সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র সংগ্রামী জীবন

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন, যারা মানুষদেরকে একত্ববাদ বা ওয়াহ্দানীয়াতের পথে ডেকেছেন জীবনভর। যাদের মিশন ও ভিশন ছিল এক আল্লাহর পথে আহ্বান করা। আল্লাহর বাণীর দ্বারাই তা প্রতীয়মান হয়-“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কে আল্লাহ হেদায়েত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্য বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল। (সুরা আন নহল : ৩৬)
শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভিশন ও মিশন ছিল একই। যা মহান আল্লাহ তায়ালা মহানবীর কণ্ঠে পবিত্র কুরআনে এভাবে বলিয়াছেন-“বলুন, হে কাফের দল, আমি ইবাদত করি না, তোমরা যার ইবাদত কর এবং তোমরাও ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি”। (সূরা আল কাফিরুন : ১, ২ ও ৩)
বিশ্বনবীর তিরোধানের পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় বান্দাদের মাধ্যমে জগতে তাঁর মনোনীত ধর্মকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে জাগ্রত রেখেছেন। আর তারাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। হাদিসের ভাষ্যনুযায়ী “আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী”। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পারদর্শী ইসলামিক স্কলারস্গণ যুগে যুগে আদর্শ, নম্র-কোমল আচার-আচারণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার আর প্রয়োজনানুযায়ী জিহাদের মাধ্যমে সময়ে সময়ে আল্লাহর একত্ববাদরে ঝাণ্ডা বুলন্দ রেখেছেন। দূর করেছেন সমাজ থেকে শিরক, বিদ’আত-খোরাফাত আর অপসংস্কৃতি।
সেই অপসংস্কৃতি দূর করতে কখনো নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে হয়েছে। কেননা, হাদিসের বাণী-“জিহাদ ক্বিয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে।” তেমনি একজন বীর পুরুষ, যামানার শ্রেষ্ঠ আলেম আধ্যাত্মিক রাহবার নিজের জীবনকে কুরবান দিয়ে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নাম লিখে গেছেন। তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন ভারত উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের অগ্রদূত, শহিদ বালাকোট, হজরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)। সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ভারতের অযোধ্যায় ১৭৮৬ খ্রি. বর্ষের ২৯শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। হজরত আলী (রা.) পর্যন্ত তাঁর বংশ তালিকা মিলিত হয়েছে। মাত্র চার বছর বয়সেই শিক্ষা গ্রহণের জন্য মক্তবে গমন করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন চটপটে। লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলার প্রতি মনোযোগ ছিল খুব বেশি। তাঁর নিকটে ‘কপাটি’ তথা সৈনিকদের বীরত্বমূলক খেলা ছিল কুবই প্রিয়। সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র জীবনের প্রাক্কালেই পরিলক্ষিত হয়েছিল যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ। যা তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের কার্যাবলীকে সহজ করে দিয়েছিল। একদা মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে এক যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাঁর ধাত্রী মাতা তাঁকে কোনোভাবেই যুদ্ধে যেতে রাজি হননি। কেননা, তিনি তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। এমতাবস্থায় আহমদ শহীদ (রহ.)’র মা নামাজে ছিলেন। নামাজ সমাপন করে ধাত্রীকে বললেন, আমি জানি তুমি আমার ছেলেকে খুব স্নেহ কর। তবে তা আমার স্নেহকে হার মানাবে না। এটা বাঁধা দেয়ার সময় নয়। বৎস যাও। আল্লাহর নাম নিয়ে এগিয়ে যাও। সাবধান যুদ্ধক্ষেত্রে পৃষ্ঠপ্রদর্শণ করবে না। অন্যথায় তোমার চেহারা দেখব না। মনে রেখ, শত্র“রা যদি যুদ্ধক্ষেত্রে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরে তাহলে তাদের ছেড়ে দিও। সবশেষে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছলে শত্র“রা বলতে লাগল-আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিন, আমরা চলে যাব। আপনাদের সাথে আমাদের কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ নেই। তখন তিনি সঙ্গীগণকে বললেন, তাদের চলে যেতে সুযোগ প্রদান কর। এভাবেই হজরত আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) তাঁর সংগ্রামী জীবন শুরু করেন।
শুধু তাই নয়, এ মহান মনীষী তাঁর জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন ইসলামের তরে। যুদ্ধ করে হয়েছেন শহিদ। কিন্তু; অন্যায়কে গ্রহন করেন নি। বরং ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন জীবনভর। রয়েছেন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে। আজো বালাকোটের সেই ময়দার তাঁর শাহাদাতের গ্লানি মুছে ফেলতে পারেনি। মুছে ফেলতে পারেনি তাঁর স্মৃতিগাঁথা প্রথিতযশা কাহিনীগুলো। আর ভুলবেই কেমন করে? সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ছিলেন সর্বকালের অনুকরণীয় মুহাদ্দিস, তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)-এর অন্যতম শিষ্য। মূলত : তাঁর আদেশেই সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পারিপার্শ্বিক অন্যান্য জাতির প্রভাবে কলুষিত মুসলিম জাতির ঈমান-আক্কীদাকে শিরকমুক্ত করা এবং মুসলিম জীবনধারা ও জাগরণের অন্তরায় অশুভ শক্তি সমূহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই আন্দোলন শুরু করেন। কেননা, এ দুটি কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী ও আবশ্যিক।
মোঘল সালতানাতের পতনের পর মুসলিম জনগণের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। মসজিদে আজান এবং জুমু’আর জামাত বন্ধ হয়ে যায়। মুসলমানদের অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে ছিল যে, অনেকেই সে সময় ইসলামের অন্যতম রূকন হজ্জ করার প্রয়োজন নেই বলে ফতোয়া দেয়া শুরু করেছিল। এ ভয়াবহতা সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) কে তাড়িত করে। প্রথমে তিনি মুসলমানদের জাগরণের জন্য দাওয়াতী সফর শুরু করেন। তাঁর এ আন্দোলনে অনেক বাংলাদেশি যুবক ও শরীক হয়েছিলেন। ৬ মে ১৮৩১ সাল। ঐতিহাসিক বালাকোটে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ৭০০ মুজাহিদ নিয়ে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিং-এর ১০,০০০ শিখ সৈন্যের সাতে মোকাবিলা করেন। যুদ্ধে মোকাবিলার পূর্বে শিখ রাজা রনজিৎ সিং-কে প্রথমে পত্র মারফত মুসলিম নির্যাতন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। শিখ রাজা পতের জবান না দিয়ে মুজাহিদগণকে শায়েস্তা করার হুংকার দেন। তার জবাবে মুসলমানরা পরপর দুইবার শিখদের শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। মুসলমানদের আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। এসময় তাদের উপর শিখদের আতর্কিত হামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। এই ঘটনার পর মুজাহিদগণের মনোবল দূর্বল হয়ে যাওয়ায় সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) মুজাহিদগণকে নিজ নিজ বাসগৃহে ফিরে যেতে অনুমতি দেন। অনেকেই ফিরে যেতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। অবশিষ্ট মুজাহিদগণকে নিয়ে পেশোয়ার থেকে কাগানের পার্বত্য এলাকা দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথিমধ্যে ‘বালাকোট’ প্রান্তরে এক তুমুল যুদ্ধের সূচনা ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে মুজাহিদগণ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেন। কিন্তু কতিপয় লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) বেশকিছু মুজাহিদসহ শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। এভাবেই দ্বীনের তরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) তাঁর সংগ্রামী জীবনের ইতি ঘটান। আর জীবত্ত থাকেন সকলের হৃদয়ে। শহীদগণের সম্মানে আল্লাহ বলেন-“আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকা প্রাপ্ত।” (সূরা আল ইমরান : ১৬৯)
আল্লাহ যেন এ সকল মুজাহিদগণের দরজা বুলন্দ করে দেন। (আমীন)। ওয়াসাল্লাল্লাহ আ’লা নাবিয়্যিনা মুহাম্মদ।

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *