ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিংহপুরুষ সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)

সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.), যাকে ব্রিটিশরা জমের মতো ভয় পেত সেই মর্দে মুজাহিদকে রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তার কালজয়ী কবিতায় ‘রায় বেরেলীর জঙ্গি পীর’ আখ্যা দিতে গিয়ে লিখেন :
সবাই যখন আরাম খুঁজে
ছুটে ঘরের পানে
জঙ্গী পীরের ডাক শোনা যায়
জঙ্গের ই ময়দানে।

সবাই ভাবে পীরের কথা
শুনেছি তো ঢের
এমন পীরের কথা তো ভাই
পাইনি কভু টের।

সত্যিই সেদিন সেই পীর শুধু তাসবিহ হাতে মুরিদানকে নিয়ে খানকায় বসে থাকেননি, নিজের সুখ শান্তি ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে এসে সিংহের মত গর্জন করে উঠেছেন। পরাধীন ভারতবাসীদেরকে কেউই তখনো ব্রিটিশদের শাসন ও শোষণ থেকে রক্ষার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেনি। সাধারণ মানুষ কখনই ভাবতো না তারা ব্রিটিশদের জুলুম, নির্যাতন এবং শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে। তাদের কাছে এমন একটি স্বপ্ন ছিল আঁধারে হারিয়ে যাওয়া আলোর মতই। কখনই তা চিন্তা শক্তিতে স্বচ্ছ হয়ে ধরা দিতো না। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ দৃপ্ত শপথে সেই স্বপ্ন দেখতেন আবার অন্যকে দেখাতেন। অন্যের চোখে সেই স্বপ্নের বীজও বুনে দিতেন। পরাধীন ভারতবাসীর চোখে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে আঁধারকে দূর করার আলো জ্বালাতেন। যেই সব মহামনীষী প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে ভারতবাসীকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)। এই ক্ষণজীবী মহান পুরুষ ৬ সফর, ১২০১ হিজরী মোতাবেক ১৭৮৬ ঈসায়ী সালের ২৯শে নভেম্বর সোমবার ভারতের উত্তর প্রদেশে এলাহাবাদের রায় বেরেলীর সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে (সাইয়্যিদ বংশে) জন্মেছিলেন। যার নাম সকল মুক্তিকামী মানুষেরই জানা।
জন্মসূত্রে সাইয়্যিদ বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, আওলাদে রাসুল এই মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক, ইসলামের খাদেম, নিবেদিত প্রাণ ইসলাম প্রচারক এবং মাক্ববুল সিলসিলার উত্তরাধিকারী, তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে খেদমতে ইসলাম, খেদমতে খলক্বের অনুপম নিদর্শন। মজলুম মানব জাতির মুক্তির ক্ষেত্রে, মানুষের ইসলাহ-তাযকিয়া ও তরবিয়াতের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক কার্যক্রমে তাঁর অবদান ভারতবাসী তথা বিশ্বের মজলুমদের জন্য অনুকরণীয়। আখলাকে নববীর অনুপম আদর্শের সৈনিক সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ট সাহসী সন্তান, তরিকতের উচু মার্গের বুজুর্গ, যামানার মুজাদ্দিদ, আদর্শ নবী প্রেমিক, ওয়ারিছে রাসুল (সা.)। বাতিলের বিরুদ্ধে আপোসহীন ব্যক্তিত্ব, মানব দরদী এই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে দেশ বিদেশের অসংখ্য বনি আদম তরিকতের উচ্চ মাক্বাম হাসিলের পাশাপাশি নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করে ইহ ও পরজগতে কামিয়াবি হাসিল করতে সক্ষম হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতার কিছুটা নিদর্শন আমরা দেখেছি মুরশিদে বরহক্ব আল্লামা সাহেব ক্বিবলাহ ফুলতলী (রহ.) এর মধ্যে।
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.) ইসলামের ইতিহাসে অপরাজেয় সৈনিক, রাসুল (সা.)-এর প্রেমের অনলে পোড়া আল্লাহর তরবারি (সাইফুল্লাহ) হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা.)’র যোগ্য উত্তরসুরি পরিচয় দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য প্রজ্ঞাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক কর্মসূচী সম্বলিত যে আধুনিক কলা-কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন, মুক্তিকামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে আজও তা বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ সমাজ-বিপ্লবের উদ্দেশ্যে ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও তিনি অনাগত ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেছেন। ভারত উপমহাদেশের মুক্তিকামী মুসলমানদের ঈমানী প্রাণ প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে হযরত শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.)’র রেখে যাওয়া কর্মসূচী অনুকরণ করেই হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.) ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা পরবর্তী সময়ে একটি ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত করেছিলেন। সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব, প্রখর দূরদৃষ্টি, তীক্ষè প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দ্বারা হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) উপমহাদেশে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা কিনা উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক এবং ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.) তাঁর বাস্তব সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মসূচী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী এবং রণচাতুর্যের মাধ্যমে যে বিপ্লবের জোয়ার এনেছিলেন, তা ছিল আধুনিক সমাজ বিপ্লবেরই এক নবতর প্রক্রিয়া। সে বিপ্লব তদানীন্তন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের মসনদ যেমনিভাবে প্রকম্পিত করেছিল তেমনিভাবে আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও তাঁর কর্মকৌশল বর্তমান সময়ের ইসলামী আন্দোলনের যে কোন কাফেলার জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার এক সাবলীল উৎস ধারা। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) যে সব কর্মসূচী ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তা সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

বালাকোটের জিহাদ; ব্রিটিশদের চতুরি এবং পাঠানদের মোনাফিকী
বনি আদমের উপর জুলুম নির্যাতন দেখলেই সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)-এর প্রতিবাদী মন জেগে উঠতো। আর উঠবেইনা কেন, যার পূণ্যময়ী জননী গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, “রক্তে লেখা একখানি কাগজ পত পত করে উড়ে বেড়াচ্ছে”। ভারতের জমিনে যখন অসহায় মজলুমদের জীবন জুলুম আর নির্যাতনের আঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল তখনই মেঘলা আকাশে প্রতিবাদের উল্কাপিণ্ড রূপে আবির্ভুত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)।
সাইয়্যিদ সাহেবের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন, কেমন করে এ দেশের বিরাট মোগলসাম্রাজ্য চূর্ণ বিচূর্ণ ও ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ধ্বংসস্তুপের উপর যে দু’চারটি মুসলমান রাষ্ট্র মাথা তুলেছিল, তাও শেষ হয়ে গেছে। ব্রিটিশ ইংরেজ গোটা ভারতের উপরে তার আধিপত্য বিস্তার করে থাকলেও ভারত উপমহাদেশের এক বিরাট অঞ্চল শিখ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে উঠেছিল। মুসলমানরা শুধু রাজ্য হারায় নাই, আপন দ্বীন ও ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ থেকে বহু দূরে সরে পড়েছে। তাদের আকীদা বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও আচার অনুষ্ঠান, অনৈসলামিক চিন্তাধারা ও ধর্মকর্মের দ্বারা প্রভাবিত। মুসলমান আমীর-ওমরা যারা অবশিষ্ট ছিলেন, তারাও ভোগবিলাসে লিপ্ত এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য এ ছাড়া আর অন্য কোন কিছু ছিল না। মুসলমানদের এই অবস্থা দেখে ব্রিটিশ জালিমদের ছত্রছায়ায় ভারতের মারাঠা ও পাঞ্জাবের সীমান্ত এলাকায় সুযোগ সন্ধানি শিখদের অত্যাচারের মাত্রা সীমাতিক্রম করেছিল। সে সকল এলাকাগুলোতে মুসলমানদের জন্য বসবাস করা সম্পুর্ণরূপে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জুলুম নির্যাতন এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে এই জালিম শিখ হায়েনারা মুসলিম নারীদেরকে দাসীরূপে ব্যবহার করত। সীমান্তে মুসলমানদের ঘর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিত, ফল-ফসলাদি বিনষ্ট করত। মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করত। মসজিদগুলোতে ঘোড়া বেঁধে রাখত। মিনারে উঁচু আওয়াজে আজান দিতে বাঁধা প্রদান করত। মানবতা যখন দ্বারে দ্বারে কাঁদছিল, তখন ভারত উপমহাদেশের মজলুম মুসলমানরা একজন মুক্তির দিশারীর অপেক্ষায় চিৎকার করছিল। এমনি সঙ্কটময় মুহুর্তে জিহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ব্রিটিশ জালিমদের জুলুম থেকে মুক্ত করে ভারতে একটি প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রের সপ্নদ্রষ্টা হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রাহ.) জিহাদের ডাক দিলেন। তাঁর ডাকে ঘুমিয়ে পড়া মুসলমানদের মনে আবারও জিহাদের প্রেরণা জেগে উঠে, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে উঠে, ঘর-বাড়ী ছেড়ে মুক্তিকামী মানুষেরা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যুদ্ধ যাত্রার পূর্বে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ, যুদ্ধের হাতিয়ার- সরঞ্জাম, ঘোড়া, রসদ প্রভৃতি আনা শুরু হলো। আল্লাহর পথে জান কুরবান করার জন্যে হাজার হাজার মুজাহিদ তাঁর ঝান্ডার নীচে জমায়েত হতে লাগলেন। এভাবে যাত্রাকালে তাঁর মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ালো বারো হাজার। মুজাহিদরা ১২৪১ হিজরী সনের ০৭ই জমাদিউস সানি মোতাবেক ১৮২৬ ঈসায়ী সনের ১৭ই জানুয়ারী আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অত্যাচারী শিখদের এলাকায় উপনীত হন। উল্লেখ্য ইতিপূর্বে শিখদের সাথে মুসলিম বাহিনীর আরোও বেশ ক’টি যুদ্ধ হয়েছিল। যেমন-নওশেরার যুদ্ধ, সিদুর যুদ্ধ, আকুড়ার যুদ্ধ, পানজতারের যুদ্ধ, মায়ার যুদ্ধ, মর্দান যুদ্ধ ইত্যাদি।
সবকটি যুদ্ধেই শিখ’রা মোজাহিদ বাহিনীর সাথে পরাজিত হয়।
১২৪৬ হিজরী সনের ২৪ জিলক্বদ মোতাবেক ১৮৩১ ঈসায়ী সনের ০৬ই মে ঐতিহাসিক বালাকোটের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
বলাকোটের ময়দানে উপস্থিত হয়ে সাইয়্যিদ সাহেবের জ্ঞানচক্ষু খোলে গেল। তিনি দেখলেন তাঁর সম্মুখে মাত্র তিনটি পথ উন্মুক্ত রয়েছে।
(১): পুরুষোচিত সাহস ও শৌর্যবীর্য সহকারে বাতিলের মুকাবিলা করে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করার আপ্রাণ চেষ্টা করা, যাতে করে হকের জন্যে বিজয় সাফল্য সূচিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
(২): হককে পরিত্যাগ করে বাতিলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা।
(৩): হককে পরিত্যাগ না করা। বরঞ্চ হকের সংগে জড়িত থাকতে গিয়ে যেসব বিপদ আপদ ও দুঃখ কষ্ট আসবে, তা নীরবে সহ্য করা।
প্রথম পথটিই হলো জাতীয় আত্মমর্যাদার পথ, বীরত্ব ও সৎ সাহসের পথ। নবজীবন লাভ করে আত্মমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ।
দ্বিতীয়টি হলো মৃত্যুর পথ, জীবনের পথ নয়।
তৃতীয়টির পরিণাম এই হতে পারে যে ক্রমশঃ ধুঁকে ধুঁকে এবং যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার ভিতর দিয়ে জাতির জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। সাইয়্যিদ সাহেব প্রথম পথটিই অবলম্বন করেছিলেন। এ পথে চলার সকল যোগ্যতা ও গুণাবলী তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
রণকৌশল এবং যুদ্ধ পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে বীর সেনানী সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.) তাঁর মুজাহিদ বাহিনীসহ বালাকোটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত ভরপুর উপত্যকা ছাউনি স্থাপনের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন। পূর্ব দিক দিয়ে কুনহার বা কাগান পাহাড়ি নদী অবিরাম কুল কুল তানে বয়ে চলেছে। উত্তর পশ্চিম দিক থেকে সংকীর্ণ পাহাড়ি ঝর্ণা বড় বড় শিলা খণ্ডের ভেতর লুকোচুরি খেলা করছে, ঝর্ণার উত্তর দিকে ছিল প্রশান্ত নূরী এক ময়দান। প্রকৃতির এ লীলা ক্ষেত্রে প্রবেশ করলে মনে হয় কে যেন জীবন নদীর পরপার থেকে হাতছানি দিচ্ছে। রণক্লান্ত মুজাহিদগণ বিশ্রামের জন্যে এখানে ছাউনি পাতলেও পরপারের হাতছানি হয়তো তাঁদের দৃষ্টির অগোচর হয়নি। তাই বিশ্রাম তাঁদের ভাগ্যে ঘটেনি, বরং বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
যুদ্ধপূর্ব দিক নির্দেশনায় সেনাপতির দ্বায়িত্বে থাকা বীর খালিদের উত্তরসুরি হযরত সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.) মোজাহিদ বাহিনীকে বললেন, শিখ বাহিনী যতক্ষণ পর্যন্ত পাহাড় অতিক্রম করে সমতল ভুমিতে না পৌঁছে ততক্ষণ আমরা তাদের উপর আক্রমণ করব না, এবং আমরা কখনই তাদের উপর অতর্কিত হামলা করব না।
শিখ বাহিনীর বারবার পরাজয় পক্ষান্তরে ব্রিটিশদেরই পরাজয়, তাই সুযোগ সন্ধানি ব্রিটিশরা শিখদের পক্ষ নেয়। যেহেতু সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.) ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত তাই চতুর-মোনাফিক ব্রিটিশরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। এদিকে তারা সীমান্তবর্তী মোনাফেক পাঠান সর্দারদেরকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে খরিদ করে ফেলল এবং শিখদের সহযোগীতার জন্য পাঠিয়ে দিল। ইতিহাস সাক্ষী মোনাফিকরাই সব ধ্বংসের মুল, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি! মুসলমান নামধারী মোনাফেক পাঠান সর্দারেরা মোজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত হয়। মোনাফিক পাঠান সর্দারদের গুপ্ত খবরের উপর ভিত্তি করে যৌথ বাহিনী অর্থাৎ শিখ, ব্রিটিশ এবং মুসলমান নামদারি পাঠান মোনাফিকরা মোজাহিদ বাহিনীর উপর প্রস্তুতি নেয়ার পুর্বেই অতর্কিত হামলা করে বসে। মরনপণ এই যুদ্ধে রায় বেরেলীর পীর, কারবালার বীর সেনানীদের উত্তরসুরি সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) সহ ভারত মহাদেশে ইসলামী সম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা বীর মোজাহিদ সেনারা বাতিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন, এ যেন ছিল উহুদ যুদ্ধেরই পুনরাবৃত্তি।
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.) যে খুনরাঙা পথে চলার দুর্বার প্রেরণা দিয়ে গেলেন ভারতীয় মুসলমানদেরকে, বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পাঠান নির্বিশেষে ভারতীয় মুসলমানগণ সে খুনরাঙা পথে অবিরাম চলেছে প্রায় শতাব্দীকাল পর্যন্ত। জেল-জুলুম, ফাঁসি, দ্বীপান্তর, স্থাবর, অস্থাবর সম্পদের বাজেয়াপ্তকরণ, অমানুষিক ও পৈশাচিক দৈহিক নির্যাতন ক্ষণকালের জন্যেও তাদেরকে এ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তথাপি এ আন্দোলনের নেতা স্বয়ং নিজের জীবদ্দশায় কেন এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি, তার কারণও আমাদের চিহ্নিত করা দরকার। প্রধান কারণগুলি নিম্নরূপ বলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১. ইসলামী আন্দোলন তথা আল্লাহর পথে জেহাদ পরিচালনার জন্যে যে কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন, যেমন উত্তম চরিত্র, আদর্শ, আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত। এই ধরণের মুজাহিদের সংখ্যা এক থেকে দু’হাজারের মধ্যেই সীমিত ছিল । কিন্তু সীমান্তের পাঠানরদের সংখ্যা ছিল বেশি (প্রায় তিন লক্ষ), তাদের সত্যিকার কোন ইসলামী চরিত্র ছিল না। শুধু ছিল প্রেরণা ও জোশ। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র, অজ্ঞ, অর্থলোভী এবং বহুদিনের পুঞ্জীভূত কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। এদের অর্থলোভে বিশ্বাসঘাতকতা এবং চরম মুহুর্তে প্রতিপক্ষ শিখ সৈন্যদের সঙ্গে যোগদান বালাকোটের যুদ্ধের পরাজয়ের অন্যতম কারন।
২. স্বয়ং সাইয়্যিদ সাহেব বীরযোদ্ধা ও রণকৌশলী থাকা সত্ত্বেও গোটা মুজাহিদ বাহিনীকে তৎকালীন যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি।
৩. বিশ্বাসঘাতক ও চরিত্রহীন পাঠানদের প্রতি পূর্ণমাত্রায় আস্থা স্থাপন এবং সুলতান মুহাম্মদ খাঁ এবং তার ভ্রাতৃবৃন্দ, ‘যারা ছিল সাইয়্যিদ সাহেব বিরুধী” তাদের উপরে পেশাওরের শাসনভার অর্পণ ও অন্যতম একটি কারণ। কারণ সুলতান মুহাম্মদ খাঁই শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের উপর চরম আঘাত করে এবং একই রাতে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সাইয়্যিদ সাহেবের কয়েকশ’ বীরযোদ্ধা ও রণকৌশলী মুজাহিদের প্রাণনাশ করে।

উপসংহার
ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) শাহাদাতের স্বাদ গ্রহণ করলেন। তাঁর সাথীদের অনেকেই শাহাদাতবরণ করলেন। আহত হলেন অনেকে। বন্দী হলেন আরোও অনেক। আপাতত এক মহান বিপ্লবের পতন ঘটল। এভাবেই মর্দে মুজাহিদ সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)-এর বালাকোট অধ্যায়ের শেষ হলো। সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ছিলেন আপোসহীন নেতা। ইসলামের একনিষ্ঠ এই সাধক দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে ছিলেন অটল-অবিচল। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শাহাদাতের পথ বেছে নিলেন, কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করলেন না। জীবনের বিনিময়ে তিনি সত্যের পথে লড়াই করলেন। তাঁর এই দৃঢ়তা ও অনবদ্য প্রেরণা আজও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানকে অনুপ্রাণিত করে, আবেগতাড়িত করে। সত্যপথের যাত্রীরা সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র আদর্শ নিয়ে আজও কাজ করছে। দুনিয়ার দেশে দেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে তারা জীবন উৎসর্গ করছে। রায় বেরেলীর জঙ্গী পীরের সেই বিপ্লবের আগুন নির্বাপিত হয়নি, বরং সে আগুন ছড়িয়ে গেছে সারা বিশ্বে। যেখানেই অন্যায়, সেখানেই আছে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র মতো সাহসী ও আপোসহীন সৈনিক। কেউ এদের শেষ করতে পারবে না। কেননা, আল্লাহর পথে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র মৃত্যু নেই। সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.)’র এই ত্যাগের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবির ভাষায় বলতে হয়:
‘যুগ যামানা পাল্টে দিতে চাইনা অনেকজন এক মানুষই আনতে পারে জাতির জাগরণ’
তথ্যসুত্র
(১) তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া, মুজিবুর রহমান।
(২) সাইয়েদ আহমদ শহীদ, গোলাম রসূল মেহের
(৩) স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, আবু জাফর।
(৪) তাওয়ারিখে আজমিয়ার, গোলাম রসূল মেহের।

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *