কাদিয়ানী ধর্মমত : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (৩য় পর্ব)

(পূর্বে প্রকাশের পর)
শাহ আতাউল্লাহ উত্তরে বললেন, ‘তোমার যুক্তি অনুসারেই তোমাকে বলছি, আমার নাম হলো আতাউল্লাহ; আমার নামের অংশ ‘আতা’ ছেড়ে দিলে অবশিষ্ট থাকে ‘উল্লাহ’ বা ‘আল্লাহ’। আমি তোমার যুক্তি অনুসারে সেই ভিত্তিতেই বলছি- ‘তোমার মতো গাধাকে আমি নবী হিসেবে প্রেরণ করিনি।’ পরবর্তীতে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয় এবং মলত্যাগের সময় মলমূত্রের ক‚পে পড়ে গিয়ে মলমূত্র গলধকরণ করে মৃত্যু দুয়ারে পৌঁছে যায়। পায়খানায় পড়ে যাবার বিষয়টি তার অনুসারীরা তাৎক্ষণি জানতে পারেনি। ফলে তার অনুসারীরা নিজেদের নযীর অনুসন্ধান করতে থাকে। তিন দিন পর তাকে দুর্গন্ধময় পায়খানার মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এভাবেই অপমানের সাথে মিথ্যা নবুওয়্যাতের দাবীদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে জাহান্নামে পৌঁছে যায়।” সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়, ৩৮-৩৮
আন্তর্জাতিক পরিমÐলে কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রপক্ষের ঘোষণা ‘কাদিয়ানী কাফির’ : মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর জীবন ছিল ৭৬ বছর। ১৮৮৯ সালে যখন কাদিয়ানীর ভ্রান্ত মতবাদ শুরু হয় তখন তার বয়স ছিল ৫৪ বছর। তার এই ভ্রান্ত চিন্তাধারার প্রসারতা বৃদ্ধি পেলে সারা বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু মিথ্যাচার থেমে যায়নি। এরপর ১৯০১ সালে যখন সে নিজেকে স্পষ্ট নবী ঘোষণা করে তখন তার বয়স ছিল ৬৬ বছর। আমাদের কাছে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে কাফির ঘোষণা করা হয়। নিম্নে এ বিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরছি।
কাদিয়ানীদের ব্যাপারে বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত
(১) সিরিয়া : ১৯৫৭ সালে সিরিয়া সরকারের পক্ষে কাদিয়ানীদের সরকারিভাবে অমুসলিম ও সংখ্যালঘু ঘোষণা করেন এবং তাদের সংশ্লিষ্ট সংগঠনকেও অবৈধ এবং বেআইনী বলে ঘোষণা করা হয়। সূত্র : খাতামুল মুরসালীন। অন্যত্র রয়েছে-সিরিয়ার উলামায়ে প্রতিনিধি মুফতিয়ে আযম ফতওয়া প্রদান করেন যে, কাদিয়ানীরা শর্তহীনভাবে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শেষ নবী মানে না, তাই তারা কুরআন অস্বীকারকারী তথা ইসলামী আকীদা অস্বীকারকারী। সুতরাং অমুসলিম কাফির।
(২) মিসর : ১৯৫৮ সালে মিসর সরকারের পক্ষে সরকারিভাবে কাফির, মুরতাদ এবং তাদের সংগঠনকে বেআইনী সংগঠন বলে ঘোষণা করা হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে-মিসরের আলিমদের প্রতিনিধি মুফতিয়ে আযম শায়খ মুহাম্মদ হাসনাইন মাখলুফের নেতৃত্বে মিসরীয় ওলামা সমাজ মির্যা গোলাম আহমদের আকীদা অনুযায়ী সকল কাদিয়ানী দলের কাফির হওয়া সম্পর্কে ফাতাওয়া দিয়েছেন।
(৩) আজাদ কাশ্মীর : ১৯৭৩ সালের ২৮ এপ্রিল আজাদ এর এসেম্বরী কাদিয়ানীদের কাফির হিসেবে ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট (সরকার) আবদুল কাইয়ুম কান সে বিলে সম্মতি দিলে তা আইনে পরিণত হয়। সূত্র : খাতামুল মুরসালীন
(৪) পাকিস্তান : ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রাদেশিক পরিষদ, ‘জমিয়তে উলামা-ই ইসলাম’ এর তৎকালীন সংসদীয় নেতা ও প্রধানমন্ত্রী মাওলানা মুফতি মাহমুদ সাহেবের নেতৃত্বে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করে। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
অন্যত্র রয়েছে- “১৯৭৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ মাসব্যাপী আলাপ-আলোচনার পর এবং কাদিয়ানীদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার পূর্ণ সুযোগ দিয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, কাদিয়ানীরা কাফির ও ইসলাম বহির্ভূত। সে অনুসারে পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এতে তাদেরকে খ্রিস্টান ও হিন্দুদের মত অমুসলিম সংখ্যালঘু ঘোষণা করা হয়।” সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়। অন্যত্র রয়েছে-“এই স¤প্রদায় নিজের জন্মভূমিতেই নিষিদ্ধ হয়ে গেল। প্রথমে ১৯৭৪ সালে মাওলানা মুফতি মাহমুদ ও মাওলানা মওদূদীর (১৯০৩-১৯৭৯ ঈসায়ী) আন্দোলনের চাপে জনাব ভুট্টো (১৯২৭-১৯৭৯ ঈসায়ী) পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আহমদী মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে অমুসলমান (ঘড়ঃ গঁংষরস) ঘোষণা করে সংবিধান সংশোধন করলেন। …তারপর পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট (শাসনামল ১৯৭৮-১৯৮৮) জেনারেল জিয়াউল হক (১৯২৪-১৯৮৮) ১৯৮৪ সালে অহঃর-ওংষধসরপ অপঃরারঃরবং ড়ভ ঃযব ছধফরধহ এৎড়ঁঢ়, খধযড়ৎব এৎড়ঁঢ় ধহফ অযসধফর’ং (চৎড়যরনরঃরড়হ ধহফ চঁহরংযসবহঃ) ঙৎফরহধহপব, ১৯৮৪ জারি করেন। যার ফলে পাকিস্তানের কাদিয়ানীদের সর্বপ্রকার কার্যক্রম নিসিদ্ধ হয় এবং কেউ এই স¤প্রদায়ের রীতি-নীতি পালন করলে তিন বছর জেল ও জরিমানাসহ আইনত দÐনীয় হবে। এরা আজান দিতে পারবে না এবং নিজেদের মুসলমান বলতে পারবে না ইত্যাদি।” সূত্র : ইসলামে ধর্মীয়-রাজনৈতিক গোষ্ঠী।
(৫) আফগানিস্তান : আফগানিস্তানে সরকারিভাবে কাদিয়ানীদের মুরতাদ ও হত্যাযোগ্য বলে আদেশ জারি করা হয়েছে। তারা বহু পূর্বে ১৯৯৯ সালেই কাদিয়ানীদের প্রতি এই সিদ্ধান্ত এই ঘোষণা করেছিল। সে দেশে কাদিয়ানী ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
(৬) সৌদি আরব : সৌদি আরব সরকারের ইসলামী গবেষণা, ইফতা, দাওয়া ও ইরশাদ বিভাগ কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম-কাফির বলে সিদ্ধান্ত জারি করেছে। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
(৭) মালয়েশিয়া : মালয়েশিয়ার ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইসলামিক এফেয়ার্স’ (সরকারি সংস্থা) কাদিয়ানীদের সম্পর্কে ছঁফরুধহর ঞবধপযরহমং নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই পুস্তিকার ৩য় পৃষ্ঠায় ঘোষণা করা হয়েছে- কাদিয়ানী/আহমাদী স¤প্রদায় ইসলাম বহির্ভূত একটি স¤প্রদায়। অতএব তারা মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট পরিভাষা ও অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারবে না এবং তাদের লাশ মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করতে পারবে না। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
(৮) ইন্দোনেশিয়া : বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ ইন্দোনেশিয়া কাদিয়ানীদের অমুসলিম বলে বিবেচনা করেছে। সেখানে অমুসলিম ধর্ম প্রচার নিয়ন্ত্রিত করে একটি আদেশ জারি করা হয়েছে। সে আদেশের অধীনে কাদিয়ানী ও খ্রিস্টানরা মুসলিমদের নিকট তাদের ধর্ম প্রচার করতে পারে না। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
(৯) নাইজেরিয়া : ওআইসি’র অন্যতম সদস্য নাইজেরিয়া আফ্রিকার বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। সে দেশ হতে সউদী আরব গমনের সময় ভ্রমণকারীকে অবশ্যই ‘অ-আহমাদী সনদ’ গ্রহণ করে সাথে বহন করতে হয়। দেশী-বিদেশী সমস্ত পর্যটকই এ নিয়মের অধীনে সরকারের নিকট হতে এ সনদ সংগ্রহ করে থাকে। কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম বিবেচনা করেই সরকার তাদেরকে সউদী আরব বিশেষত: মক্কা শরীফ ও মদনী শরীয় যেতে দেয়া হয় না। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
(১০) তুরস্ক : ইউরোপের একমাত্র বৃহত্তম মুসলিম দেশ তুরস্কে কাদিয়ানী ধর্ম প্রচারিত হওয়াতে মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মুসলিম ও কাদিয়ানীদের মধ্যে যেকোনো প্রকারের সহিংসতা ও বোঝাবুঝির অবসানকল্পে সরকার কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
(১১) সংযুক্ত আরব আমিরাত (টঅঊ- টহরঃবফ অৎধন ঊসরৎধঃব) : সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউনাইটেড আরব আমিরাত) বহুদিন যাবত ব্রিটিশ কলোনী থাকার কারণে কাদিয়ানীরা এখানে তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ পায়। খতমে নবুয়্যাতের চরম শত্রæ এ দলটি বাতিল ধর্ম প্রচারে ব্যাপৃত থাকার কারণে এদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। ঘোষণাতে বলা হয়, এরা এতো সূ²ভাবে ও গোপনে তাদের মতবাদ পোষণ করে যে, অমুসলিম হওয়া সত্তে¡ও এদেরকে সরাসরি মুসলিম বলা কঠিন। কারণ, এদের নাম, লেবাস, বিয়ে, খাদ্যবস্তু সবকিছু মুসলমানের অনুরূপ। তাই এদেরকে অমুসলিম হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়োজনে এ সরকারি ঘোষণা জারি করা হলো। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
(১২) গাম্বিয়া : গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুল থেকে স¤প্রতি গাম্বিয়ান সরকার কর্তৃক কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশে বলা হয় যে, সে দেশে কাদিয়ানীরা ইসলাম বিরোধী অনৈতিক কার্যকলাপ এতটা বাড়িয়ে দিয়েছে যাতে মুসলিম সমাজে প্রচÐ ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কাদিয়ানীরা মুসলিম সমাজকে ইসলামের নীতি-পরিপন্থী বিপথে আহŸান করছিল। কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও অসন্তুষের প্রেক্ষিতে সরকার তাদের কার্যকলাপ সম্পর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।

রাবেতা আলম আল ইসলামী এবং ওআইসি কর্তৃক কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা
(১) রাবেতা : ১৯৭৪ সাল মুতাবিক ১৩৯৪ হিজরীর ১৪-১৮ রাবীউল আউয়াল পাঁচ দিনব্যাপী ১০৪টি মুসলিম দেশের সম্মিলিত সংগঠন রাবেতা আলম আল ইসলামীর অধিবেশনে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (ক) কাদিয়ানীরা কাফির ও ইসলাম বহির্ভূত। (খ) তাদেরকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, পাবিবারিক তথা সর্বক্ষেত্রে বয়কট করা হোক। (গ) তাদের সঙ্গে বিবাহ-শাদী হারাম এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাদের দাফন না করা হোক। উক্ত প্রস্তাবাবলী ১০৪টি দেশের প্রতিনিধিগণ সম্মিলিতভাবে পাশ করেছেন। তাদের মধ্যে সৌদি আরব, দুবাই, আবুধাবী ও কাতার ইত্যাদি দেশসমূহের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সূত্র : খাতামুল মুরসালীন।
(২) ওআইসি : “দালাল কাদিয়ানীদের এ ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকাÐের কারণে ১৯৭৪ সালের ৮ এপ্রিল মক্কা মুকারামায় ৫৮টি মুসলিম রাষ্ট্রের সমন্বয়ে পরিচালিত সংগঠন ওআইসির (অর্গেনাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স) এক সমাবেশে এ প্রস্তাব পাশ করে যে-“কাদিয়ানীদেরকে সমস্ত ইসলামী রাষ্ট্র সমূহে অমুসলিম তথা কাফির ঘোষণা দিয়ে তাদের সরকারি পদসমূহ থেকে বহিষ্কার করা হবে এবং সংখ্যালঘু গণ্য করে অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায়ের ন্যায় থাকতে বাধ্য করা হবে।” সূত্র : মাসিক হেফাজতে ইসলাম-নভেম্বর, ২০০৭
অন্য বর্ণনায় রয়েছে-‘ওআইসির’ (অর্গেনাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স) অধীন বিশ^ ফিকাহ একাডেমি, বিশ^ মুসলিম কংগ্রেস তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। ১৯৭৪ সালে বিশে^র ১৪৪টি রাষ্ট্রের ফিকাহবিদগণ পবিত্র মক্কায় রাবিতা আলম আল ইসলামীর উদ্যোগে সর্বসম্মতভাবে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম বলে ঘোষণা করেছে এবং সকল মুসলিম দেশকে অনরূপ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। এ কারণে অনেক মুসলিম দেশই তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। এ সম্মেলনে কাদিয়ানীদের সম্পর্কে কয়েকটি প্রস্তাব পাশ করা হয়। সে প্রস্তাবগুলোর সারমর্ম হলো-‘কাদিয়ানীয়াত’ একটি বাতিল ধর্ম। নিজেদের কলুষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কাদিয়ানীরা মুসলমানদের ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। এরা ইসলামের ভিত্তিসমূহকে ধূলিসাৎ করে দিতে চায়। এরা ইসলামের দুশমন। নি¤œলিখিত বিষয়গুলো থেকে তা সুষ্পষ্ট হয়ে ওঠে। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে নবী দাবী করেছে। কুরআনের আয়াতসমূহ বিকৃতি করেছে। জিহাদের বিধান বাতিল হওয়ার ফাতাওয়া প্রদান করেছে। তারা ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ^াসের পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন এবং মূলোৎপাটন করার জন্য বিভিন্ন পন্থায় তৎপর রয়েছে। ইসলামের শত্রæ-শক্তির সহায়তায় মসজিদের নামে মুরতাদদের আড্ডাখানা তৈরি করে যাচ্ছে। মাদরাসা, স্কুল, এতিমখানা এবং সাহায্য সংস্থার নামে অমুসলিম শক্তির সহায়তায় নিজেদের বিকৃত উদ্দেশ্য সাধন করছে। দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় কুরআনের বিকৃত সংস্করণগুলো প্রচার করছে ইত্যাদি। তাদের এসব কার্যকলাপকে সামনে রেখে সম্মেলনে প্রস্তাব পাস করা হয়।
ওআইসির সম্মেলনে পাশকৃত প্রস্তাব : (১) বিশ্বব্যাপী ইসলামী সংগঠনগুলোর দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে-তারা যেন কাদিয়ানীদের ইবাদতখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এতীমখানা এবং অন্যান্য যেসব এলাকায় তারা রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে তার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখে। এদের ছড়ানো ষড়যন্ত্রের জাল থেকে বাঁচার জন্য ইসলামী দুনিয়ার সামনে পূর্ণাঙ্গভাবে কাদিয়ানীদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। (২) এ সম্প্রদায় কাফির এবং ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত (মুরতাদ) হওয়ার কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। এ জন্যই তাদেরকে মক্কা-মদিনায় প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। (৩) মুসলমানগণ কাদিয়ানীদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না। অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদেরকে বয়কট করতে হবে। তাদের মরদেহ মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করতে দেয়া যাবে না। (৪) এ সম্মেলন সকল মুসলিম রাষ্ট্রের কাছে এ দাবী করছে যে, নুবুওয়্যাতের মিথ্যা দাবীদার ভÐ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীদের যেকোনো প্রকারের তৎপরতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক এবং তাদেরকে অমুসলিম সংখ্যালঘু ঘোষণা করা হোক। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদসমূহে তাদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হোক।
(৫) কাদিয়ানীরা কুরআন মাজীদে যে বিকৃতি করেছে, এর চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদের অনূদিত কুরআনের কপিগুলো সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করতে হবে এবং অনুবাদের প্রচার বন্ধ করে দিতে হবে।
এসব প্রস্তাব পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। দিল্লির সাপ্তাহিক ‘আল-জমিয়াত’ (২৯ এপ্রিল, ১৯৭৪), কলিকাতার উর্দু দৈনিক ‘আসরে জাদীদ’ (৯ মার্চ, ১৯৭৫), কাদিয়ানীদের সাপ্তাহিক ‘বদর’ (৯ মে, ১৯৭৪) প্রভৃতি ভারতীয় পত্রিকাতেও এ প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।
মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশায়িখ এর ফাতাওয়া ‘কাদিয়ানীরা কাফির’ : ১৮৮২ সালে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৩৫-১৯০৮ ঈসায়ী/ ১২৫০-১৩২৬ হিজরি) সর্বপ্রথম আল্লাহ কর্তৃক ওহী প্রাপ্তির ঘোষণা প্রদান করে। এর পর পর্যায়ক্রমে তার জীবনে নানা রকমের আজগুবি ঘটনার জন্ম হয়। আর এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৮৮৯ সালে প্রকাশ্যে তার ভ্রান্ত কাদিয়ানী মতবাদ শুরু করে এবং ১৯০১ সালে সে নিজেকে নবী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর পর পর্যায়ক্রমে ইমাম মাহদী ও মাসীহে মাঊদ বা প্রতিশ্রæত মাসীহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তার এসব কার্যক্রম উদ্ভাসিত হতে চললে দ্বীনের পতাকাবাহী বিশ্বের আলিমে দ্বীনরা গর্জে উঠেন। নি¤েœ বিশেষ ক’জন বরেণ্য আলিমের কাদিয়ানবিরোধী প্রকাশিত ফতোওয়া তুলে ধরছি।
দারুল উলূম দেওবন্দ এর মুরব্বিগণের ফাতাওয়া : ১৮৮৩ ঈসায়ী মুতাবিক সফর ১৩০১ হিজরি-দারুল উলূম দেওবন্দ এর তৎকালীন সকল মুরব্বিগণ একমত হয়ে ফাতাওয়া প্রদান করেন-‘কাদিয়ানীরা মুরতাদ, যিন্দীক, মুলহিক এবং কাফির।’
মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানাতুবী ছাহেবের ফাতাওয়া : ১৮৮৩ ঈসায়ী মুতাবিক ১৩০১ হিজরি-বরেণ্য মুহাদ্দিস দারুল উলূম দেওবন্দ এর প্রথম প্রধান শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানাতুবী (১২৪৯-১৩০২ হিজরি) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়া প্রদান করে-মির্যা (গোলাম আহমদ) কাদিয়ানী ও তার অনুসারীগণ দাহরিয়া (কাফির)।’
মুফতীয়ে আযম মাওলানা আযীযুর রহমান উসমানী ছাহেবের ফাতাওয়া : ১৮৮৪ ঈসায়ী মুতাবিক রজব ১৩০২ হিজরি-মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা আযীযুর রহমান উসমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়া প্রদান করেন-‘কাদিয়ানীরা কাফির’। এ ফাতাওয়াটি মুদ্রণ করে প্রচার করা হয়েছে।
মাওলানা হাবীবুর রাহমান উসমানী ছাহেবের ফাতাওয়া : ১৯০৩ ঈসায়ীর মার্চ মুতাবিক ১৩২১ হিজরি-মাওলানা হাবীবুর রহমান রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সভাপতিত্বে কাদিয়ান গ্রামে ৩ দিনব্যাপী এক সম্মেলন এর আয়োজন করা হয়। তিনি এ সম্মেলনে প্রমাণ করেছেন যে, ‘কাদিয়ানীরা কাফির।’
মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ ছাহেবের ফাতাওয়া : ১৯০৩ ঈসায়ী মুতাবিক ১৩২১ হিজরি-হযরত মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ দেহলবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শাহজাহানপুর (ভারত) থেকে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ‘কাদিয়ানীরা কাফির’ এ মর্মে ‘আল বুরহান’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন।
মাওলানা আহমাদ হাসান আমরুহী ছাহেবের ফাতাওয়া : ১৯০৯ ঈসায়ীর ১৫ জুন মুতাবিক ১৩২৭ হিজরী মাওলানা আহমাদ হাসান আমরুহী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রামপুরে অনুষ্ঠিত এক মুনাযারা-এ (বিতর্ক-অনুষ্ঠান) জনৈক কাদিয়ানী অনুসারীকে আলোচনান্তে পরাজিত করে ফাতাওয়া প্রদান করেছেন যে, ‘কাদিয়ানীরা কাফির’।
আল কাউলুস সাহীহ ফী আকাঈদিল মাসীহ-এ বর্ণিত ফাতাওয়া : ১৯১২ সালে মুদ্রিত ও প্রকাশিত, আল কাউলুস সাহীহ ফী আকাঈদিল মাসীহ নামের পুস্তকাদিতে তদানীন্তন ভারতের প্রতিটি প্রদেশ ও জেলার শত শত আলিমের দরখাস্ত রয়েছে। এতে সকল আলিমই সর্বসম্মতভাবে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ও কাফির বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ অনুসারী উলামা-মাশায়িখগণের অভিমত : ১৯২৩ ঈসায়ীর ৬ নভেম্বর-ভারতের দিল্লীতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের অধিবেশনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়েছে যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় (আহমাদী জামাত) ও লাহোরী এদের সকলের আকীদা ইসলাম বহিভর্‚ত এবং সকলই কাফির।
দারুল উলূম দেওবন্দ এর উসতাদগণের ফাতাওয়া : ১৩৪১ হিজরীর সফর মাসে দারুল উলূম দেওবন্দ এর উসতাদগণ ফাতাওয়া প্রদান করে যে, ‘কাদিয়ানীরা মুরতাদ, যিন্দীক, মুলহিদ ও কাফির’। মির্যা কাদিয়ানীর জীবদ্দশাতেই দারুল উলূম দেওবন্দ এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কুতবে আলম মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুরী (১৯২৮-১৯০৫) রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নেতৃত্বে ভারতের অনেক আলিম-বুযুর্গ ব্যক্তিগণ গোলাম আহমদকে কাফির বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ ছাহেবের ফাতাওয়া : ১৯২৫ ঈসায়ী মুতাবিক ১৩৪৩ হিজরী- হযরত মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (১৮৭৫-১৯৩৩) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় বিজ্ঞ ছাত্রদের সাথে নিয়ে সারা পাঞ্জাব ভ্রমণ করে কাদিয়ানীদের যাবতীয় মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন এবং বলেছেন ‘কাদিয়ানীরা কাফির’।
আহলে হাদী উলামাগণের ফাতাওয়া : ১৯২৫ সালে আহলে হাদীস অমৃতসর কেন্দ্র হতে একটি ফাতাওয়া ‘ফসখে নিকাহে মির্যায়ী’ নামে প্রচারিত হয়। এতে অবিভক্ত ভারতের সকল শীর্ষস্থানীয় আলিমগনের স্বাক্ষর রয়েছে। সকলে একবাক্যে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম, কাফির বলে ফাতাওয়া প্রদান করেন।
তুর্কী উলামায়ে কিরামের ফাতাওয়া : ১৯৩৫ সালে তুর্কী উলামায়ে কিরাম একযোগে কাদিয়ানীদের অমুসলিম-মুরতাদ ঘোষণা প্রদান করেন। সূত্র : ১ খাতামুল মুরসালীন ২. কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়।

লেখকঃ মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন কালারুকী

চলবে

(১ম পর্ব) (২য় পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

বাবা আমার পথচলার অনুপ্রেরণা

‘বাবা’ শব্দটি শুনলেই কারো কারো মনে ভেসে ওঠে একজন বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। আবার কারো মনে ভেসে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *