প্রিয়তমা

(পূর্ব প্রকাশের পর)
-কি শুরু করেছিস লামিয়া। আমরা পরশু চলে যাবো।
-আমার ভালো লাগছেনা আম্মু।
-তোর কোথায় ভালো লাগে বলতো? সবসময় বাসা ছাড়া তোর কোথাও ভালো লাগে নাকি।
-আম্মু প্লিজ।
-সরবি এখান থেকে। ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, বুঝাও একটু তোমার আদরের মেয়েকে।
-বাবা বলে উঠলো, কি হয়েছে আমার মেয়ের?
-বাসায় যাওয়ার জন্য জিদ ধরে বসে আছে।
-কি হয়েছে আব্বুকে বলো মা?
-আব্বু ওখানে আমার ভালো লাগেনা।
-কেন?
-ওখানে পিয়াস ভাইয়ার বন্ধু ছাড়া আরো অনেক ছেলেরা আছে আমার অস্বস্তি লাগছে।
-কিন্তু বাসায়ও তোমার একা থাকা ঠিক হবে না মা। আর লাবিব আজ এখানে থাকবে। একটু কষ্ট করে থাকো। তোমার আম্মু তো আছে।
-ফারিহা বললো, আব্বু তোমার ছোট মেয়ের ঢং দেখে বাঁচিনা যত্তসব! মনে হয় ও একলা পর্দা করে দুনিয়াতে আর কোন মানুষ নাই।
-উনি ফারিহাকে ধমকে উঠে, তুমি চুপ থাকো। সবাইকে নিজের মত ভেবো না। ও তোর তোমার মতো না।
লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো মা আমার কথা শুনো।
-লামিয়া আচ্ছা আব্বু
পরদিন সবাই পলির শশুররবাড়ি গিয়েছে। লামিয়া ওর আম্মু আর খালামণি ছাড়া। সন্ধ্যার সময় সবাই ফিরে আসাতে বাড়ি আবার সরগরম হয়ে উঠেছে। নতুন বর বউ কে আনা হয়েছে। জামাই বরণসহ কত কি হাবিজাবি রীতিনীতি পালন করার পর বাড়িটা শান্ত হলো। তারপর জামাই আদর তো চলছে তোড়জোড়ে। পলির চাচাতো ফুফাতো বোনরা নতুন দুলাভাইয়ের সাথে সেইকি আড্ডা জুড়িয়ে দিয়েছে। কি অসভ্য মেয়েগুলা অন্যের জামাইয়ের সাথে এতো কিসের গাঁ ঘেষাঘেষি অসহ্য!
আর এদিকে পলি আসার পর থেকে লামিয়ার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। শশুড়বাড়ি কে কি দিলো, কি কি করেছে ওকে নিয়ে যাওয়ার পর। লামিয়ার এই মুহূর্তে ভালো লাগছে না এসব শুনতে। তাই পলিকে বললো, কিরে তুই নতুন জামাই রেখে আমার সাথে গল্প করছিস। এখন তোর উচিত তোর বরের পাশাপাশি থাকা। তা না তুই এখানে বসে আছিস যা বরকে গিয়ে সময় দে।
এমনিতে লামিয়ার মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। পিয়াস ভাইয়ার দুইটা বন্ধু কাল থেকে ওকে একরকম বলতে গেলে মানসিক টর্চার করে যাচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে একটু নিরিবিলিতে বসার কোন একটা জায়গা নাই। তার উপর চ্যাঁচড়া দুইটা পিছনে লেগেই আছে। কি একটা অভদ্রতা। যেখানে যাচ্ছে সেখানে ওরা। কাউকে কিছু বলতে ও পারছে না সইতেও পারছে না । কেলেংকারী ঘটে যাবে কাউকে বললে কিনা কি বুঝে বসে থাকে। উল্টা ঝামেলা হবে। তাই সকাল হওয়ার অপেক্ষায় আছে ও। সকালে আম্মু না গেলে ও চলে যাবে।
পরদিন সকালে লামিয়া খালামণিকে বুঝিয়ে বাসায় চলে আসলো ওর ভাইয়ের সাথে।
আজ একমাস ধরে ফারিহাকে নিয়ে ওর পরিবারের লোকেরা অনেক বিপাকে আছে। মেয়েটা কোন ভাবেই আর ওর জামাইয়ের কাছে ফিরবে না। প্রয়োজনে রাহাতকে ও ডিভোর্স দিবে তারপরও যাবে না। অনেক ঝামেলা চলছে দুজনের মাঝে। ওর মা বাবা ওকে অনেক জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারেনি। বাবা মা ওর চিন্তায় অস্থির। লামিয়া উনাদের আশ্বস্ত করলো যে ও বোনকে বুঝাবে এটা নিয়ে যেন উনারা চিন্তা না করে।
ফারিহা বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো এই মুহুর্তে লামিয়া দরজায় নক করলো আপু ভিতরে আসবো?
-আয়
-তুই কি কোথাও যাচ্ছিস?
-হুম সোমার বার্থডে পার্টি আছে আজ ওখানে যাচ্ছি। তুই কি কিছু বলবি?
-হুম তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
-এখন সময় নাইরে। রাতে ফিরলে বলিস।
-আচ্ছা
ফারিহা বেরিয়ে গেলো। লামিয়া এই মুহুর্তে ওকে বাহিরে বেরুতে নিষেধ করতে পারতো কিন্তু করেনি। কারণ ফারিহা রেগে গেলে মূল কথাগুলো আর বলা হতো না। তাই আস্তে ধীরে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হবে। এভাবে হুটহাট করে তো সম্পর্ক করা যায় না আবার ভাঙ্গা ও যায় না।
ফারিহা ফিরলো রাত এগারোটায়। তাই তখনোও কিছু বলেনি। সকালে ফারিহা উঠার আগেই লামিয়া বোনের রুমে গিয়ে বসে রইলো। আজ যে করেই হোক বলতে হবে। যত দেরি হবে ততই সমস্যা বাড়বে।
ফারিহা চোখ খুলে ছোট বোনকে দেখে বললো, তুই এতো সকালে আমার রুমে কেন?
-আপু তুই বোধহয় ভুলে গেছিস আমি তোকে বলেছি তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
-ও সরি, সরি, ভুলেই গেছিরে। বল কি বলবি?
-আগে ফ্রেশ হয়ে নে।
-ফারিহা ফ্রেশ হয়ে এসে বল কি বলবি?
-তুই রাহাত ভাইয়ার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস? তুই কি ও বাড়িতে আর ফিরে যাবিনা?
-ওই বেয়াদবটার সাথে সংসার করার প্রশ্নই আসে না। আমার কথার কোন দাম নেই ওর কাছে। মা বাবা বলতে বলতে জানোয়ারের বাচ্চাটা পাগল হয়ে আছে। অসভ্য লোক একটা!
-আপু সংযত ভাষায় কথা বল। উনি এখনো তোর হাজব্রেন্ড। কতবড় পাপ করে ফেলেছিস কথা গুলো বলে জানিস?
-হাজব্রেন্ড তো কি হয়েছে? তাকে কি আমার মাথায় তুলে নাছতে হবে? যাতো জ্ঞান দিবি না আমাকে।
-লামিয়া এবার বোনকে জড়িয়ে ধরে আপু প্লিজ তুই ঠান্ডা মাথায় আমার কথাগুলো শুন প্লিজ আপু। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি আপু। তাই তোর কোন ক্ষতি আমি চাই না
-ফারিহা নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বললো, হুম বল।
-দেখ আপু আমাকে তোর ছোটবোন না বন্ধু হিসাবে জেনে কথাগুলো শুনবি? আপু সম্পর্ক কোন ঠুনকো জিনিস নয় যে চাইলে ভেঙ্গে ফেলবি। একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিস। রাগের মাথায় এতবড় সিদ্ধান্তটা নিস না।
-ভাবাভাবির কিছু নেই আমি ওর সাথে থাকতে পারবো না।
-আপু প্লিজ মাথা গরম করিস না। তুই জানিস আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল কাজটা কি? ডিভোর্স বা তালাক। আমাদের সমাজে ডির্ভোসী নারীকে কেউ ভালো চোখে দেখে না। প্রতি পদে তোকে অপদস্ত হতে হবে। বিয়ে নামক সম্পর্কটা এমন একটা সম্পর্ক যা একবার ভেঙ্গে গেলে চাইলে তুই আবার জোড়া লাগাতে পারবি না।
তোদের এতো ভালোবাসা ছিল আজ কেন একজনের প্রতি আরেকজনের এতো বিরস ভাব? তিক্ততায় ভরে গেছে তোদের সম্পর্কে। কারণ কি জানিস? কারণ ভালোবাসার প্রধান এবং প্রথম দুটি শর্ত সম্মান এবং বিশ্বাস।
তোরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করিস না, সম্মান দিতে জানিস না। একজনের প্রতি আরেকজনের শ্রদ্ধাবোধ নেই তোদের। তোরা আজো একজনকে ভালোবাসিস কিন্তু নিজেদের জন্য তা প্রকাশ করতে পারিস না।
ভাইয়াকে যতটা জানি ও তোর মতো এতো বেশি আধুনিক মন মাইন্ডের না। কিছু মনে করিস না আপু তুই একটু বেশি উশৃঙ্খল।
-ফারিহা কান্না কন্ঠে বললো, তুই আমার বোন হয়ে এরকম দোষারোপ করছিস আমাকে?
ও ওর বাবা মার কথায় উঠবস করে সবসময়। বিয়ের আগে এই করবো সেই করবো বলে কত কি বলেছে। আর এখন আমার দাম নাই। রাহাত আমাকে একটু ও ভালোবাসে না। বাবা মাই সব।
-লামিয়া মুচকি হেসে বললো, কে বলেছে ভালোবাসে না আসলে তোর হিংসে হচ্ছে ও কেন তোর কথায় চলে না তার জন্য। দেখ তোর হাজবেন্ড হওয়ার পরও ভাইয়া তাদের ছেলে। বাবা মায়ের জন্য ভালোবাসা আর স্ত্রীকে ভালোবাসা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। তুই তোর জায়গা উনারা উনাদের জায়গায়। বেচারা কি করবে বলতো একদিকে বাবা মা যারা তাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে । আর অন্যদিকে তুই যে উনার সারাজীবনের চলার পথের সঙ্গী। তার পক্ষে কাউকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়।
-কিন্তু ও কি বিয়ের পর থেকে কখনো আমাকে সময় দিয়েছে । কখনো বুঝতে চেয়েছে আমি কি চাই?
-তুই বুঝতে চেয়েছিস কখনো তাকে? সারাদিন তোর কাটে বাহিরে বাহিরে। সে পুরুষ মানুষ সারাদিন অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে। ঘরে এসে যদি স্ত্রীর হাসিমাখা মুখ না দেখতে পায় তাহলে তার মনে শান্তি থাকে। তুই উনি বাসায় ফিরতে না ফিরতে তার কাছে তার বাবা মায়ের নামে অভিযোগ শুরু করে দিস তখন কার ভালো লাগে।
সে ফিরেছে আগে তার সাথে একটু হাসিমুখে কথা বলবি পরে আস্তে ধীরে সব বুঝিয়ে বলবি। আপু তোর উগ্র মেজাজ সেটা তুই ভালো করে জানিস আমি আর কি বলবো। শালীনতা তোর মাঝে নাই বললেই চলে
তুই যেভাবে মর্ডান ড্রেস পরে চলাফেরা করিস এটা সবার চোখেই লাগবে। বাড়ির বউ যদি রাস্তার মেয়েদের মত করে চলাফেরা করে তখন কেউ সহ্য করবে না। তুই কালও রাত করে ফিরেছিস এভাবে প্রায় প্রতিদিন তুই ফিরিস। এটা তোর বাবার বাড়ি তাই কেউ কিছু বলেনা। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওটা তোর শশুরবাড়ি। শুন মাঝে মাঝে পরের স্বার্থে নিজেকে পরিবর্তন করতে হয়। হয়তো তুই তার মত হবি নয়তো তাকে তোর মত গড়ে নিবি। কিন্তু তোর চলার পথ সঠিক নয় তাই ভাইয়া তোর মত হতে পারেনি। তাই তোকে উনার মনের মত হতে হবে, তবেই শান্তির দেখা পাবি নয়তো না।

  • ফারিহা সুর কিছুটা নরম করে অভিযোগের মত করে বললো, আমি মেয়ে বলে কি আমার কোন স্বাধীনতা থাকবে না।
    আর শুধু কি আমি, রাহাত ও তো রাত করে ফিরে।
    -কেন স্বাধীনতা থাকবে না তোর। প্রতিটা নারী স্বাধীনতা চায়। তুই বাদ থাকবি কেন?
    দেখ আপু আমি ও নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি কিন্তু নির্লজ্জতা পছন্দ করি না। আপু স্বাধীনতা মানে আসন বদল নয় যার যার জায়গা থেকে নিজ নিজ কর্তব্য সম্পন্ন করতে হয় ওটাই স্বাধীনতা।
    আর একটা কথা কোন ঘরে নারী যদি মহা নারী হতে চায় সে সংসারে মহামারী ছড়াবে আর পুরুষ যদি মহা পুরুষ হতে চায় তাহলে সে কাপুরুষ হয়ে দাঁড়াবে। একজনের প্রতি আরেকজনের সম্মান থাকা চাই, বিশ্বাস থাকা চাই।
    তোর শশুরশাশুড়ির একমাত্র সন্তান ভাইয়া। বউয়ের কথায় ছেলে যদি তাদের ছেড়ে যায় তাহলে তাদের কতটা কষ্ট হবে বুঝতে পারিস।
    আমাদের কথা ভাব, আমাদের ভাই বিয়ের পর তার বউয়ের কথায় আমাদের মা-বাবা কে ছেড়ে আলাদা হয়ে যায় কেমন লাগবে?
    আপু ভালোবাসার শক্তি অনেক। তোর শশুর শাশুড়ি যদি তোর সাথে খারাপ আচরণ ও করে তুই তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করবি। তাদের শশুর শাশুড়ি নয় নিজের বাবা মা মনে করে সম্মান করবি, ভালোবাসবি। একদিন তাদের চোখে হয়ে উঠবি পৃথিবীর সেরা বউমা।
    ভাইয়ার প্রতি আলাদা টেক কেয়ার করবি। পুরুষ মানুষ ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসার টানে সে তোর কাছে আসবেই। স্বামীর কাছে একজন আদর্শ জীবন সঙ্গিনী পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। স্বামির চোখে পৃথিবীর সেরা নারী হবি তুই।
    -ফারিহা এতক্ষণ নিরবে কাঁদছিলো এ পর্যায়ে বললো, এখন আমি কি করবো তুই বল আমাকে? তুই যা বলবি আমি তাই করবো। ও কি আমাকে ফিরিয়ে নিবে? মা বাবা কি ক্ষমা করবে?
    -কেন নিবে না? না নিলে জোর করে আদায় করে নিবি নিজের অধিকার। আর তাছাড়া উনি হয়তো একটু রাগ করেছে। সে তোকে এখনো ভালোবাসে। তোর ভালোবাসা তার কাছে প্রকাশ করলে দেখবি তার রাগের বরফ গলে পানি হয়ে গেছে।
    আর আঙ্কেল আন্টি রাগ দেখালে পা ধরে মাপ চাইবি। আপন মানুষের কাছে মাথা নত হলে লজ্জা নেই।
    তুই ফিরে যা আপু। নিজেকে একটু পরিবর্তন কর। ওটা তোর নিজের সংসার। ওটাই তোর বাড়ি। এটা আমাদের বাবার বাড়ি। বাবার বাড়িতে মেয়েরা অতিথি হয়েই থাকে। আর স্বামীর বাড়ি আমাদের নিজের বাড়ি।
    জীবনকে ইসলামের আলোয় রাঙিয়ে তুলার চেষ্টা কর। কেননা একমাত্র ইসলামই তার অনুসারীদেরকে ভদ্রতা, বিনয়, শালীনতাও যুক্তিবাধীতার শিক্ষা দেয়। হীনতা ও দীনতার শিক্ষা ইসলাম দেয় না। আমি জানি তুই শয়তানের প্ররোচনায় পড়েছিস। শয়তান প্রতি পদে আমাদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টায় থাকে। তুই যখন ইসলামকে আঁকড়ে ধরবি কোরআনের শিক্ষায় নিজেকে আলোকিত করবি শয়তান তোকে ধোঁকা দিতে পারবে না।
    আমি জানি পারবি তুই। কথা দে আমার কথাগুলো ভেবে আরেকবার নিজেকে সুযোগ দিবি।
    -ফারিহা বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো ইনশাআল্লাহ! পারবো আমাকে পারতেই হবে! পারতেই হবে। অকারণে তোর উপর রাগ দেখাতাম বকাঝকা করতাম কখনো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করিস নি। তুই আজ আমার চোখের কালো পর্দা সরিয়ে দিয়েছিস। সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিস।
    আল্লাহ তোকে ভালো রাখুক এতোটুকু দুঃখ যাতে তোকে না ছোঁয় সব সময় আল্লাহর কাছে চাইবো। তোর ঋণ কি দিয়ে শোধ করবো?
    -আরে আপু ছাড়! ছাড়! দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো তো। তখন আর ঋণ শোধ করতে পারবি না। বাব্বাহ এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে!
    দুবোন একসাথে হেসে উঠলো।
    নাস্তা শেষ করে ফারিহা রেডি হতে শুরু করলো ও ফিরে যাবে আজ নিজের ঠিকানায়। আজ থেকে হয়ে যাবে অন্য এক ফারিহা। লামিয়া বললো, আপু বাবাকে দিয়ে ভাইয়াকে ফোন করে বাসায় আনি। আমার মনে হয় ভাইয়ার সাথে ও ব্যাপারটা আলোচনা করা দরকার। তারপর না হয় উনার সাথে তুই যাবি?
    -নারে আমার জন্য আর কাউকে অপদস্থ হতে হবে না। আমি নিজেই সব মিটিয়ে নিবো। সমস্যা যখন আমিই সৃষ্টি করেছি সেটার সমাধানও আমি করবো।
    -আপু আমার কথায় তুই কষ্ট পেয়েছিস তাই না?
    -নারে পাগলি। তোর উপর আমার একটুও রাগ নেই। প্রতিটি মানুষের জীবনে একজন মানুষ থাকে তাকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার সেই টার্নিং পয়েন্টটা তুই। দেখিস তুই অনেক ভালো থাকবি।
    -লামিয়া একটা বোরকা এগিয়ে দিয়ে বললো আপু আজ থেকে শুরু কর জীবনের নতুন অধ্যায়।
    -ফারিহা বললো, ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ আমাকে কবুল করুন।
    ফারিহা বাবা মায়ের রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে বললো, আব্বু ভেতরে আসবো?
    ওর বাবা মা দুজনে অবাক!
    ওর আব্বু চোখে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো, এ কাকে দেখছি আমি! কোন স্বপ্ন দেখছি নাতো আমি?
    লামিয়া বলে উঠলো, না আব্বু স্বপ্ন নয় সামনে যা দেখছো পুরোটাই সত্যি। তোমার সামনে তোমার বড় রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। নিজের সংসারে ফিরে যাচ্ছে দোয়া করে দাও।
    আব্বু বলে উঠলো, আলহামদুলিল্লাহ।
    -ফারিহা বললো, আব্বু দোয়া করো আমার জন্য। আর পারলে ক্ষমা করে দিও এই অভাগা মেয়েটাকে।
    -আব্বু কান্না মাখা স্বরে বলে উঠলো, আমার মা তার ভুল বুঝতে পেরেছে এর চেয়ে বেশি আনন্দ আমার আর কিছুতে নেই। আল্লাহর রহমতের ছায়া আমার মেয়ের উপর পড়েছে। আল্লাহ তাকে হেদায়েতের আলো দান করেছে। এর বেশি খুশি আমি কখনো হইনি। ভালো থাকিস মা।
    -মা বললো, মাশাআল্লাহ্! কত সুন্দর লাগছেরে তোকে হিজাবে আবৃত অবস্থায়। ভালো থাকিস। ওদের কথামতো চলার চেষ্টা করিস। স্বামীর মনে কষ্ট দিস না। শশুরশাশুড়ির যতœ নিস তাহলে আমরা ও ভালো থাকবো।
    -আব্বু বললো, তুই কি একা যেতে যাচ্ছিস মা।
    -হ্যা আব্বু।
    -কিন্তু একা যাওয়া ঠিক হবে না তোর। দাঁড়া আমি নিয়ে যাবো।
    -না আব্বু আমি একা যাবো। ও বাড়ির পরিবেশ এখন কি অবস্থায় আছে আমার জানা নাই। তোমাকে কোন কারণে অপমানিত হতে হলে আমি তা মেনে নিতে পারবো না।
    -তাহলে তোর ভাইয়া তোকে নিয়ে যাবে। লাবিব তোকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে।
    -আচ্ছা।
    লাবিব এসে ফারিহাকে দেখে বলে উঠলো, মাশাআল্লাহ্!! অবশেষে আমার বোনটার বোধোদয় তো হলো।
    ফারিহা বিদায় নিয়ে চলে যেতেই বাবা মা দুজন লামিয়াকে জিজ্ঞেস করলো মা এতোবড় অসম্ভব সম্ভব করলি কি করে?
    লামিয়া বললো, আব্বু অসম্ভব বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। আমাদের অন্তরের মধ্য থেকে মিথ্যা আর ভুলের কালো পর্দাটা সরিয়ে নিলেই ভালো মানুষটা বেরিয়ে আসবে বলেই নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
    আজ লামিয়ার জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে। ছেলে দেখতেও মোটামুটি ভালো। তবে একটু ওভার স্মার্ট দেখেই বুঝেছে লাবিব। অনেক অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। ঢাকায় দু তিনটা বাড়ি আছে। ছেলের পরিবারে আর মনে হয় কেউ বাকি নেই আসতে। একেবারে পুরুষ মহিলা মিলে ১৫ জনের মত হবে। হুট করেই উনারা কার থেকে খবর পেয়ে এসেছে। তবুও যথাসম্ভব সমাদরের ব্যবস্থা করা হলো।
    লামিয়া তার মাকে ভালো করে জানিয়ে দিয়েছে ও ছেলে ছাড়া আর কোন পুরুষের সামনে যাবে না। এদিকে নাস্তা শেষে ছেলের বোন পিড়াপীড়ি শুরু করলো মেয়েকে নিয়ে আসতে।
    লামিয়ার বাবা কিছুটা সংকোচ করে বললো, কিছু মনে করবেন না আসলে আমার মেয়ে কোন পরপুরুষের সাথে দেখা দেয় না। তাই আসতে চাচ্ছে না। শুধু ছেলে আর আপনারা মহিলারা থাকলেও আসবে।
    -ছেলের বোন এটা আবার কেমন কথা! সবার সামনে আসলে কি হবে?
    -আমার মেয়ে পরিপূর্ণ পর্দাশীল তাই।
    -ছেলের ভাবি কিছুটা টিটকারী করে বললো, আজকাল এ টাইপ মেয়ে আছে নাকি!
    -লাবিব কিছুটা রাগ নিয়ে বললো হ্যা আছে আমার বোন এই টাইপ। আমার বোন এখানে আসবে না। আপনারা চাইলে চলে যেতে পারেন।
    ওরা কিছুটা অপমান বোধ করলো। কিন্তু এত কষ্ট করে এসেছে যখন তখন দেখে যাওয়াটা ভালো। অগত্যা ছেলে ছাড়া অন্য পুরুষরা বেরিয়ে গেলো।
    লাবিব লামিয়াকে নিয়ে আসলো। লামিয়া ওড়না দিয়ে ভালো করে মাথা আর শরীর ঢেকে নিলো। কারণ বিয়ের জন্য ছেলেকে মুখ হাত পা শুধু দেখানো জায়েজ। ও সামনে এসে আস্তে করে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
    -ছেলের মা সালামের জবাব দিয়ে বললো বসো।
    লামিয়া বসতেই উনি প্রশ্ন করলেন কি নাম তোমার?
    -জী লামিয়া আহমেদ।
    -কিসে পড়?
    -অনার্স ১ম বর্ষে।
    -ছেলের বোন কিছুটা উৎসাহ নিয়ে বললো কি নিয়ে পড়ো?
    -জী ইসলামিক স্টাডিজ।
    -ছেলের ভাবি ভ্রু কুঁচকে বললো এটা কোন সাবজেক্ট নাকি! এটা দিয়ে তো ভবিষ্যতে কিছু করতেও পারবে না।
    -কয় ভাইবোন তোমরা?
    -দুই বোন এক ভাই।
    -তুমি কত নাম্বারভাই বোনের মাঝে?
    -সবার ছোট
    -সাংসারিক কাজ কিছু পারো?
    -জী পারি।
    -মা তোমার চুল গুলো একটু দেখাওতো।
    -লামিয়া এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো। অস্বস্তি নিয়ে বললো সরি আন্টি আমি আপনাদের সামনে আমার চুল খুলবো না। ওর এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে আরো কিছু কথা শুনাতে কিন্তু পারছে না।
    -ও আচ্ছা থাক না দেখাতে চাইলে। ভদ্রমহিলা উনার মেয়েকে ইশারায় বললো হাটিয়ে দেখাতে পায়ে কোন সমস্যা আছে কিনা?
    মেয়েটি উঠে লামিয়াকে উঠিয়ে হাটিয়ে আনলো।
    -লামিয়া বসতেই আবারো বললো, কোরআন পড়তে পারো?
    -জি।
    -আচ্ছা ছোট থেকে যেকোন একটা সূরা বলতো।
    লামিয়া সূরা শুনানোর পরে ছেলের মা ছেলেকে বললো তুই কি আলাদা করে কিছু কথা বলতে চাস?
    লামিয়া অনেকটা অসহায়ের দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালো। এবার পারলে ও কেঁদে দেয়। লাবিব এতোক্ষণ অনেক কষ্টে রাগ চেপে রেখেছিলো। সামনে বাবা বসে আছে তাই। ওরা কেউ ওর বাবার সামনে উচ্চবাচ্যে কথা বলেনা। কিন্তু এখন আর না এটা কি ধরনের মেয়ে দেখা।
    ছেলে কিছু বলার আগেই লাবিব বলে উঠলো ভাইয়া আপনি যা জিজ্ঞেস করার এখানেই করুন।
    ছেলের বোন বললো এটা আবার কেমন কথা ছেলে মেয়ে আলাদা কথা বলবে এতে বাঁধা কিসের। ওদের পছন্দ অপছন্দ আছে না এভাবে সবার সামনে বলা যায় নাকি।
    -সবার সামনে বলা যাবে না এমন কি কথা উনাদের এখন থাকতে পারে। আন্টি আপনারা বোধহয় জানেন না। ছেলে মেয়ে একান্তে কথা বলা প্রকাশ্য হারাম।
    -ছেলের ভাবি বললো, কথায় কথায় হাদীস ঝাড়বেন নাতো। হাদীস আমরাও জানি।
    -কি হাদীস জানেন। এইভাবে মেয়ে দেখতে এসে অবান্তর সব কথা জিজ্ঞেস করাটা কোন হাদীসে আছে। একবার আপনার চুল দেখতে চান আরেকবার হাটিয়ে দেখছেন সব ঠিক আছে কিনা? কি এসব কি? আপনারা কি পন্য কিনতে এসেছেন যে এভাবে নেড়েচেড়ে দেখতেছেন?
    -ছেলের বোন বললো, আপনি এভাবে রাগছেন কেন। মেয়ে দেখতে আসলে মানুষ যাচাই বাছাই করবে না।
    -এটা কি ধরনের যাচাই বাছাই করছেন। চলাফেরায় স্মার্টনেস আছে এছাড়া ভদ্রতা বলতে আর কিছু নাই। কিছু মনে করবেন না আপনারা আসতে পারেন আপনারা চাইলে আমরা আমার বোনকে বিয়ে দিবো না এখানে।
    সবাই বেরিয়ে গেলো এপর্যায়ে।
    লাবিব বললো উচিত শিক্ষা হয়েছে যত্তসব। ওর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার সামনে তোমার মেয়েকে এরকম অবান্তর প্রশ্ন করছে তুমি কিছু বলোনি আব্বু।
    ওরা চলে যেতেই লামিয়া কেঁদে দিলো। আব্বু আমি তোমাকে কতবার বলেছি এসব মানুষকে বাসায় আনবে না। আমি ধনসম্পদ চাই না একটা দ্বীনদার ছেলে দেখো আমি কোন আপত্তি করবো না এ বলে লামিয়া ওখান থেকে চলে গেলো।
    আকরাম চৌধুরী আর রাহেলা চৌধুরীর তাদের ছোট ছেলে আনাস বিন আকরাম চৌধুরির জন্য মেয়ে দেখা শুরু করেছেন আঁটঘাঁট বেঁধে। রাহেলা চৌধুরীর এক কথা ছেলে যত না না করুক না কেন এবার তিনি ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ছাড়বেন। ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে আর বিয়ে করার সামর্থ্যও আল্লাহর রহমতে ওর হয়েছে। হাদীসে আছে-ছেলে মেয়ে উপযুক্ত হলে তাদের বিয়ে দেয়া মা বাবার দায়িত্ব। উনাদের দুই মেয়ে দুই ছেলের মাঝে আনাস সবার ছোট। বড় ছেলে সাদাফ বউ নিয়ে সউদিতে আছে। মেয়েরা ও সংসারী হয়েছে। শুধু ছোট ছেলেটা বাকি আছে। ওর জীবন সাজিয়ে দিয়ে উনার উনাদের উপর আল্লাহর দেয়া অর্পিত দায়িত্বটা থেকে মুক্তি নিবেন।
    অনেক আশা নিয়ে ছেলের রুমে আসছেন ছেলে যেন একবার রাজি হয়। ছেলে রাজি না থাকার জন্য কাউকে কথাও দিতে পারছেন না।
    আনাস অফিসের কিছু কাজ করছিলো। মাকে দেখেই বললো ওহ আম্মু আসো। কিছু বলবে?
    -আমি কি বলতে চাই সেটা তুই ভালো করে জানিস।
    -উফ! আম্মু আমি এখনো পুরোপুরি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়।
    -ওর মা একটু রেগে কবে প্রস্তুত হবি তুই?
    -রাগছো কেন?
    -তো কি করবো। কিছুটা আবেগী হয়ে, আমরা আজ আছি কাল নাই। মানুষের মৃত্যুর কোন বিশ্বাস নাই। কত ইচ্ছে তোকে বিয়ে দিয়ে নাত নাতনির মুখ দেখবো। কিন্তু সে ইচ্ছে আর হয়তো পূরণ করতে পারবো না।
    -আম্মু ইমোশনালি বø্যাকমেইল করবে না বলে দিচ্ছি।
    -আচ্ছা তোর কোন পছন্দ থাকলে বল। আমরা তাকেই মেনে নিবো।
    -আম্মু কি যা তা বলছো আমার পছন্দ থাকবে কেন। তোমরা জানো না আমি কেমন। আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা মেয়ে দেখো আমি বিয়ে করবো।
    -এইতো লাইনে এসেছিস।
    -হাসবেনা শর্ত আছে। যেকোনো মেয়ে হলে আমার হবে না। মেয়ে অবশ্যই দ্বীনদার আর সংসারী হতে হবে।
    -অবশ্যই আপনার কথামতো হবে বাবাজী। রাজি হয়েছেন তাতেই আমি খুশি।
    তারপর থেকে উনি হন্তদন্ত হয়ে মেয়ে খোঁজা শুরু করছেন। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় এমন দ্বীনদার মেয়ে কোথায় পাবো?
    পিয়াস সেদিন যখন আনাসদের বাসায় আসলো আনাসের সাথে দেখা করতে।
    আনাসের মা ওকে বললো, বাবা তোমার বন্ধু বিয়েতে রাজি হয়েছে কিন্তু তার দ্বীনদার মেয়ে চাই। কিন্তু আমি কোথায় পাবো দ্বীনদার মেয়ে? যে দুনিয়া এখন মেয়েরা যেভাবে চলাফেরা করে আমার তো শঙ্কা হচ্ছে ছেলের মনের মত মেয়ে পাবো কিনা?
    -হুম আন্টি ঠিক বলেছেন এখন ভালো মেয়ে খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন।
    (চলবে)
  • লেখকঃ শারমিন মিশু

Comments

comments

About

Check Also

স্টিল আই লাভ ইউ…

১. দুটি সাগর একইসাথে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ঢেউয়ের গর্জন আর উথাল পাতাল তীরে আছড়ে পড়া যুগপৎ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *