জ্ঞানের দুয়ার হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এমন এক ব্যক্তি যার জন্ম হয় পবিত্র কা’বা শরীফের ভেতরে, সম্পূর্ণ পুত-পবিত্র অবস্থায়। তাঁর মা তাঁকে জন্মের পর রাহমাতুল্লিল আলামীনের মোবারক হাতে সর্ব প্রথম তুলে দেন! তিনিই সেই সৌভাগ্যবান প্রথম বালক যিনি খুব অল্প বয়সে (দশ বছর) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। তার ওপর আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ ছিল, কারণ প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার আগ থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংস্পর্শে তিনি বড় হচ্ছিলেন। আল্লাহর রাসূল এর সোহবাতের প্রভাবে তিনি এতোই প্রভাবিত হয়েছিলেন, যে জ্ঞানের (ইলমের) প্রতিটা শাখা-প্রশাখা (প্রকাশ্য/অপ্রকাশ্য) তথা শরিয়ত, মারিফাত, হাকিকাতের মধ্যে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুই সার্বোচ্চ ইলমের অধিকারী হতে পেরেছিলেন! তাইতো সাইয়্যিদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন, “আনা মাদিনাতুল ইলমে ওয়া আলীয়্যুন বাবুহা” অর্থাৎ আমি জ্ঞানের শহর আর আলী তার প্রবেশ দ্বার। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
শুধু কি তাই? ইসলামের প্রথম যুদ্ধে (বদর যুদ্ধে) বিশেষ বীরত্বের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জুলফিকার নামক তরবারি উপহার দিয়েছিলেন। খাইবারের সুরক্ষিত কামূস দুর্গ জয় করলে আল্লাহর হাবীব তাঁকে “আসাদুল্লাহ” বা আল্লাহর সিংহ উপাধি দেন। এমনকি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদরের কন্যা, জান্নাতী নারীদের সর্দার হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার সাথে তাঁকে শাদী দেন। অসংখ্য হাদিসে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর শান ও মান সম্পর্কে আল্লাহর হাবীব বলেছেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হযরত হারুন আলাইহিস সালাম যেমন মুসা আলাইহিস সালামের ভাই, আলী আমার তেমন ভাই।
(আল্লাহর হাবীব অন্যত্র বলেন) নিশ্চয় আলী আমার হতে এবং আমি আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে। আমার পরে সে-ই হবে সমস্ত মুমিনের সঙ্গী ও পৃষ্ঠপোষক। (তিরমিযী, আপ্র-৩৭১২)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি যার (মাওলা) পৃষ্ঠপোষক, আলীও তার (মাওলা) পৃষ্ঠপোষক। (তিরমিযী, আপ্র-৩৭১৩)।
অন্য হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেনঃ তুমি আমা হতে, আর আমিও তোমা হতে। (তিরমিযী, আপ্র-৩৭১৬)।
হাদিস শরীফের মাধ্যমে একথাই প্রমাণিত হয়, দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের কাছে তার বড় ভাই হারুন আলাইহিস সালামকে আল্লাহ যেমন কবুল করেছিলেন, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকেও আল্লাহর হাবীবের জন্য সেভাবেই কবুল করেছিলেন। তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু শেষ নবী (খাতামুন্নাবী), তাই তাঁর পরবর্তীতে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ কারোরই নবী হওয়ার সুযোগ নেই। তবে ইলমের দরজা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে কোরআনুল কারিম উঠে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খোলা থাকবে।
হাশেমী বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কা’বা শরীফের ভেতরে জন্ম হওয়ার সুবাদে ইবলিশ শয়তানের যাবতীয় কু-দৃষ্টি হতে মুক্ত থেকে দুনিয়ায় আগমন করেন, তাকে কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু অর্থাৎ সম্মানিত চেহারা বা মুখমণ্ডলের অধিকারী বলা হয়। এই উপাধি লাভের হেতু, তিনি জীবনে কখনও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করেননি। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহর হাবীব যেমনই বিশ্বাস করতেন ঠিক তেমনি ভালোবাসতেন। বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসার অন্যতম একটি উদাহরণ হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের ঘটনা। হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর নামের সাথে ইতিহাসের পাতায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নামও স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে! আল্লাহর হাবীব হিজরতের পূর্বে কাফেরদের আমানত হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, তুমি আমার বিছানায় আমার চাদর মুড়ে শুয়ে থাকবে। সকাল বেলা প্রত্যেকের আমানত যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিয়ে তারপর মদিনা মুনাওয়ারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। আল্লাহর হাবীব এই কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন তিনি গৃহবন্দী ছিলেন এবং চারদিক থেকে খোলা তরবারি নিয়ে কাফেররা উন্মাদের মত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় ছিলো। আল্লাহর হাবীব তাদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তুু তারা কিছুই বুঝতে পারল না। আল্লাহর হাবীবের এই অভয় বাণী শুনে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ভালো করেই বুঝতে পারলেন কাফেররা আল্লাহর হাবীবের একটি চুলও স্পর্শ করতে পারবে না, এবং তাকেও বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে সক্ষম হবে না! জ্ঞানের দুয়ার হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর চর্মচক্ষু এবং অন্তরচক্ষু এতটাই প্রসারিত ছিলো যে, আল্লাহর হাবীবের বিছানায় তার মোবারক চাদর জড়িয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকলেন। পরবর্তীতে যখন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করা হয় আপনি কি ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেননা? জবাবে তিনি বললেন, আমার জীবনের সবচাইতে আরামদায়ক ঘুম ছিলো হিজরতের রাতের ঘুম। কেননা আল্লাহর হাবীব যখন আমাকে বলেছিলেন, কাফেরদের আমানত বুঝিয়ে দিয়ে তুমি মদিনায় চলে আসবে, তখনই আমি বুঝে ছিলাম পৃথিবীর সমস্ত কাফের একত্রিত হয়েও আমার কিছুই করতে পারবেনা, তাই আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাই।


আল্লাহর হাবীবের জীবনের প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাথে কোন না কোন ভাবে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সংশ্লিষ্টতা ছিলো, ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধি ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধি, সেই সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু সেদিন সন্ধিতে আল্লাহর হাবীবকে ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লিখার কারণে, কাফেররা তীব্র বিরোধিতা করে বলতে লাগল, আমরা যদি মুহাম্মদকে রাসুল বলে মেনে নেই তাহলে তো সন্ধির প্রয়োজনই পড়ে না। আল্লাহর হাবীব বললেন তাহলে তোমরা কি লিখতে চাও? তারা বলল মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, আলী তুমি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ কেটে দাও। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আপনার জন্য জীবন কুরবান করতে পারি কিন্তু এই কাজটি করতে পারবো না, যেহেতু আপনাকে আল্লাহর রাসুল বলে স্বীকৃতি দিয়ে ঈমান এনেছি তাই আমার এই হাত দিয়ে ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ নাম কখনো কাটতে পারবে না! সেদিন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঈমানী দৃঢ়তা দেখে শত শত সাহাবীরা জীবন বাজি রেখে শপথ নিয়েছিলেন ‘আমরা শহিদ হব তবু কাফেরদের এই অন্যায় দাবি জীবন থাকতে মেনে নেবো না’। আল্লাহর হাবীব নিজের হাতে রাসুলুল্লাহ শব্দটি মুছে দিলেন এবং মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ লিখলেন। শুধুমাত্র এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর হৃদয়ে আল্লাহর হাবীবের আসন কতো উঁচু ছিল! আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঈমানের পরীক্ষা এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোরবানীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সেদিন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আয়াত নাজিল করলেন, ‘ইন্না ফাতাহ্-না লাকা ফাতহাম্মুবিনা’।
আল্লাহর হাবীব হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের সবচেয়ে প্রিয়ব্যক্তি বলে ঘোষণা করলেন। খায়বরের যুদ্ধে মুসলমানগণ প্রাণ-পণ যুদ্ধ করেও প্রতিপক্ষের কামুস দূর্গ দখল করতে পারছিলো না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন, আগামীকাল যুদ্ধের ঝাণ্ডা তাঁর হাতে তুলে দেয়া হবে যিনি আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সে বিষয়টি জানার জন্য বিচলিত হয়ে পড়লেন। পরবর্তিতে একদিন বলেছিলেন, আমি সারারাত ঘুমাতে পরিনি এই কৌতুহলের জন্য যে, কে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি? পরের দিন আল্লাহর হাবীব যুদ্ধের ঝাণ্ডা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে তুলে দেন (সুবহানাল্লাহ)। ধৈর্যের পরীক্ষায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা ইতিহাসে অনন্য! কোন এক যুদ্ধে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এক কাফেরের বুকের উপর বসে তার শিরোচ্ছেদ করার পূর্ব মুহুর্তে কাফেরটি তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে থুথু নিক্ষেপ করে। সাথে সাথে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে ছেড়ে দেন। লোকটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে কি ব্যাপার তুমি আমাকে ছেড়ে দিলে কেন? উত্তরে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি আল্লাহর দুশমন, আমি আল্লাহর সন্তুুষ্টির জন্য তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তুু যখন তুমি আমার মুখে থুথু ছুঁড়লে তখন তোমার প্রতি আমার ব্যক্তিগত ক্রোধ চলে আসে। ওই অবস্থায় আমি যদি তোমাকে হত্যা করতাম, তাহলে কেয়ামতের ময়দানে আমাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতো, (সাহাবা চরিত)। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইলমের গভীরতা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামগণ সর্বাধিক অবগত ছিলেন, আল্লাহর হাবীব যে সাহাবী সম্পর্কে বলেছিলেন, আমার পরে কেউ নবী হবে না, যদি হতো তবে হযরত ওমর হতেন। সেই ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তিনি সমগ্র ইসলামী খিলাফতের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। কারণ ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জানতেন উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে প্রজ্ঞা ও মেধায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুই সার্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী। তাই তো একদিন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর শাসনামলে কোন এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলেছিলেন : ‘লাও-লা আলীউন লাহালাকা ওমার’ অর্থাৎ আজ যদি আলী না থাকত তাহলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত।
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইলমের বিশালতা কতো সমৃদ্ধ ছিল সেটা বর্ণনা করা কঠিন! আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রকৃত মহব্বত ও সম্মানের আসনে একমাত্র আহলে ইলমরাই রাখবে, যাদের অন্তরে নিফাক্বে ভরপুর তারা কখনো তাকে মূল্যায়ন করতে পারবেনা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, একমাত্র মুনাফিকরাই আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ভালবাসে না। আর মুমিনগণ তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। (তিরমিযী, আপ্র-৩৭১৭)।

তথ্যসূত্র
১. ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ ৮ম খণ্ড (ইফা প্রকাশনী)।
২. কানযুল মাতালিব ফি মানাক্বিবে আলী ইবন আবী তালিব, ডক্টর তাহিরুল ক্বাদরি।
৩. হুব্বে আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু, শাইখুল ইসলাম তাহিরুল ক্বাদরি।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *