সলফে সালেহিনের সুযোগ্য উত্তরসূরী আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

(প্রখ্যাত বুযুর্গ খলিফায়ে ফুলতলী আল্লামা মো. শুয়াইবুর রহমান বালাউটি ছাহেব (র.)-এর নিকট থেকে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর জীবনের বিভিন্ন বিষয়াবলীর বর্ণনা সম্বলিত একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে সুলতানুল আরেফিন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের বর্ণনা রয়েছে। সাক্ষাৎকারের একটি জিজ্ঞাসার জবাবের অংশটি দেয়া হল।) জিজ্ঞাসাঃ হুজুর, বেয়াদবী মাফ করবেন। আমরা জানতে চাই- আপনার দৃষ্টিতে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কেমন ছিলেন এবং তাঁর প্রতি আপনার কী ধরণের মহব্বত ছিল?
জবাবঃ কথায় আছে-‘যে জানে সে মানে।’ আর বাস্তবেও তাই। কোনো মানুষ তখনই একজন ব্যক্তিকে উপযুক্ত মর্যাদায় তাযিম করে তাঁর সাথে মহব্বতের সম্পর্ক সৃষ্টি করে যখনই সেই ব্যক্তির গুণাগুণ ও মর্যাদা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হয়। ইতিহাস প্রমাণ করে যে, যুগে যুগে এ নশ্বর পৃথিবীতে মহান আল্লাহর এমন অনেক প্রিয় বান্দা আবির্ভূত হয়েছেন, স্বল্পজ্ঞান ও স্থূল দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের পক্ষে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহর সে-সব মকবুল বান্দাদের সম্পর্কে তারাই জ্ঞাত যারা চক্ষুষ্মান। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সম্পর্কে মন্তব্য করা আমার মতো লোকের সাজে না। কারণ ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তাকে পুরোপুরি চিনতে হবে এবং তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট জানতে হবে। এরপরও যখন জানার একান্ত আগ্রহ তাই সংক্ষেপে বলছি- আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সলফে সালেহিনের একজন সুযোগ্য উত্তরসূরী ও অনুসারী ছিলেন। তাঁর অনুসরণই সলফে সালেহিনের অনুসরণ, আওলিয়ায়ে কেরামের অনুসরণ, সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ। একজন মানুষ অনুসরণীয় হওয়ার জন্য যতগুলো গুণ প্রয়োজন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন সেসব গুণেই গুণান্বিত।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ছাত্রজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ অপরিণত বয়সে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর বুজুর্গি সম্পর্কে আমি তেমন ওয়াকিবহাল ছিলাম না। অথবা বলা যায়, ওয়াকিবহাল হওয়ার মতো তেমন সমঝও আমার ছিল না। যার দরুন পরবর্তীতে যখন কাফিয়া জামাতে অধ্যয়নরত তখন জৌনপুরী সিলসিলার প্রখ্যাত বুযুর্গ কুতবুল আউলিয়া হযরত আল্লামা বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর দস্ত মোবারকে বায়আত হই। কিন্তু আলিম জামাতে অধ্যয়নকালে, ফাইনাল পরীক্ষার মুখোমুখি এমন সময়ে একটি মধুময় স্বপ্ন দেখে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর বুজুর্গি ও উচ্চ মাকাম সম্পর্কে সম্যক অবগত হই। তোমাদের একান্ত কাকুতিমিনতিতে স্বপ্নটা উল্লেখ করছি।


আলিম ফাইনাল পরীক্ষার আগে ইছামতি দেওয়ানেরচক মসজিদের তৎকালীন ইমাম খাশিরচক নিবাসী মাওলানা আব্দুছ ছবুর (ছৈয়াব আলী) সাহেবের সাথে উক্ত মসজিদে এতেকাফে ছিলাম। একদিন স্বপ্নে দেখলাম, আল্লামা বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ (র.) একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পুকুর পাড়ের নিকটে কাঠের তৈরি অত্যন্ত চমৎকার নতুন একটি চেয়ারে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-কে বসিয়ে রেখেছেন। তখন আমি বুঝতে পারছি যে, ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র সামনে মাটির বড় এক ঢিবি আর সেই ঢিবির নিচে রয়েছে কূপ, সেই কূপে ইবলিসকে জীবিত দাফন করে রেখেছেন আল্লামা বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ (র.)। তখন আমি দেখলাম, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ যে-চেয়ারে বসে আছেন এর পাশে মাটির ছোট ছোট ঢেলা রাখা। ইবলিসটি যখনই মাটির ঢিবি সরিয়ে কূয়া থেকে উপরে উঠার চেষ্টা করে তখনই ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ একটি ঢেলা নিয়ে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতে করিমা তিলাওয়াত করতঃ হাত তুলে ঢিল মারার চেষ্টা করেন এমনিতে ইবলিসটি নিচের দিকে চলে যায়। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, আয়াতে করিমাটি ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র মোবারক মুখ থেকে বের হচ্ছে কিন্তু তিলাওয়াতের আওয়াজ আসছে আসমান থেকে। আর তিলাওয়াতের আওয়াজের ফলশ্র“তিতে (আগুন যেমন মোমকে গলায়, ঠিক সেভাবে) আমার হৃদয় বিগলিত হয়ে ঘুমের মধ্যে কাঁদছি। এদিকে কাছেই ছিলেন মাওলানা ছৈয়াব আলী ছাহেব। তিনি দেখলেন, আমি ঘুমের মধ্যে শব্দ করে কাঁদছি। তাই তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলতে লাগলেন- ‘এইতো সহী-সালামতে কিতাব পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলেন। এর মধ্যে কী হলো যে, এতো শব্দ করে কাঁদছেন!’ আমি তখনও স্বপ্নের ঘুরে। দেখলাম, আমার চোখে তখনও অশ্র“ জমে আছে। এছাড়া ঘুমের ভেতর এতো কেঁদেছি যে, অশ্র“তে পাটি ভিজে মাটি পর্যন্ত ভিজে গিয়েছে। সেদিন থেকে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর প্রতি আমার গভীর মহব্বত, অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ ও অনাবিল আকর্ষণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। যদিও বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ইন্তেকালের পরদিন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর দস্ত মোবারকে বায়আত লাভের সৌভাগ্য আমার নসিব হয়।
এছাড়া আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর সাথে আমার কতটুকু মহব্বতের সম্পর্ক এটা তোমাদের কী করে বুঝাবো। তবে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় থেকে কিছুটা বুঝে নেয়া যাবে। তিনি আমার ছাত্রজীবনের (মাদরাসায় ভর্তির) প্রথম অনুপ্রেরণাদাতা। আমার পীর ও মুর্শিদ। আমার কর্মজীবনের প্রথম নির্দেশক। আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ পরামর্শদাতা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)। তাছাড়া আমার মরহুম ওয়ালিদ ছাহেবেরও তাঁর সাথে গভীর মহব্বতের সম্পর্ক ছিল। আমাদের সব ভাইবোনের নাম ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) রেখে দিয়েছিলেন। ভাইবোনদের নাম যাথাক্রমে ছিল- মোঃ হাবিবুর রহমান(গলই মিয়া), মোঃ শুয়াইবুর রহমান, মোঃ আব্দুর রহমান, মোছা. ফাতিমা বেগম, মোছা. ছফুরা বেগম এবং মোছা. রহিমা বেগম। সুতরাং তাঁর প্রতি আমার কতটুকু মহব্বত থাকতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *