সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম


ইদানিংকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। জাতি সংঘ সহ সারাবিশ্বের সব দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য বিভিন্ন আইন কানুন তৈরি করেছে। তারপরও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা হচ্ছেনা। অনেক সময় কিছু নাস্তিকমনা অজ্ঞরা ও অন্যান্য ধর্মের কিছু উগ্রবাদী ধর্মান্ধরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য মানবতার মুক্তির একমাত্র পবিত্র ধর্ম ইসলামকে দোষারূপ করে থাকে। ইসলামের এই চিরশত্র“রা জানে না যে, ইসলাম হচ্ছে একমাত্র সম্প্রাদায়িক সম্প্রতির শ্রেষ্ট ধর্ম। পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক বিশ্ব মানবতার একমাত্র মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন পৃথিবীবাসীর জন্য সম্প্রদায়িক সম্প্রতির শ্রেষ্ট রোল মডেল। এ বিষয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীর জন্য স্থাপন করে গেছেন তা ইতিহাসের পাতায় আজও ঝলমল করছে।
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ! আমাদের প্রিয় নবীজির পূতপবিত্র জীবনী থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কিছু দৃষ্টান্ত এখন তুলে ধরছিএক অমুসলিম বৃদ্ধার ঘটনা ইতিহাসে আমরা জেনেছি। বৃদ্ধা প্রতিদিন মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চলার পথে কাঁটা দিত। একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন পথে কাঁটা নেই।
তখন তিনি ভাবলেন, হয়তো ওই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়েছে বা কোনো বিপদে আছে তার খোঁজ নেওয়া দরকার। এরপর দয়াল নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দেখেন ঠিক সে অসুস্থ। তিনি বৃদ্ধাকে বললেন, আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। এতে বৃদ্ধা অভিভূত হয়ে গেল যে, আমি যাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য পথে কাঁটা পুঁতে রাখতাম, তিনি আজ আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইনিই তো সত্যিকার অর্থে শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘরে একবার এক ইহুদি মেহমান হয়ে এলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে যথাযথ মেহমানদারি করালেন এবং রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে সে ইহুদি মেহমান অসুস্থতাবশত বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কিছু বলবেন এ ভয়ে সে প্রভাতের আগেই ঘর থেকে পালিয়ে গেল। ভোরে ওই ময়লাযুক্ত বিছানা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মর্মে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে, হায়! আমি হয়তো ওই ব্যক্তিকে যথাযথ মেহমানদারি করাতে পারিনি; এতে সে কষ্ট পেয়েছে। অতঃপর বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানাটি পরিষ্কার করলেন। আর সেই ব্যক্তির কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন এভাবে যে, ‘ভাই আমি আপনার যথাযথ মেহমানদারি করতে পারিনি এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন’। তখন ইহুদি লোকটি বলল, অপরাধ করলাম আমি আর ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি। ইসলামের আদর্শ তো সত্যিই মহৎ!


অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এমন উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সেই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর যে মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন তা বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি ও সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এ সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে।
যেমন, সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সব ধর্ম সম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্মপালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনোরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ওই আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। (সিরাতে ইবনে হিশাম)
মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশকটি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। তা সত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামের সঙ্গে ‘রাসুলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসুল, তাহলে তো আর আপনার সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসুল সা. সন্ধির লেখক আলী রা.-কে বললেন ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লেখো। এতে আলী রা. অপারগতা প্রকাশ করলে রাসুল সা. জিজ্ঞেস করেন কোথায় লেখা আছে, এরপর নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ৪/৬১, ইফাবা, ২য় সংস্করণ : ২০০৮ খ্রি.)
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজিত শক্রদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণও প্রতিশোধ স্পৃহা প্রকাশ করেননি, বরং শত্রুদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশরা! আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব বলে তোমরা মনে করো?’ তারা বলল, আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে সেই কথাই বলছি, যে কথা হজরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৪৩৯)
প্রতিশোধের পরিবর্তে শক্রদের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের চিরন্তন আদর্শের জানান দেয়। পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের যে বিধান ইসলামে রয়েছে, তাও সম্প্রীতির বন্ধন সুসংহত করণের উজ্জ্বল প্রয়াস। ‘সালাম’ অর্থ শান্তি, সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে মূলত একে অপরের শান্তিই কামনা করেন। এতে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরি হয়। (সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ : ২/৯৪; ইফাবা)
ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনো ধরনের সহিংসতা ও বিবাদ-বিচ্ছিন্নতার স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম আদৌ প্রশ্রয় দেয় না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ফিতনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯১)
অন্য আয়াতে বলেন, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে ফাসাদ বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৬)
তাই কোন রাষ্ট্র বা সমাজ যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং তারা যদি আমাদের প্রিয়নবীর জীবনকে অনুসরণ করে তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির দেশ বা সমাজ অনায়াসে গড়ে উঠবে যে ভাবে প্রিয় নবীজি মদিনা রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। আর তিনি হচ্ছেন একমাত্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির রোল মডেল বা শ্রেষ্ট আদর্শ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *