শহীদে বালাকোট হযরত সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী রহ.

মহান রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে অসংখ্য অগণিত নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদের ঘোষণা দিতে। নবী-রাসুলগণ এসে এ পৃথিবীতে তাঁর একত্ববাদের প্রচার-প্রসার করেছেন আল্লাহর বিধি-বিধান অনুসারে। আল্লাহ বলেন, ‘আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একেকজন রাসুল রয়েছে। যখন তাদের কাছে তাদের রাসুল ন্যায়দণ্ডসহ উপস্থিত হল, তখন আর তাদের উপর জুলুম হয় না’-(সুরা ইউনুস : ৪৭)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে আল্লাহ হেদায়েত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামীতা অবধারিত হয়ে গেল’-(সুরা আন নহল : ৩৬)। নবী-রাসুলগণের পরে এ ধরাধামে এ জমিনকে ইসলামের আলোতে আলোকিত করে গেছেন নবী-রাসুলদের উত্তরসূরীরা। তারা আবাদ করেছেন আল্লাহর এ জমিনকে। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে পথপ্রদর্শক রয়েছে’ (সুরা আর রা’আদঃ ০৭)। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক আমার উম্মতের হেদায়েতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শেষে অথবা শুরুতে এমন একজন মানুষ প্রেরণ করবেন, যিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে (ইসলাম ধর্ম) সংস্কার করবেন’ -(আবু দাউদ- ৪২৯২)। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভবিষ্যৎ বাণীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সতের শতাব্দীর শেষের দিকে এক মহামানবের আগমন ঘটেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। যিনি সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. হিসেবে প্রসিদ্ধ। এমন এক সময় তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল যখন ভারতের মুসলমানদের উপর ইংরেজ, শিখ ও হিন্দুদের অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অনেক এলাকাতে মুসলমানদের বসবাস করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। যুলুম-নির্যাতন এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, যালিম শয়তানরা মুসলিম নারীদের দাসীরূপে ব্যবহার করত। মুসলমানদের ফসলাদি নষ্ট করে দিত, ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিত। সীমান্তের মসজিদগুলোকে মন্দির ও ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করেছিল। এমনকি মসজিদে আজান দেওয়াসহ অনেক জায়গায় ধর্মীয় কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিল। সর্বোপরি একদিকে মুসলমানরা বিধর্মীদের হাতে লাঞ্চিত-বঞ্চিত ও নির্যাতিত ছিল, অন্যদিকে ব্রিটিশ, হিন্দু ও শিখদের প্রভাব প্রতিপত্তির ফলে মুসলমানরা তাদের তাহজিব-তামাদ্দুন তথা মূল আদর্শ-সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে প্রাশ্চাত্য ও হিন্দুয়ানি আদর্শ-সংস্কৃতি গ্রহণ করা শুরু করেছিল। এমনকি বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানরা হিন্দুদের পোষাক-পরিচ্ছেদ ব্যবহার করাসহ তাদের নামের পূর্বে “শ্রী শ্রী” শব্দ পর্যন্ত ব্যবহার করত। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার, তৎকালীন যামানার শ্রেষ্ট মুজাদ্দেদ, তরিকতের ইমাম এবং যুগের শ্রেষ্ট বুজুর্গ ও পীর। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে তাঁর নাম।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার, ইমামুত তরিকত, শহীদে বালাকোট, আমীরুল মু’মিনীন, আওলাদে রাসুল সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. নভেম্বর এর ২৯ তারিখ ১৭৮৬ ঈসায়ী সন মোতাবেক ৬ই সফর-১২০১ হিজরীতে সোমবার ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম সায়্যিদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আগমন যেন মুসলিম মিল্লাতের জন্য অমীয় বারিধারা হিসেবে নবপ্রাণে সঞ্চার ঘটে। তিনি প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৌহিত্র এবং হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু (রা.) ও হযরত ফাতেমাতুজ জাহরা (রা.) এর পুত্র ইমাম হাসান (রা.)’র বংশধারার ৩৬তম অধ:স্তন পুরুষ। তাঁর পিতার নাম হজরত সায়্যিদ ইরফান (র.)।
রায়বেরেলীতেই হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। ৪ বছর বয়সে ভর্তি হন স্থানীয় মক্তবে। পিতার ইন্তেকালের পর ১৩ বছর বয়সে পিতৃহীন সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ভারতের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হজরত শাহ ইসহাক দেহলভী (র.) এর কাছ থেকে ইলমে শরীয়তের বুৎপত্তি অর্জন করেন। পরবর্তিতে তিনি অনেক দূর্গম পথ অতিক্রম করে দিল্লিতে এসে সরাসরি ইমামুল মুহাদ্দিসীন, শায়খুল মাশায়েখ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বাইয়াত গ্রহণ করেন। হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) অতি অল্পদিনেই ইলমে তাসাউফের সু-উচ্চ মাকামে আরোহণ করেন। শাহ ছাহেব (র.) তাকে খিলাফতি দান করেন। তাই ইলমে বাতিনের সকল মাকামই তাঁর আয়ত্ব হয়েছিল অতি সহজে। এ কারণে তাঁর পীর ও মুর্শীদ হযরত শাহ ছাহেব রহ.’র নিকট কোন লোক মুরিদ হতে আসলে তিনি তাদেরকে হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. এর নিকট পাঠিয়ে দিতেন।
হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. তাঁর জীবন কাটিয়েছেন আন্দোলন সংগ্রাম আর দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশকৃত বিভিন্ন অপসংস্কৃতির সংস্কারমূলক কাজ করে। তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করলে তার আন্দোলন সংগ্রামকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
দ্বীনী সংস্কার আন্দোলন, আধ্যাত্মিক আন্দোলন (তরিকায়ে মুহাম্মদীয়া), সশস্ত্র জিহাদ।
এ মহান মনীষী তাঁর জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন ইসলামের তরে। যুদ্ধ করে হয়েছেন শহিদ। কিন্তু; অন্যায়কে গ্রহণ করেন নি। বরং ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন জীবনভর। রয়েছেন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে। আজো বালাকোটের সেই ময়দান তাঁর শাহাদাতের গ্লানি মুছে ফেলতে পারেনি। মুছে ফেলতে পারেনি তাঁর স্মৃতিগাঁথা প্রোথিতযশা কাহিনীগুলো। আর ভুলবেই কেমন করে? সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. ছিলেন সর্বকালের অনুকরণীয় মুহাদ্দিস, তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.-এর অন্যতম শিষ্য। মূলত : তাঁর আদেশেই সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পারিপার্শ্বিক অন্যান্য জাতির প্রভাবে কলুষিত মুসলিম জাতির ঈমান-আক্কীদাকে শিরকমুক্ত করা এবং মুসলিম জীবনধারা ও জাগরণের অন্তরায় অশুভ শক্তি সমূহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই আন্দোলন শুরু করেন। কেননা, এ দুটি কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী ও আবশ্যিক।
মোঘল সালতানাতের পতনের পর মুসলিম জনগণের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। মসজিদে আজান এবং জুমু’আর জামাত বন্ধ হয়ে যায়। মুসলমানদের অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে ছিল যে, অনেকেই সে সময় ইসলামের অন্যতম রূকন হজ্জ করার প্রয়োজন নেই বলে ফতোয়া দেয়া শুরু করেছিল। এ ভয়াবহতা সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. কে তাড়িত করে। প্রথমে তিনি মুসলমানদের জাগরণের জন্য দাওয়াতী সফর শুরু করেন। তাঁর এ আন্দোলনে অনেক বাংলাদেশি যুবকও শরীক হয়েছিলেন। ৬ মে ১৮৩১ সাল। ঐতিহাসিক বালাকোটে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ৭০০ মুজাহিদ নিয়ে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিং-এর ১০, ০০০ শিখ সৈন্যের সাথে মোকাবিলা করেন। যুদ্ধে মোকাবিলার পূর্বে শিখ রাজা রনজিৎ সিং-কে প্রথমে পত্র মারফত মুসলিম নির্যাতন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। শিখ রাজা পত্রের জবাব না দিয়ে মুজাহিদগণকে শায়েস্তা করার হুংকার দেন। তার জবাবে মুসলমানরা পরপর দুইবার শিখদের শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। মুসলমানদের আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। এসময় তাদের উপর শিখদের আতর্কিত হামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। এই ঘটনার পর মুজাহিদগণের মনোবল দূর্বল হয়ে যাওয়ায় সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) মুজাহিদগণকে নিজ নিজ বাসগৃহে ফিরে যেতে অনুমতি দেন। অনেকেই ফিরে যেতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। অবশিষ্ট মুজাহিদগণকে নিয়ে পেশোয়ার থেকে কাগানের পার্বত্য এলাকা দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথিমধ্যে ‘বালাকোট’ প্রান্তরে এক তুমুল যুদ্ধের সূচনা ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে মুজাহিদগণ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেন। কিন্তু কতিপয় লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) বেশকিছু মুজাহিদসহ শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। এভাবেই দ্বীনের তরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) তাঁর সংগ্রামী জীবনের ইতি ঘটান। আর জীবন্ত থাকেন সকলের হৃদয়ে। তিনি সশস্ত্র জিহাদের পাশাপাশি আমরণ করে গেছেন দ্বীনী সংস্কারমূলক কাজ। তৎকালীন শিরক বিদআতের বিরুদ্ধে লড়েছেন সাহসিকতার সাথে। তাঁর সংস্কারের মধ্যে রয়েছে সালামের পূনঃ প্রচলন, ইসলামী পোষাক-পরিচ্ছেদ পূনঃ প্রবর্তন, কবর পূজা সহ নানা ধরণের শিরক বিদআতের উচ্ছেদ, হজ্জের ফরজিয়ত সম্পর্কে প্রচলিত অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে অবস্থান ও এর সঠিক জবাব, সদলবলে হজ্জ পালন, বিবাহ প্রথা সংশোধন, হিন্দুয়ানী বেশ-ভূষা ও রীতি-নীতি থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষা। হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. এর আধ্যাত্মিক আন্দোলন কত উচ্চ শিখরে ছিল তাঁর সত্যতা ও শ্রেষ্টত্ব বর্তমান সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের হক্কানী সিলসিলা ও দরবার শরীফ দেখলে বুঝা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের ফুলতলী, জৈনপুরী, ছারছিনা, ফুরফুরা, নারিন্দা, সোনাকান্দা, মৌকারা-সহ এদেশের সিংহভাগ হক্কানী সিলসিলার পূর্বসূরী হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ.। সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ. আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য ‘তরিকায়ে মুহাম্মদীয়া’ নামে একটি তরীকা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি হলো চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নক্শবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদীয়া তরিকার সার নির্য্যাস। অধ্যাপক এইচ. রহমান সম্পাদিত ‘ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে সাইয়্যিদ সাহেব রহ. এর প্রতিষ্ঠিত তরিকায়ে মুহাম্মদীয়াকে “সংস্কার আন্দোলন” নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আমরা এ মহা মনীষীর জীবন থেকে আমাদের জীবনের পাথেয় হিসেবে অনেক কিছু গ্রহণ করতে পারি।

Comments

comments

About

Check Also

নালায়ে কলন্দর : পূত হৃদয়ের নান্দনিক ছন্দবদ্ধ অভিব্যক্তি

মাহবুবুর রহীম আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) রচিত উর্দুভাষার কাব্যগ্রন্থ ‘নালায়ে কলন্দর’। ‘কলন্দর’ হচ্ছে কাব্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *