ত্বরীকতের তিনটি মৌলিক ধারা ও ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়া

ত্বরীকত শব্দটি আরবি। যা ত্বারীকুন থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ হলো জনপথ বা রাস্তা, নিয়ম-কানুন, পদ্ধতি, প্রণালি, নির্দেশিকা, দিশারি ইত্যাদি। তাসাঊফ শাস্ত্রের পরিভাষায় পথচলার নির্দেশনা অনুযায়ী যে পথ ও মত অবলম্বন করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, তাঁরই জ্যোতির্ময় সত্তায় সমাহিত হওয়া যায়, তাঁরই দিদার লাভ করা যায়, তাকেই ত্বরীকত বলা হয়।
মানবাত্মার মুক্তির নির্দেশনা নিযে়ই মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন। হযরত আলী (রাদ্বি.) ছিলেন সেই নির্দেশনার যোগ্য উত্তরাধিকারী। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুমতিক্রমে হযরত আলী (রাদ্বি.) ত্বরীকতকে তিনটি মৌলিক ধারায় বিভক্ত করে তিন জনকে দায়িত্বভার দিয়ে যান। ১. ত্বরীকাযে় আরবাযে় মুজাহিদীনের নেতৃত্ব দান করে যান তদীয় পুত্র হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (রাদ্বি.) কে। ২. ত্বরীকায়ে আখাইয়ারে সালেহীনের দায়িত্ব অর্পণ করে যান হযরত হাসান বসরী (রহ.) ৩. ত্বরীকায়ে হুব্বে রাসুল বেলায়ত করেন হযরত ওয়াইস কুরুনী (রহ.)-কে।
প্রকাশ থাকে যে, ত্বরীকতের এই তিনটি মৌলিক ধারা থেকেই আজকের মুসলিম বিশ্বে হাজার হাজার ত্বরীকার সৃষ্টি হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব বিখ্যাত ও গ্রহণযোগ্য ত্বরীকা ত্বরীকায়ে কাদরিয়া, ত্বরীকায়ে চিশতিয়া, ত্বরীকায়ে নক্শবন্দিয়া, ত্বরীকায়ে মুজাদ্দেদিয়া, ত্বরীকায়ে সুহরাওয়ার্দিয়া, ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়ার সৃষ্টি।
তেরশত হিজরির মুজাদ্দিদ, বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার আমিরুল মোজাহিদিন, খোলাফায়ে রাশিদুন এর জ্বলন্ত নমুনা, ঐতিহাসিক বালাকোটের অমর শহীদ, ভারত উপমহাদেশের সুদক্ষ রাহবার হযরত সায়্যিদ আহমেদ শহীদ (রহ.) হলেন ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মহান মুরশিদ। আসলে মুসলিম বিশ্বে সমাদ্রিত এবং সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য সকল ত্বরীকার মূল নির্যাস হলো ‘ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়া।’ উপরিউক্ত ত্বরীকতের তিনটি মৌলিক ধারার সমন্বিতরূপ হলো ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়া। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয় যে শহীদে কারবালা ইমাম হুসাইন (রাদ্বি.) এর জিহাদী চেতনা, ইমাম হাসান বসরী (রহ.) এর আধ্যাত্মিকতা এবং হযরত ওয়াইস কুরুনী (রহ.) এশ্ক ও মহব্বতের সম্মিলন ঘটেছে ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়ার পরতে পরতে। তার প্রমাণ বহন করে নিম্নের কথামালা থেকে।
কলকাতার মাওলানা গেলাম সুবহান মুর্শিদ ক্বিবলাকে ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়া নাম রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে জবাবে সাইয়্যিদ সাহেব বলেন, ‘মনে কর, এক বাদশাহ কোন শহরে ছিল। ঐ বাদশাহের নানা প্রকার কারিগরী এবং শিল্পের প্রতি খুব আগ্রহ। এই কারণে ঐ শহরে কারিগর আছে সকলেই নিজ নিজ কারিগরী ও শিল্প কার্যানুযায়ী বাদশাহকে সন্তুষ্ট করে এবং এর দ্বারা বাদশাহর নৈকট্য পদ মর্যাদা লাভ করে। তারা সবাই বাদশাহর প্রিয় পাত্র। তাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি এমন করতে থাকেন যে, তিনি সমস্ত প্রকার কারিগরী ও শিল্প কাজ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ এবং সে নিকটতম ব্যক্তি। আর সে ব্যক্তি সর্বদাই বাদশাহর নিকটে থাকে, যাকে বাদশাহ প্রযে়াজন মত তার দ্বারা যে সময় সে কাজের দরকার সে কাজ করাতে পারেন। অতএব এ থেকে বুঝে নিবে আমাদের দ্বীনের যত ধর্মীয় আমির অতিবাহিত হয়েছেন, যেমন- হযরত গাউসুল আজম বড়পীর (রহ.), হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.), হযরত বাহাউদ্দীন নক্শবন্দী (রহ.), তাঁরা সকলেই ছিলেন আমাদের দ্বীনের (ইলমে শরীয়ত ও ত্বরীকতের) ইমাম।
আর এই সমস্ত বুঝুর্গানে দ্বীনের ত্বরীকায় আমি বাইয়াত হয়েছি। আমি দাবি করি না যে, আমি তাঁদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আমাকে তাঁদের ত্বরীকায় চলার দরুণ আল্লাহ পাক এমন যোগ্যতা দান করেছেন, যার জন্য যিকিরের মধ্যে মশগুল থাকি এবং আল্লাহ পাক হুজুরে পুর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে খাস করে সে নিয়ামত দান করেছেন তা হতে উম্মত হিসেবে এই অধম বান্দাহকে সামান্য কিছু দান করেছেন। তাহলে- জিহাদের হুকুমকারী এবং ক্বিসাস চালু এবং শিরক ও বিদআতের প্রতিরোধ করা ইত্যাদি। মহা মহিমান্বিত আল্লাহপাকের মেহেরবানিতে নিজের মধ্যে এই সমস্ত কাজ চালু করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা পাচ্ছি। আর আল্লাহপাক আমাকে এমন ক্ষমতা দান করেছেন, যার ফলে আমি এমন ধারণা ও ইচ্ছা পোষণ করছি যে, কাফিরদের মোকাবিলায় ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধের অস্ত্রযুদ্ধের পোশাক পরিধান করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কালিমার আওয়াজ বুলন্দ করার মানসে ঐ কাফিরদের সঙ্গে জিহাদ করব, আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় নিজের হাতে পরিখা খনন করব, কুঠার নিযে় লাকড়ি ফাড়ব এবং হুদুদ কিসাস জারী করতে পারব। অতএব এই বিশেষ নিয়ামতের বদৌলতে আনন্দচিত্তে নিজের তরীকার নাম ‘তরীকায়ে মোহাম্মদিয়া রেখেছি।’
এছাড়া ইসলামী আন্দোলন হলো যুগপৎ আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র সংশোধন করা। তাযকিয়ায়ে নফস বা ব্যক্তির আত্মপরিশুদ্ধি ব্যতীত যেভাবে শুধু রাজনীতি গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন বাদ দিয়ে কেবল শুধু আধ্যাত্মিক চর্চা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খুলাফাযে় রাশিদুন এর পথ নয়। ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার ও তাঁর সৈনিকদের মধ্যে যেমন থাকবে ইবাদত-বন্দেগী জিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলিল, দোয়া, দরূদ, মোজহাদা, মোশাহাদা, ঠিক তেমনি থাকবে দ্বীনি প্রযে়াজনে মিটিং মিছিল, সভ-সমাবেশ, বিক্ষোভ, সংগ্রাম, সংঘাত, জেল-জুলুম, নির্বাসন, ফাঁসির মঞ্চ ও শাহাদত। যারা রুহানীয়াত চর্চার নামে ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন পরিহার করেন তাদের দ্বারা যেমন দ্বীন কাযে়ম করা সম্ভব নয় তেমনি যারা রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে রোহানীয়াতকে অস্বীকার করেন তাদের দ্বারাও ইসলামী রাজ্য কাযে়ম করা অসম্ভব। রুহানীয়াত বা আধ্যাত্মিকতাহীন আন্দোলন নিছক রাজনীতি মাত্র। আবার আন্দোলনহীন বা সংগ্রামহীন রুহানীয়াত বৈরাগ্যবাদেরও নামান্তর। এই উভয় দিকের সম্বনযে়র নাম হলো হক্কানিয়াত। আর এই হক্কানিয়াতের ধারক ও বাহকই হলো হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভীর ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়া।
রামপুরে অবস্থানকালে হযরত সাইয়্যিদ আহমেদ শহীদ (রহ.) কে ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়া স্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে তিনি বলেন, ‘ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়ার তাৎপর্য এই, প্রত্যেক মানুষের প্রতিটি কাজ যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়। যেমন পাপ থেকে বিরত থাকার জন্য বিবাহ করা, শরীয়ত সিদ্ধ নিয়মে অন্ন সংস্থানের জন্য বৈধ সম্পদ সংগ্রহ করে নিজেকে ও পরিবারবর্গকে পরমুখাপেক্ষী হতে না দেওয়া, রাতের শেষ দিকে তাহাজ্জুদ নামায ও ইবাদত করার উদ্দেশ্যে প্রথম দিকে নিদ্রা যাওয়া। এভাবে জীবনের প্রতিটি কাজে একমাত্র খোদার সন্তুষ্ট লাভকেই মূল উদ্দেশ্য মনে করা ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়ার সার। অর্থাৎ চার ত্বরীকা মোতাবেক যিকির, ফিকর, মোরাকাবা করার সাথে সাথে জীবনের সকল কর্ম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ত্বরীকা মোতাবিক খালিছ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন করার উপর প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করাই ত্বরীকায়ে মোহাম্মদিয়ার মূল উদ্দেশ্য। ’

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *