগিতায় নামা দরকার। দিলকে নরম করে, ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে মাহে রামাদ্বানের সর্বোচ্চ আদব রক্ষা করা দরকার।
নিজে রোজা রাখা, অন্যকে রোজা রাখতে উৎসাহিত করা, দিনের বেলা হোটেল রেঁস্তোরায় না ঢোকা এবং সেগুলো বন্ধ রাখা। সর্বোপরি যে ব্যক্তির রোজা ভাঙার ওজর রয়েছে- তারও উচিৎ জনসমক্ষে পানাহার এড়িয়ে চলা। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরাম নির্বিঘেœ রামাদ্বানের রোজা পালনের প্রস্তুতি স্বরূপ শাবান মাসেই কিছু রোজা রাখতেন। প্রিয় নবী স. কখনও পুরা শাবান মাসই রোজা পালন করতেন। রজব আল্লাহর মাস আর শাবান মাসকে তিনি নিজের মাস বলে ঘোষণা দিয়ে ৩৫৩২ নং হাদীসে ইরশাদ করেন-শাবান আমার মাস, যে ব্যক্তি শাবান মাসকে মর্যাদা দিবে সে আমার বিষয়কেই মর্যাদা দিবে। আর যে আমার বিষয়কে মর্যাদা দিবে কিয়ামতে স¦য়ং আমিই তার জন্য অগ্রবর্তী গচ্ছিত সম্পদ হয়ে থাকব। সুবহানাল্লাহ। রামাদ্বান মাসের প্রস্তুতির জন্য শাবান মাসের ইবাদাতকে প্রিয় নবী স. কত অধিক গুরুত্ব দিতেন! সুতরাং শাবান মাস থেকেই আমাদের রোজা, নফল নামাজ, তাসবীহ, তাহলীল, তিলাওয়াত ইত্যাদির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া উচিৎ। যেমনটা করতেন সাহাবায়ে কেরাম। আর শাসকগণ এ মাসে কয়েদিদের বিচার শেষ করে ফেলতেন আর না হয় খালাস দিয়ে দিতেন। সকলেই যাতে স্বাচ্ছন্দে সিয়াম সাধনা ও ইবাদাত করতে পারে – সেই ব্যবস্থা করে দিতেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে রামাদ্বানে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট জিইয়ে রাখে। প্রতি বছরই তাদের কবলে জিম্মি হয়ে সাধারণ মানুষ ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সুতরাং আমাদের ব্যবসায়ীদেরও মানুষকে জিম্মি করার পরিবর্তে আল্লাহর কাছে প্রতিদান লাভের আশা করা উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে রোজার প্রস্তুতি গ্রহণ করার মানসিকতা দান করুন।
আগত রামাদ্বানকে প্রফুল্লচিত্তে স্বাগত জানিয়ে সকলেই যেন বরণ করে নিতে পারি। মহান প্রভুর দরবারে সেই মুনাজাত রেখে শেষ করছি। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ইদানিংকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। জাতি সংঘ সহ সারাবিশ্বের সব দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *