‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী

জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ পড়ে যায়। কবিরা চিরুনি অভিযান করতে পারেন সর্বত্র। তা যদি আবার একজন মহান ওলির জীবন নিয়ে হয়-তবে সোনায় সোহাগায়। ভারতীয় উপমহাদেশের সমকালীন শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ, রাইসুল কুররা ওয়াল মুফাসসিরীন শামছুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে নিয়ে ‘বাংলার রূমী’ কাব্যগ্রন্থে তরুণ কবি মাওলানা রফীকুল ইসলাম মুবীন’এর কিছু উপস্থাপনা নিম্নে পেশ করছি। চেহারা শিরোনাম দিয়েই শুরু করা যাক।
চেহারা : পৃথিবীর অনেক মানুষ আমরা দেখেছি। কোনো কোনো চেহারা ভুলার মত নয়। নূরের ঝলক নিয়ে যে চেহারাখানা আমাদের মাঝে বিচরণ করতেন-তার বর্ণনায় কবি রফীকুল ইসলাম মুবীন’র উপস্থাপনা
ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী আশিক মদীনার
চেহারাতে ছিলো তোমার নূরের বাহার।
মানুষের শরীরের সবচেয়ে সম্মানী যে অংশ তা হলো পেশানী। আমরা যাকে কপাল বলি। এ কপালে মনের গহীনের অনুভূতিও প্রকাশ পায়-জ্বলে উঠে সর্বদায়। যার আলোয় আলোকিত হৃদয়ে হৃদয়ে জাগ্রত হতো নবী প্রেমের অনল। কবি বলেন-
তোমারই পাক যবানে নূর নবীজির বাণী
নবীজির ইশকে তব জ্বলতো পেশানী।’
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. চেহারাখানী এমন উজ্জ্বল ছিলো-একবার দেখলে ঈমানের নূর বেড়ে যেত। নূরানী ঈমানী চেহারা দেখে মুরীদের ঈমান হতো তেজোদ্বীপ্ত। এ কথাগুলো কবির ভাষায়-
‘তোমারই চেহারা ছিলো কত যে নূরানী
তোমায় দেখে বেড়ে যেত তেজ ঈমানী।’
আল্লাহর ওলিগণ প্রিয় নবীর আলোয় আলোকিত। নবীর নূরের ঝলক তাঁর প্রিয়ভাজনদের মাঝে করত বিচরণ। ‘বাংলার রুমী’ কাব্যের পঙক্তি-
আহমদী ঐ নূরের বাতি হাসত তব চেহারায়
তাই তো মোদের তুলে নিলে নবীজির নায়।’
কবি রফীকুল ইসলাম মুবীন তার মুরশিদ মহানের চেহারাকে চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন এবং মুরীদ ভক্তজনদের সান্ত্বনার আশ্রয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
সেই মানবের চেহারা পাক ছিল চাঁদের মতো
একটি ঝলক দেখলে তাঁকে মনটা শান্ত হতো।
অন্যত্র বলেন-
তব চেহারা চাঁদের মতো ছিল মনোহর
দেখলে যে তা শান্তি পেত ভক্তদের অন্তর।
প্রিয় মুরশিদের চেহারায় এমন এক পরম প্রশান্তি প্রবাহমান ছিল জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে দুঃখ-যাতনায় নিঃষ্পোশিত মানব তাঁকে একবার দেখলে পেত শান্তনা, দূর হতো মনের কালিমা, মুছে যেত সব দুঃখ। ‘বাংলার রুমী’ কাব্যে বিবৃত-
স্মৃতির আয়নায় ভেসে উঠে
তোমার প্রিয় মুখ্
দেখলে তোমায় চলে যেত
মনের যত দুঃখ।
তাই কবি তাঁর প্রিয়তম এর নুরানী চেহারাখানী আরেকবার দেখতে চান এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন অন্য একটি কবিতায়-
বেহেশত হতে সাড়া দাও
নুরানী চেহারা বারেক দেখাও।
আল্লামা ছাহেব কিবলা ফুলতলী রহ. এমন এক ওলী মর্দে মুজাহিদ ছিলেন, যিনি দ্বীনের জন্য, আকিদার জন্য, এশকে নবীর শান ও মানকে উন্নত শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়াজ করেছেন আজীবন। তিনি ছিলেন বাতিলের বিরুদ্ধে নির্ভীক সৈনিক। কবি বলেন-
তুমি বাতিলের সম্মুখে নির্ভীক ছিলে
তাই তো বদন হতে রক্ত দিলে।’
অন্যস্থানে এই কথার রূপায়ন এভাবে-
নবীজির প্রেমের তরে ঝরালে তাজা খুন
মিশন তোমার রয়নি থেমে বাড়লো বহুগুণ।
সৈয়দপুরের কাহিনী শুনলে ভক্ত মুরীদের মন আঘাতে আঘাতে হয় জর্জরিত, রক্তক্ষরণ হয় মনের অজান্তে, মুখটা একদম ভারী হয়ে উঠে। কাব্যে তার বর্ণনা-
সৈয়দপুরের সেই কাহিনী মনটা করে ভার
রক্তে রাঙা হলেন সেদিন মুরশিদ আমার।
আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র. ছিলেন সত্যপথের অনন্য এক দিশারী। কত পথহারা বনি আদমকে যে তিনি সত্যপথের দিশা দিয়েছেন তার কোনো হিসেব রাখা যায়নি। ইলমে শরীয়াত ও মারেফাতের সঠিক দিক নির্দেশনায় আলোর নিশান জ্বালিয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বময়। কবির ভাষায়-
তরীকতের দ্বীপ্ত মশাল জ্বেলেছো বাংলায়
দিশা দিলে সত্যপথের পথহারা কাফেলায়।
অন্যত্র কবির উপস্থাপনা-
তিনি ছিলেন সত্যপথের আপসহীন এক বীর
রক্ত দিয়ে প্রচার করেন আদর্শ নবীর।
‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আরো পাওয়া যায়-
লক্ষ মানুষ তোমার ছোঁয়ায় সত্যপথের দিশা পায়
বাতিল ছেড়ে চলে আসে মদীনার ঐ কাফেলায়।


দ্বীনের একনিষ্ঠ উঁচু মানের খাদিম আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র. মসজিদ, মাদরাসা, খানেকা, লঙ্গরখানা, ইয়াতিমখানা ও অন্যান্য জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডসহ এক বিশাল কর্মযজ্ঞের কাণ্ডারী ছিলেন। তাঁর প্রিয় মুরশিদ শাহ ইয়াকুব বদরপুরীর ভবিষ্যৎ বাণীর প্রতিফলন ঘটেছিল আল্লামা ফুলতলীর র. স্বীয় নেক কর্মতৎপরতায়। কবি মুবীন বলেন-
দ্বীনের খেদমতে তুমি হয়ছো কীর্তিমান
মসজিদ, মাদরাসা, খানেকা গড়েছো তুমি মহান।
হুব্বে রাসূলের মূর্তপ্রতিক আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.। কত আত্মায় যে রাসূল প্রেম জ্বালিয়ে দিয়েছেন তা অগণন। তাঁর জীবনের শিংহভাগ সময় অতিবাহিত হয়েছে হুব্বের রাসূলের প্রচার-প্রসারে। কাব্য কথায়-
তোমার মিশন ছিল হুব্বের রাসুল
নবীজির প্রেমে সদা ছিলে ব্যাকুল।
অন্যত্র হুবের রাসূলের অবতারণা-
হুব্বের রাসূল করতে প্রচার রক্ত ঝরালে
নূর নবীজির ইশকে তব জীবন ভাসালে।
তিনি ছিলেন পাঁচ তরীকার পীর। এ কথাটিও কবির কবিতায় উচ্ছারিত হয় এভাবে-
তুমি মুজাদ্দেদী, চিশতিয়া, কাদরিয়া, সিলসিলার পীর
নক্সাবন্ধিয়া মোহাম্মদীয়া পাঁচ তরীকার দক্ষ বীর।
আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র. ছিলেন আল-কুরআনের অনন্য এক খাদিম। শুদ্ধ-পঠন-পাঠনে তার জুড়ি মেলা ভার। পবিত্র কুরআনের জন্য জীবন-যৌবন ও সম্পদ ব্যয় ছিল তার মজ্জাগত ব্যাপার। কুরআনই তাঁর পরম পরশ পাথর। কুরআনের মায়ায় জীবন উৎসর্গ এ মহান মনীষীর। কবির ভাষায়-
দারুল ক্বিরাত করেছ কায়েম ইঙ্গিতে ঐ মাদানী
আল-কুরআনের খিদমতে তাই জীবন করলে কুরবানী।
অন্যত্র বলেন-
শিক্ষা দিতে সবে কুরআনের পাঠ
যেতাম আমি ওই জান্নাতী হাট।
আরো কাব্যকথা-
কুরাআনের খিদমতে ছিলে তুমি মাতি
লক্ষ বুকে জ্বালালে মারিফাতের বাতি।
যামানার মুজাদ্দিদ বলেও এক জায়গায় কবি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে আখ্যায়িত করতে ভুলেন নি। শিল্পীর কণ্ঠে কণ্ঠে যে পঙক্তিগুলোর উচ্চারণ সর্বত্র-তা হলো এই-
যামানার মুজাদ্দিদ ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী
জানাই তোমার লক্ষ সালাম তোমার বাগের বুলবুলী।
সবুজ পাগড়ী পরিহিত মহান ওলী আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলীকে নিয়ে যা লেখা হয়-তাই ভালো লাগে। কবির কলমে আঁকা পঙক্তিমালা-
কোন মনীষীর মাথায় ছিল সবুজ আমামা
তিনি মোদের প্রিয়তম শামসুল উলামা।
আল্লামা ছাহেব কিবলাহর বিরহে কবির তনোমন বেদনা-বিভোর। বিরহী কবি বিরহ বেদনায় গেয়ে উঠলেন-
কী মায়াবী পরশ ছিল ওই চেহারা পাকে
আজও মোদের বিরহী মন তাঁর ছবিটা আঁকে।
আরো বলেন-
প্রতিদিন প্রতি-রাত তোমাকে খুঁজি
তোমার পরশই জীবনে বুঝি।
এ মহা মনীষীর প্রয়োজন মিটেনি। আরো দীর্ঘদিন তাঁর পরশ পাওয়ার পিপাসা ছিল সকলের। তাঁর প্রস্থানে কবির আকুতি নিম্নরূপ-
আজ বড় প্রয়োজন তোমাকে
বাতিলেরা গ্রাস করে ধরাকে।
পরিশেষে, মহান আল্লাহর শাহী দরবারে আবেদন-তার প্রিয় বান্দা ও ওলীয় পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক আমাদের দান করুন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *