আল্লামা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল

ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে যে কয়জন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এ ভারত উপমহাদেশে কাব্য ও সাহিত্য রচনার মাধ্যমে দেশ ও জাতি ও আন্তর্জাতিক মহলের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে মুসলিম রেনেসাঁর অগ্নিপুরুষ ড. স্যার আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ছিলেন অন্যতম পুরোধা। তিনি ছিলেন একাধারে মহাকবি, মানবতার কবি, মুসলিম কবি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কবি। মুসলিম জাতির অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য, গৌরব ও মর্যাদা নিয়ে কাব্য ও সাহিত্য রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। একটি সংক্ষিপ্ত লেখা বা বক্তৃতায় কোনো মহান শিল্পীর বিশদ বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে আল্লামা ইকবালের ক্ষেত্রে। তবুও এ মহান ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাঠক সমাজে উপস্থাপন করার মানসে আজকের এই সামান্য প্রয়াস।

জন্ম ও বংশ পরিচয়
হিমালয়ের পাদদেশ হতে ত্রিশ মাইল দূরে পাঞ্জাবের অন্তর্গত শিয়ালকোট শহরে ২৪ শে জিলহজ্জ ১২৮৯ হিজরী মোতাবেক ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর আল্লামা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম শেখ মুহাম্মদ ইকবাল। পিতার নাম শেখ নূর মুহাম্মদ, মাতার নাম ইমাম বিবি। আল্লামা ইকবালের পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন সাপ্র“ গোত্রীয় কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ। অষ্টাদশ শতাব্দির প্রথম ভাগে জনৈক সূফীর প্রভাবে উপরোক্ত সাপ্র“ পরিবার ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রিত হন। অতঃপর পাঠান শাসনের হাঙ্গামা হুজ্জতের সময় কাশ্মীর পরিত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন বিখ্যাত শহর শিয়ালকোটে।
শৈশব ও শিক্ষা
শিয়ালকোটেই ইকবালের শৈশব ও শিক্ষা জীবনের শুভ সূচনা। সূফী ভাবাপন্ন পিতা শেখ নূর মুহাম্মদ এর ইচ্ছা ছিল ইকবালকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া; কিন্তু তার উস্তাদ শামছুল উলামা সৈয়দ মীর হাসানের পরামর্শে তাকে পাঠানো হলো ইংরেজি স্কুলে। শিয়ালকোটের এই স্কুলের নাম ছিল ‘স্কচ মিশন স্কুল’ মতান্তরে ‘স্কচ মডেল হাই স্কুল’। ১৮৮৭ সালে ইকবাল প্রায় ১০ বছর বয়সে উক্ত স্কুল হতে প্রাথমিক পরীক্ষাসমূহে উত্তীর্ণ হন কৃতিত্বের সাথে। একই স্কুল থেকে ১৮৯১ সালে ইকবাল ফার্স্ট হন এবং লাভ করেন ‘গোল্ড মডেল পুরস্কার’। পরে লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজ হতে ১৮৯৫ সালে এফ.এ. ১৮৯৭ সালে বি.এ. পাস করেন। অতঃপর ইকবাল দর্শন শাস্ত্রে এম.এ. পাস করেন ১৮৯৯ ইংরেজি সালে।

অধ্যাপনা ও উচ্চতর শিক্ষা
এম.এ. পাস করার পর প্রথমে লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে দর্শন ও ইতিহাস এবং পরে লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজে দর্শন ও ইংরেজি ভাষার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিছুদিন অধ্যাপনার পর উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য তিনি লন্ডন গমন করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিখ্যাত দার্শনিক ড. ম্যাকটাগার্ট এর মতো প্রফেসারের পরিচালনাধীনে দর্শন শাস্ত্রে আবার এম.এ. পাস করেন। তারপর জার্মানির মিউনিখ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯০৭ সালে উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ সবঃধঢ়যুংরপং রং চবৎংরধ (প্রজ্ঞান চর্চায় ইরান) নামে পারস্যের দর্শনশাস্ত্র সম্বন্ধে থিসিস রচনা করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। পুনরায় লন্ডন ফিরে আসেন এবং ১৯০৮ সালে লন্ডনের লিন্কনস্ ইন (খরহপড়ষহং ওহহ) ব্যারিস্টারি পাস করেন।
লন্ডন থাকাকালে তিনি কিছুদিন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স এ রাজনীতি শিক্ষা এবং লন্ডন ইউনিভার্সিটির আরবি ভাষার অধ্যাপকের পদে কাজ করেন। এ সময় আল্লামা ইকবালের সাথে ড. ম্যাকটেগার্ট ব্রাউন, ড. নিকলসন, ফরাসি মনীষী বাঁগস প্রমুখ মনীষীর পরিচয় ঘটে। ড. নিকলসনই পরে ইকবালের ‘আসরার-ই খুদী’ নামক গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেন। ১৯০৮ সালে স্বদেশে ফিরে এসে পুনরায় অধ্যাপনার কাজে রত হন এবং লাহোর হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি শুরু করেন।

রাজনীতিতে আগমন
১৯১১ সালে পাক-ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এদেশের মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থা দর্শনে দরদী ইকবালের হৃদয় ব্যথিত হয়ে ওঠে এবং বছর তিনেক পর চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন।

কাউন্সিলে আল্লামা ইকবাল
১৯২৬ সালে লাহোর হতে ইকবাল পাঞ্জাব লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। আইন পরিষদে তিনি কৃষক ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনেক কোশেশ করেন। তবে রাজনৈতিক চাল-চালিয়াতি এবং ধাপ্পাবাজী আল্লামার ধাতে ছিল না। পরবর্তী নির্বাচনের সময় তিনি আর প্রার্থী হতে রাজী হননি। তিনি বলেন-‘ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধনের জন্যই অনেকে কাউন্সিলে যান। ব্যক্তিগত স্বার্থের বালাই আমার নেই।’

বক্তৃতা
১৯২৭ সালের ৫ মার্চ পাঞ্জাব আইন সভায় ১৯২৭-২৮ সালের বাজেট উপলক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। ১৯২৮ সালে ২৩ ফেব্র“য়ারি ভূমি রাজস্বের উপর আয়কর উসূল করার প্রস্তাবের উপর পাঞ্চাব আইন সভায় ভাষণ, ১০ মার্চ সরকারের শিক্ষাবিভাগের বাজেট হ্রাসের সমালোচনা করে, ৯ নভেম্বর আইন কমিশনের সমালোচনা করে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভাষণ দান করেন। আল্লামা ইকবালকে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়। তিনি ছয়টি বক্তৃতা দেন। তাছাড়া বাঙালোর হায়দারাবাদ এবং আলীগড়ে তিনি বক্তৃতা দিতে আহুত হন। তখনই বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যায়। পরবর্তীতে এ সমস্ত বক্তৃতাই ‘ঞযব জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ জবষরমরড়ঁং ঃযড়ঁমযঃ রহ ওংষধস.’ পুস্তকে প্রকাশিত হয়।

বিভিন্ন সংস্থা ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দান
১৯১১ সালে পাঞ্জাব প্রিভেন্সিয়াল এডুকেশন কনফারেন্স এর সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯০৮ সালে অল ইন্ডিয়া লীগের ব্রিটিশ কমিটির কর্মপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ১৯৩০ সালে। লীগের বার্ষিক অধিবেশনে এলাহাবাদে তিনি যে অভিভাষণ পাঠ করেন তাতে ভারতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি পেশ করেন। এই দাবিই মূলত পাকিস্তান আন্দোলনের বিসমিল্লাহ। ১৯২০ সালে আঞ্জুমানে হেমায়াতে ইসলামের জেনারেল সেক্রেটারি এবং ১৯৩২ সালে আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলামের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন আল্লামা ইকবাল।

সাহিত্য কর্মের শুভ সূচনা
আল্লামা ইকবারের সাহিত্যকর্মের শুভ সূচনা সম্পর্কে অধ্যাপিকা নূরজাহান বেগম তাঁর ‘কবি ইকবালকে যতটুকু জেনেছি’ পুস্তকে উল্লেখ করেন ‘ওস্তাদ সৈয়দ মীর হাসানের কাছে মৌলানা জালালুদ্দীন রুমীর ফারসি কবিতা শুনে শুনে ছেলেবেলা থেকেই ইকবালের কাব্যে আসক্তি জন্মে। এর উপর পিতার সুমধুর কণ্ঠে রুমীর মসনবী পাঠ শুনে তাঁর বালক হৃদয়ে যে অপূর্ব উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল, তারই ফসল স্বরূপ শিয়ালকোটে অবস্থানকালেই তিনি দু’একটি কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন। শিয়ালকোটের কাব্য চর্চার সেই প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলার পূর্ণ সুযোগ তিনি লাভ করলেন লাহোর আসার পরে। ১৮৯৫ সালে লাহোর আসার পর উক্ত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইকবালের মনের অঙ্কুরিত কাব্য ধারাও উন্মেষ লাভ করতে থাকে।’ ১৮৯৫ সালে লাহোরের আঞ্জুমানে হিমায়েতে ইসলামের বার্ষিক সভায় ‘নালায়ে এতিম’ বা এতিমের কান্না কবিতাটি পাঠ করে সাধারণ মানুষের সামনে আত্মপ্রকাশ করেন।

ইকবাল রচনাবলী
মহাকবি ইকবালের সৃজনশীল রচনাবলী তিনটি ভাষায় লিখিত। ১. উর্দু, ২. ফার্সি, ৩. ইংরেজি।
উর্দুতে : ইলমুল ইকতিছাদ, বাঙ্গেদারা, বালে জিব্রাঈল (১৯৩৫ ইং), জরবে কালীম (১৯৩৬ ইং), শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া (১৯২৪ ইং),
ফার্সিতে : আসরার-ই-খুদী (১৯১৪ ইং), রমুযে বেখুদী (১৯১৮ ইং), পয়ামে মাশরিক (১৯২৩ ইং), গুলশানে রাজ-ই-জাদীদ, যবুরে আজম (১৯২৭ ইং), জাভিদনীমা (১৯৩২ ইং), বন্দেগীনামা, মসনবীয়ে মুসাফির (১৯৩২ ইং), আয় আকওয়ামে শরক ও আরমুগানে হিযায।
ইংরেজিতে : দি ডেভেলাপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন ফার্সিয়া, দি রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়ার্স থট ইন ইসলাম, এ সোসিওলজিক্যাল সার্ভে অব দি মুসলিম নেশন ও দি ইসলামিক ক্যালিফেট ইত্যাদি।
এছাড়া আল্লামা ইকবারের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা চিঠি-পত্র পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *