রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য মানুষ পশু থেকে পৃথক সে বিবেক তখন লুপ্ত। হায়েনার বিষাক্ত ছোবল গ্রাস করেছে পুরো জমিন। একত্ববাদের জায়গায় তখন জয়ধ্বনি চলছে শতশত প্রভুর। এমনি এক সংকটময় মুহুর্তে ধূলির ধরায় তাশরিফ আনেন রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পৃথিবীর শ্রেষ্ট বংশে, শ্রেষ্ট বংশের সম্মানীত গোত্রে। জন্মসূত্রেই সম্মানীত বংশের সম্মানীত লোক হিসেবে বিবেচিত হতেন তিনি। সে অবিশ্বাসীদের যুগে তিনি ছিলেন অধিক বিশ্বাসী, অপবিত্র লোকদের মাঝে ছিলেন পুত:পবিত্র, অসত্যের কেন্দ্রে বসে করেছেন সত্যের চাষ। তাইতো তখন তিনি সবার কাছে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। সবার প্রিয় আল-আমিন ছিলেন।
তখনকার মক্কার লোকদের সমস্ত কার্যকলাপ তাঁকে ব্যথিত করতো। তিনি এদের অসুস্থ চিন্তা চেতনা নিয়ে ভাবতেন। এসব ভাবনা চিন্তার মাঝে একদিন তাবলীগের নির্দেশ আসলো। খোদায়ী পয়গাম এলো, এক আল্লাহর দাসত্বে মানুষদের আহবান করার। শান্তির মিছিলে, চিরমুক্তির মিছিলে ডাক দিলেন রাসুলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রাতারাতি সবার প্রিয় মুহাম্মাদ হয়ে গেলেন তাদের জাত শত্রু! যাকে এত বিশ্বাস আর এত শ্রদ্ধা করতো তারা তাঁর উপর ও তাঁর কতিপয় দুর্বল সাথীদের উপর চালানো হলো অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার। পর্যায়ক্রমে তারা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্রে উপনীত হলো। নির্দেশ এলো জন্মভূমি ফেলে চলে যাবার। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের সফর মাসের শেষ দশকের এক রাতে সুখ-দুঃখের সাথী আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুকে সাথে করে বেরিয়ে পড়েন ইয়াসরিবের উদ্দেশ্যে। সে ঐতিহাসিক মুবারক যাত্রাপথ আশ্চর্যজনক অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে তাঁদের নিয়ে পৌছায় ইয়াসরিবে।
কিছুদিন আগে জনৈক লোককে একজন লোকের এক দেশ থেকে অন্যদেশে স্থানান্তরের সাথে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের তুলনা দিয়েছিলেন। শুনে শুধু আফসোস করলাম আর চিন্তা করলাম হয়তো এরা রাসুলে পাকের সীরাত যখন পড়েছে তারা দেখেছে ইনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ কিন্তু তাদের কাছে ইনি যে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সেটা স্পষ্ট হয়নি। সেকারণেই এরা যেকারো সাথেই তাঁর তুলনা দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরত কেন অন্য সবার থেকে আলাদা তা সে যাত্রাপথের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যাবে।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তো যখন ইচ্ছা তাঁর বন্ধুকে হিজরাতের আদেশ দিতে পারতেন কিন্তু কেন তাঁকে ওই রাতেই ঘর থেকে বের হতে বললেন, যে রাতে মক্কার কাফেররা তাঁকে ঘেরাও করেছিল হত্যা করার জন্য। কেন এর আগে তাঁকে তিনি অবগত করেননি যেখানে তিনি কাফেরদের মনের সব খবরই জানেন? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র একমুষ্টি মাটি নিক্ষেপ করলেন কিন্তু কিভাবে তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে উপস্থিত সকল কাফেরদের চোখে-মুখে গিয়ে পড়ল? সওর গুহার ভিতরে যখন তাঁরা দুজন লুকিয়ে ছিলেন তখন কেনই বা তাদেঁর পিছু নেয়া লোকেরা তাদের পায়ের দিকে তাকাবেনা, যেখানে তারা নীচে তাকালেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুকে দেখতে পেত?
তাছাড়া, পথিমধ্যে উম্মে মা’বাদের শীর্ণকায়, অতিশয় দুর্বল ছাগী থেকে অলৌকিক দুধ দুহনের ঘটনা। রাসুলে পাকের জীবন নিতে আসা সুরায়কার ঘোড়া মরুভূমির তপ্ত বালুতে ধেবে যাওয়া এবং শেষে সেই সুরায়কাই রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চলে যাওয়া। এই এতসব অবিশ্বাস্য ঘটনা শুধুমাত্র কি এমনি এমনি ঘটেছে? না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এসমস্ত ঘটনা দ্বারা কেয়ামত পর্যন্ত সকলের কাছে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন যে, তোমাদের কোনকিছু আমার নবীর মতো না। সৃষ্টি জগতের মাঝে তিনিই একমাত্র অনন্য, তাঁর সাথে অন্য কারো তুলনা চলে না।
অত্যাচারিত হয়ে অনেক সাহাবী হিজরত করেছেন, একবার না অনেক সাহাবী বহুবার বিভিন্ন দেশে হিজরত করেছেন। সালফে সালেহীনদের মধ্যেও অনেকে হিজরত করেছেন তৎকালীন জালিম শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে। কারো যদি তুলনা দিতে মনচায় তাহলে সে তাঁদের সাথে তুলনা করতে পারে। কোন কিছু চিন্তা না করে সোজা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারক হিজরতের তুলনা দেয়া উচিত না। সৃষ্টিকুলের মাঝে তুলনাহীন একমাত্র সত্বা হলেন রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের মুবারক সীরাত পাঠ করার সময় আমাদের নিক্তি যদি হয় ‘রিসালাত’ তখন আর আমাদের এসকল নতুন নতুন সমস্যায় পড়তে হবে না। তখন রাসুলের মুবারক জীবনের কোন বিষয়কে আমাদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারবো না। রাসুল স্বীকৃতি দিলেই আপনাকে মানতে হবে তিনি আর আমার মতো নন। তাঁর সকল কিছুই রিসালাতের শান অনুযায়ী হবে।

লেখকঃ যুবাইর আহমদ মাবরুর

Comments

comments

About

Check Also

বাবা আমার পথচলার অনুপ্রেরণা

‘বাবা’ শব্দটি শুনলেই কারো কারো মনে ভেসে ওঠে একজন বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। আবার কারো মনে ভেসে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *