মহাকাশ যাত্রার প্রেরণা বিস্ময়কর মিরাজ

মহান আল্লাহ তা’আলা পথহারা ও দিশেহারা মানব জাতির হিদায়েতের নিমিত্তে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন অসংখ্য নবী-রাসূল। আর প্রেরিত নবী-রাসূলদের নবুয়াতের সত্যতা উম্মতের সামনে তুলে ধরার জন্য আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়েছে মু’যিযা বা অলোকিক নির্দশনাবলী। মহান আল্লাহ তা’আলার সাহায্যে নবীদের মাধ্যমে তা সংঘটিত হয়ে থাকে। এটা মহান আল্লাহ তা’আলার কুদরতের একটি নমুনা। এ সকল ঘটনাকে মু’যিযা বলা হয়। যেমন, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য আরামদায়ক জান্নাতি বাগান। হজরত মুসা (আ.)-এর লাঠি, এটা যখন ছেড়ে দিতেন বিরাট অজগর সাপে পরিণত হতো। নীলনদের মাঝখানে হজরত মুসা (আ.) এবং তার সাথীদের জন্য মুহুর্তের মধ্যে রাস্তা তৈরি, একটি ঠ্যাং ভাঙ্গা মশার ধাক্কায় নমরুদের রাজ প্রাসাদ ভেঙ্গে চুরমার, হজরত সুলাইমান আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়া সাল্লাম এর সিংহাসন, তাতে আরোহন করে তিনি প্রতিদিন সকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করতেন। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া ইত্যাদি। আরো অসংখ্য অগণিত মু’যিযা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর ৬৩ বছর বয়সে আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য মু’যিযার মধ্যে মিরাজ একটি শ্রেষ্টতম মু’যিযা। বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতার যুগে আধুনিক বিজ্ঞানীরা মিরাজের মহা সত্যকে আরো উদ্ভাসিত করেছেন।
মিরাজ অর্থ, তারিখ ও সময় : মি’রাজ শব্দটি আরবি। অর্থ-উর্ধ্বে উঠার সিঁড়ি বা বাহন। ইসলামি পরিভাষায়, এ বিশ্ব সভার সভাপতি, দো’জাহানের মহাসম্মানিত সম্রাট, সুলতানে মদিনা, মহান আরশে আজিমের সম্মানিত মেহমান, নবীকুলের সর্দার, নিখিল বিশ্বের রহমত, সৃষ্টিকুলের মুক্তিদূত, আমাদের প্রিয় আকা, মাক্কী-মাদানি মুস্তফা, বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর পবিত্র হায়াতে তাইয়্যেবার ৫১ বছর ৯ মাস বয়সে ৬২১ ঈসায়ী সনের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৯ শত ৯৯ জন নবীর ইমাম হয়ে , ইমামুল মুরছালিন হয়ে, প্রথম আকাশ, দ্বিতীয় আকাশ, তৃতীয় আকাশ, চতুর্থ আকাশ, পঞ্চম আকাশ, ষষ্ট আকাশ, সপ্তম আকাশ, সিদরাতুল মুনতাহা, লা-মাকান, এরপর ৭০ হাজার নূরের পর্দা বেধ করে আরশে আজীমে মহান আল্লাহ তা’আলার সাক্ষাতে হাজির হওয়ার ঐতিহাসিক অসাধারণ ঘটনাকে মি’রাজ বলা হয়। এ বিস্ময়কর ঘটনা সস্পর্কে বিশ্ববাসী ওয়াকেফহাল। এ মি’রাজের রজনীটিকে লাইলাতুল মি’রাজ বা শবে মিরাজ বলা হয়।
মহাকাশ যাত্রার প্রেরণা : এবারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মলেকুলার থিওরী, এ্যাটমিক থিওরী এবং সর্বশেষে ইলেক্ট্রন ও প্রোটন থিওরী দিয়ে মিরাজ ভ্রমনকে যাচাই করার চেষ্টা করবো। প্রথমে পদার্থ সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ছিলো- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যাম এই পঞ্চভূতে পৃথিবী এবং পৃথিবীর সবকিছু তৈরি হয়ে থাকে। তারপর গবেষণা চলতে চলতে পঞ্চ উপাদানের পরিবর্তে উপাদানের সংখ্যা দাঁড়ালো বিরানব্বই। কিন্তু এ পর্যন্ত গিয়েও বিজ্ঞানিরা থেমে থাকলেন না। তারা মলেকুলার থিওরী আবিস্কার করলেন। এই থিওরীতে বলা হয়, যে কোনো জিনিসকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বা খণ্ড খণ্ড করতে করতে এমন একটা অবস্থায় আসা যায়, যার পর আর তাকে খণ্ড করা সম্ভব হয় না। পদার্থের এই ক্ষুদ্রতম অংশকে বলা হয় মলেকুল। কিন্তু এই আবিস্কারের আরো কিছু দিন পর বিজ্ঞানিরা এই মলেকুলকে ভাঙ্গতে চেষ্টা করলেন এবং কৃতকার্য হলেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানি ডাল্টন মলেকুলকে ভেঙ্গে যে ক্ষুদ্রতম জিনিসটি পেলেন, তার নাম দিলেন এ্যাটম এবং তিনি দেখলেন, দুই বা ততদিক এ্যাটম দ্বারা একটি মলেকুল গঠিত হয়। তিনি এ থিওরীর নাম দিলেন এ্যাটমিক থিওরী। কিন্তু আরো পরে হামসন ও রাদারফোর্ড নামে খ্যাতনামা বিজ্ঞানিকগণ আরো গবেষণা করে ঘোষণা করলেন, এ্যাটমই পদার্থের শেষ ণ্ডন্ড নয়। সমস্ত পদার্থের মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ আবার রয়েছে জোড়ায় জোড়ায় অর্থ্যাৎ পজেটিভ ও নেগেটিভ। পজেটিভ বিদ্যুৎ এর নাম হচ্ছে প্রোটন আর নেগেটিভ বিদ্যুৎ এর নাম ইলেক্ট্রোন। এই থিওরী যে বাস্তবধর্মী আমরা তার প্রমাণ পাই আমাদের দৈনন্দিন কাজের ভিতর দিয়ে। কারণ, পজেটিভ ও নেগেটিভ তারের মিলন না হলে বিদ্যুৎ জ্বলে না। কাজেই প্রতিটি পদার্থের মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ বা নূর। নূর অর্থ আলো। নূর বা আলো আলোর গতিতে যে কোন জায়গায় মূহুর্ত্যরে মধ্যে চলে যেতে পারে।
পূর্ব দিগন্তে বিদ্যুৎ চমকে, পশ্চিম দিগন্তে গিয়ে পড়ে; বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। সারা দেশের সঙ্গে সে কেন্দ্রের সরাসরি যোগাযোগ আছে। কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সাপ্লাই হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে পৌঁছে যায়। এক সেকেণ্ডের প্রয়োজন হয় না। কয়েক হাজার মাইল দূর পর্যন্ত এক মুহুর্তে পৌঁছে থাকে। কিন্তু আমাদের ব্যবহারিক আগুন ধরিয়ে দিলে সে তারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কয়েক হাজার মাইল পৌঁছতে কয়েক হাজার বছরের প্রয়োজন হবে। অথচ উভয় আগুনের জ্বলন প্রকৃতির দিক দিয়ে সমান। এটা আমরা সব সময় দেখি। অথচ এর জন্য এক সেকেণ্ড সময়ও লাগে না। এতদসত্ত্বেও অল্পক্ষণ সময়ে এত হাজার কোটি মাইলের সফর করাটা অসম্ভব ব্যাপার বলে ধরে নেয়া হচ্ছে; এটা সত্যিই বিষ্ময়কর কথা। বিশেষ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম-এর আকৃতি প্রকৃত ছিলো নূরের। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেন, “ আমি আল্লাহ তা’আলার নূর থেকে সৃষ্টি।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম যেহেতু আল্লাহর নূর। তাহলে আমরা এবার দেখব, নূরের গতি কত দ্রুত। দেখা গেছে যে, নূর বা আলো প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল অতিক্রম করে। আর সেই সত্ত্বা প্রতি সেকেণ্ডে কত লক্ষ মাইল অতিক্রম করতে সক্ষম; তাকে যদি মহান আল্লাহ পাক নিজ অনুগ্রহে আরও সাহায্য করেন, তা হলে তিনি কি রকম ক্ষিপ্র গতিতে পথ অতিক্রম করতে পারবেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কে দেখতে সাধারণ মানুষের মতো হলেও তার দেহ মোবারক ছিলো নূরের সমষ্টি। তার প্রমাণ, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর দেহের কোনো ছায়া ছিলো না। অর্থাৎ তার দেহ মোবারক আলোকময় ছিলো বলেই তার দেহের কোনো ছায়া ছিলো না। কারণ, আলোর কোনো ছায়া থাকে না। তা ছাড়া তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে আমার নূর।’’ নূরের দেহ নিয়ে, নূরের তৈরি বোরাকে আরোহণ করে প্রথম আকাশ, দ্বিতীয় আকাশ, তৃতীয় আকাশ, চতুর্থ আকাশ, পঞ্চম আকাশ, ষষ্ঠ আকাশ, সপ্তম আকাশ, সিদরাতুল মুনতাহা, এরপর ৭০ হাজার নূরের পর্দা বেধ করে আরশে আজীমে মহান আল্লাহ তা’আলার সাক্ষাতে হাজির হওয়া সম্ভব হয়েছে।
মিরাজে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম সৃষ্টি জগতের সমূদয় রহস্যলীলা পরিদর্শন করেন। আকাশ মণ্ডলীর সমস্ত গোপন রহস্যমালা অবলোকন করেন। বিভিন্ন নবীদের সাথে সালাম আদান প্রদান ও বিনিময় করেন। ফিরিশতা জগত সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জন করেন এবং জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা হাসিল করেন। উপরে বর্ণিত মহান আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনাবলী সত্যিই বিস্ময়কর। কারণ, এগুলো সব অদৃশ্য জগতের বিষয়- যা সাধারণ মানুষের দেখার এমনকি বুঝারও সাধ্য নেই। এগুলো সব বিশ্বাসের এবং উপলব্দির বিষয়। কিন্তু মিরাজের মধ্যে এমন একটি বিষয় রয়েছে যা আজ বিজ্ঞানিরাই স্বীকার করে নিতে যাচ্ছেন। তারা পবিত্র কুরআনের ভাষার প্রতিধ্বনী করে এটাকে বিস্ময় বলে অভিহিত করেছেন। পবিত্র মক্কা ভূমি থেকে আরশে আজিম পর্যন্ত হাজার হাজার বছরের পথের যে সফর অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এক বিশেষ বাহনে সম্পন্ন করেন তা যে বিজ্ঞানসম্মত এবং খুবই সম্ভব তা উদঘাটনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গিয়ে বিজ্ঞানিরা একে বিস্ময়কর না বলে পারছেন না।
আমরা বিজ্ঞানে ততটা উন্নত নয় বলে এবং আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর মি’রাজ ভ্রমনের থিওরীকে কোন কাজে লাগাতে পারিনি। কিন্তু এই থিওরী অবলম্বন করেই রাশিয়ার বৈমানিক জুড়ী গাগারিন ১৯৬১ সালের ১২ মার্চ সর্বপ্রথম রকেটে চড়ে আকাশ পরিভ্রমন করে সারা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আবার এ থিওরী অবলম্বন করেই আমেরিকার নভোচারি নীল আমর্স্ট্রং এডউইন অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই রকেটে চড়ে চাঁদে অবতরণ করে সেখান থেকে পাথরের নূড়ি কুড়িয়ে এনে সারা বিশ্বকে আরো অবাক করে দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই তা বিশ্বাস করতে চায়নি। কারণ, তাদের মতে চাঁদে মানুষ যাওয়া যায় না। কিন্তু বর্তমানে যে রকেট প্রতি মিনিটে কয়েক বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে, সেখানে বোরাকের বর্ণিত গতি সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ভুল হবে। কারণ, রকেট হচ্ছে মানুষের তৈরি। মাঝপথে বিকল হবার সম্ভাবনা আছে। বিকল হয়ে নষ্ট হয়েছে এমন প্রমাণ ও আছে। কারণ, মানুষের জ্ঞান অসীম-নিখুঁত নয়। কিন্তু বোরাক তো সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি বাহন। জান্নাতি বাহন। মহান আল্লাহ তা’আলার জ্ঞান অসীম। তার কাজ কর্ম নিঁখুত। তাই তা বিকল হবার সম্ভাবনা নাই।

Comments

comments

About

Check Also

আল-কুরআনের আলোকে একনজরে মহানবি স.-এর পরিচয় ও অধিকার

মহানবি স.-এর গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়-০১আল-কুরআন অনুসারে তিনি ছিলেন একাধারেÑ১. নবি২. রাসুল৩. উম্মি বা অক্ষরজ্ঞান অর্জন না …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *