সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) : জীবন ও কর্ম

মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রায় সোয়া লক্ষেরও বেশী নবী-রসুল আলাইহিমুস সালাম এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আখেরী যামানার রসুল হুযুর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের মাধ্যমে নবী-রসুল আলাইহিমুস সালাম আগমনের ধারা চিরতরে বন্ধ হযে় গেছে। এখন আর নবী-রসুল আলাইহিমুস সালাম আসবেন না। কিন্ত আল্লাহ পাক মানব জাতির হেদায়েতের জন্য হাদী তথা হেদায়েতের পথে আহবানকারী প্রেরণের ধারা বন্ধ করেননি; বন্ধ করবেনও না।
এ বিষয়ে নবীদের নবী, রসুলদের রসুল, হুযুর পূর নূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
‘হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে জেনেছি। হযরত রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমায়েছেন, (আমার পরে) নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক এ উম্মতের হেদাযে়তের জন্য প্রতি শতাব্দির শেষে আথবা শুরুতে এমন একজন মানুষ প্রেরণ করবেন, যিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে (ইসলাম ধর্মকে) সংস্কার করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদীস শরীফ নং-৪২৯১)
সমযে়র ধারাবাহিকতায় ১৩শত হিজরী শতাব্দিতে মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে যিনি এ সুমহান দায়িত্ব পেযে়ছিলেন তিনি হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ।

সংক্ষিপ্ত জীবনী মোবারক
‘মাখযানে আহমদী’ কিতাবের বর্ণনা মোতাবেক ৬ই সফর, ১২০১হিজরী মোতাবেক ১৭৮৬ ঈসায়ী সালের ২৯শে নভেম্বর সোমবার, এমনি এক পবিত্রতম দিনে ভারতের উত্তর প্রদেশের রায় বেরেলীর সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) জন্মগ্রহণ করেন। উনার বাবার নাম সাইয়্যিদ মুহম্মদ ইরফান (র.) ।
মাত্র চার বছর বয়স থেকেই সাইয়্যিদ ছাহেবের শিক্ষা জীবন শুরু হয়ে যায়। পারিবারিক তরবিয়তের পাশাপাশি উনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হয়। তখনতো বর্তমান যামানার মত বিদ্যালয় ছিলনা, ছিল-মসজিদ, মক্তব ও আউলিয়ায়ে কেরামগণের খানকা শরীফ ভিত্তিক ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা। এমনি শিক্ষা ব্যবস্থায় হযরত সাইয়্যিদ আহমদ (র.) শিক্ষা লাভ করেন। প্রসিদ্ধ মোহাদ্দিস হযরত শাহ ইসহাক দেহলভী (র.) ছিলেন উনার প্রধানতম উস্তায গণের অন্যতম। উনার কাছ থেকে ইলমে শরীয়তে পাণ্ডিত্ব অর্জন করেন। অতপর ইলমে মা’রিফাতে দ্বীক্ষা গ্রহণ করতে পিতা-মাতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দিল্লী পৌঁছেন। সেখানে পৌঁছার পর সরাসরি ইমামুল মুহাদ্দিসীন, শায়খুল-মাশায়েখ শাহ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) -এর নিকট উপস্থিত হয়ে উনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। অতি অল্পদিনেই ইলমে তাসাওউফের সু-উচ্চ মাকামে আরোহন করেন। শাহ ছাহেব (র.) উনাকে খেলাফত দান করেন। খেলাফত লাভের পর সাইয়্যিদ আহমদ (র.) কঠিন ভাবে রিয়াজত-মোশাক্কাতে আত্মনিয়োগ করেন। রাতের বেলা নিদ্রায় গিয়েছেন এমন ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তাই ইলমে বাতিনের সব মাকামই উনার অর্জিত হয়ে যায় অতি সহজেই। এমনকি তাঁর মধ্যে কামালতে নুবুওওয়াতের নিসবতও পরিপুর্ণরূপে বিকশিত হয়েছিল।
একারণেই উনার মুরশীদ কিবলা শাহ ছাহেব (র.) উনার মুরীদগনকে সাইযি়্যদ ছাহেবের সোহবতে পাঠিয়ে দিতেন। বলতেন, আমার নিকট বার বৎসরে যা হাসিল হবেনা হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) এর নিকট তা বার দিনে হাসিল হবে। (সুবহানাল্লাহ)
হযরত শাহ ছাহেব (র.) এর নিকট কেউ মুরীদ হতে আসলে নিজে মুরীদ না করে হযরত সাইযি়্যদ ছাহেব (র.) এর নিকট পাঠিয়ে দিতেন। শুধু তাই নয়; আল্লামা রুহুল আমিন বশিরহাটি (র.) কর্তৃক লিখিত একখানা বিজ্ঞাপন রদ কিতাবের ৮৪ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, হযরত সাইযি়্যদ ছাহেব (র.) এর পীর ও মুরশীদ শাহ ছাহেব (র.) স্বীয় মুরীদ সাইয়্যিদ আহমদ (র.) এর নিকট মুরীদ হওয়ারও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। (সুবহানাল্লাহ)

পবিত্র হজ্বে গমন ও যিয়ারতে হারামাইনিশ শরীফাইন :
সীরাতে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ ও সাওয়ানেহ আহমদী ইত্যাদি কিতাবের বর্ণনা মোতাবেক জানা যায়, হযরত সাইয়্যিযদ ছাহেব (র.) ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে হজ্বে গমন করেন। পথিমধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো লোক উনার ছফরসঙ্গী হয়। সাইযি়্যদ ছাহেব (র.) যখন মসজিদে হারাম শরীফে প্রবেশ করেন তখন হারাম শরীফের ইমাম ছাহেবগণ সহ অনেক মাশাযে়খে এজাম উনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন। হজ্বের কাজ সমাধা করে মদিনা শরীফ গমন করেন। দরবারে রেসালতে হাজির হয়ে ফয়েজ ফুয়ূজাত হাসিল করেন। সেখানেও অনেক ওলামা-মাশাযে়খ উনার হাতে বাইয়াত হন।

বালাকোটের জিহাদ:
ভারতের মারাঠা ও পাঞ্জাবের সীমান্ত এলাকায় শিখদের অত্যাচারের মাত্রা সীমাতিক্রম করেছিল। সে সকল এলাকাগুলোতে মুসলমানদের জন্য বসবাস করা সম্পুর্ণরূপে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জুলুম নির্যাতন এতই বৃদ্ধি পেযে়ছিল যে এই জালিম শয়তানেরা মুসলিম নারীদেরকে দাসীরূপে ব্যবহার করত। সীমান্তে মুসলমানদের ফসলাদি বিনস্ট করত; ঘর বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিত। মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করত। মসজিদগুলোকে ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করেছিল। আজানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
জাহিলীযোগে যেরকম মানবতা একজন নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল, তেমনি ভারত উপমহাদেশ একজন কান্ডারীর অপেক্ষায় চিৎকার করছিল। এমনি সঙ্কট মুহুর্তে আমিরুল মুমিনীন, মোজাহিদে মিল্লাত, হযরত সাইযি়্যদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) মানবতার মুক্তি ও ইসলামের সুমহান মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার নিমিত্তে জিহাদের ডাক দিলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মর্দে মোজাহিদগণ ঘর-বাড়ী ছেডে় জিহাদের প্রস্তুতি নিলেন। ১২৪১ হিজরী সনের ০৭ই জমাদিউস সানি মোতাবেক ১৮২৬ ঈসায়ী সনের ১৭ই জানুয়ারী আল্লাহ’র রাস্তায় জীহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অত্যাচারী শিখদের এলাকায় উপনীত হন। শিখদের সাথে মুসলিম বাহিনীর বেশ ক’টি যুদ্ধ হযে়ছে। যেমন-নওশেরার যুদ্ধ, সিদুর যুদ্ধ, আকুড়ার যুদ্ধ, পানজতারের যুদ্ধ, মায়ার যুদ্ধ, মর্দান যুদ্ধ ও বালাকোটের যুদ্ধ ইত্যাদি।
উপরের কোন যুদ্ধেই শিখ’রা মোজাহিদ বাহিনীর সাথে পেরে উঠেনি। অবশেষে ১২৪৬ হিজরী সনের ২৪ জিলক্বদ মোতাবেক ১৮৩১ ঈসায়ী সনের ০৬ই মে ঐতিহাসিক বালাকোটের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের পুর্বে হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) মোজাহিদ বাহিনীকে বলেছিলেন, শিখ বাহিনীর উপর আমরা অতর্কিত হামলা করবনা তাই তারা টিলা অতিক্রম করে সমতলে আসার পূর্বে তোমরা কখনোই আক্রমন করবেনা।
প্রিয় পাঠক! হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) এর গায়ে শেরে খোদা হযরত আলী রদিয়াল্লাহু আনহুর রক্ত প্রবাহিত। সুতরাং উনার নাম মোবারক শুনে ভয় পওয়ারই কথা। আর শুধুমাত্র শিখ বাহিনী একাকি উনার মোকাবিলায় ঠিকে থাকার কথা না। যেহেতু সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন তাই চতুর ইংরেজরা শিখদের পক্ষ নেয়। ইংরেজরা সীমান্তবর্তি মোনাফেক পাঠান সর্দারদেরকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শিখদের সহায়তার জন্য নিযুক্ত করে। এই মুসলমান নামধারী মোনাফেক পাঠান সর্দারেরা মোজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত হয়। এটা মোজাহিদ বাহিনী টের পাননি।
এই মোনাফিক পাঠান সর্দারদের গুপ্ত খবরের উপর ভর করে (শিখ+ইংরেজ+মোনাফিক) যৌথ বাহিনী এমন সময় অতর্কিত হামলা করে বসে যখন গোটা মোজাহিদ বাহিনী যার-যার ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মোজাহিদ বাহিনী একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেলেন না। আমীরুল মু’মিনীন হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) সহ অনেকেই জিহাদরত অবস্থায় শহীদ হন।

একটি অলৌকিক ঘটনা:
বালাকোটের জিহাদ শেষ হওয়ার পরে হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) এর লাশ মোবারক পাওয়া যায়নি। আজ বালাকোটের ১৮৩ বছর চলতেছে এ পর্যন্ত কেউ শহীদে বালাকট সাইযি়্যদ ছাহেব (র.) এর মাজার শরীফের পরিচয় দিতে পারেনি। এখানে কি হেকমত নিহিত। b r পাঠক! ঘটনা হলো-একবার মোরশীদুল মোরশীদ সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) এর মুরীদগণ উনাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে ছিলেন। এরি মধ্যে উনারা আরজ করলেন যে হুযুর আপনি তো হলেন গোটা ভারতবর্ষের সকল পীরগণের পীর ও মুর্শিদ। ভারত বর্ষের মুসলমানদের যে অবস্থা আপনার ইন্তেকালের পরে মানুষ আপনার জিসিম মোবারক কবরে না রেখে মাথায় নিযে় ঘুরে বেড়াবে। মুরিদানদের এহেন প্রশ্নের জবাবে উনি বললেন, তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ পাক আমার সাথে তিনটি ওয়াদা করেছেন। এক. আমি ও আমার মোজাহিদ বাহিনী যেখানেই থাকি কুদরতি রিযিকের ব্যবস্থা করবেন। দুই. আমাকে কোন যাদু-টোনা করা হলে কিংবা বিষপান করালে তা কোন ক্রিয়া করবেনা। তিন. আমার ইন্তেকালের পরে কেউই আমার লাশ খুঁজে পাবেনা। (সাওয়ানেহ আহমদী, সীরতে সাইয়্যিদ আহমদ র., ওয়াসীলে ওয়াজীর আলা তরীকুল বশীর ওয়ান নাযীর)
সত্যিই মোজাহিদ বাহিনী কুদরতি রিযিক পেযে়ছিলেন। সিধুর যুদ্ধে সাইযি়্যদ ছাহেব (র.) কে বিষপান করা হয়েছিল কিন্ত তা কোন ক্রিয়া করেনি। আর ইতিহাস হযরতের লাশ মোবারকের সন্ধান আজো দিতে পারেনি।

হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) -এর উপর আরোপিত অপবাদ সমূহের খণ্ডন :
আওর মুহম্মদিয়া তরীকা প্রসঙ্গঃ হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) এর বিরুদ্ধে যে সকল মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো তরীকায়ে মুহম্মদিয়া বা আওর মুহম্মদিয়া তরীকা নিয়ে। বলা হয়, এই আওর মুহম্মদিয়া তরীকা নাকি আরবের নজদ প্রদেশের ইবনে ওহাব নজদী প্রবর্তিত “মুহম্মদী আন্দোলন”-এর একটি অংশ। (নাউজুবিল্লাহ)
পাঠক!এ অপবাদের জবাব দেয়ার আগে ইবনে ওহাব নজদী সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া জরুরী মনে করি।
ইবনে ওয়াহাব নজদীঃ তার নাম মুহম্মদ। বাবার নাম আব্দুল ওহহাব। ১১১৫ হিজরী মোতাবেক ১৭০৩ ঈসায়ী সনে সে জন্মগ্রহন করে। তার বাবা আব্দুল ওহহাব খুব বড় আলেম ছিলেন। কিন্ত সে বাবার আদর্শ পরিত্যাগ করে নতুন মতাদর্শ আবিস্কার করে।
এই শয়তানের শিং-এর কুফরী আক্বিদার কয়েকটি নিম্নরূপঃ
০১। একমত্র তার অনুসারীরা-ই মুসলমান বাকি সবাই কাফের। নাউযুবিল্লাহ
০২। হুযুর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসুল ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ‘তারেশ’ (বাহক) । নাউযুবিল্লাহ
০৩। নবীজীর শানে দরূদ শরীফ পাঠ করা মাকরূহ। নাউযুবিল্লাহ
০৪। জুম’আর খুতবায় ঘোষনা দিত, নবীর ওসিলা নেওয়া শিরক। নাউযুবিল্লাহ
০৫। তার মতে ইসলামের ভিত্তি ছয়টি। কালেমা, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ও তার অনুগামী হওয়া।
০৬। কছিদাযে় বুরদা সহ দরূদ শরীফের কিতাব পড়া বিদয়াত। তাই সে এগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে ছিল।
০৭। কবর যিয়ারত করা কবর পুঁজার সামিল। নাউযুবিল্লাহ
০৮। মাযহাব বলতে কোন কিছু নেই। ইমামগণের অধিকাংশের কথাই মিথ্যা। যদিও তার অনুসারীরা তাকে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী বলে থাকে।
শুধু কি তাই?এই বেঈমান হযরত ছাহাবায়ে কেরাম রিদ্বওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈনগণের মাযার শরীফ ভেঙ্গে সমতল করে দিয়েছিল, এমন কি দয়াল নবীজী হুযুর পুর নূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা শরীফ ভাঙ্গার জন্য লোক প্রেরণ করেছিল, আল্লাহ পাক সাপ পাঠিয়ে এদের ধ্বংস করে দেন।
এখানেই তার শয়তানি শেষ নয় আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অনুসারী অসংখ্য ওলামায়ে কেরামগণকে সে হত্যা করেছিল। মসজিদে নব্বী শরীফের বিছানাগুলো জ্বালিযে় দিযে়ছিল, মূল্যবান বাতিগুলো নজদে নিয়ে গিয়েছিল।
এই শয়তানের শানেই হযরত নবীযে় করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, ইমাম বুখারি রহমতুল্লাহি আলাইহি তা কিতাবুল ফিতানে (হাদীস শরীফ নং-৭০৯৪) উল্লেখ করেছেন, হযরত ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচনা করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের সিরিয়ায় বরকত দাও। হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের ইয়ামানে বরকত দাও। লোকেরা বলল, আমাদের নজদেও। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের সিরিয়ায় বরকত দাও। হে আল্লাহ! আমাদের জন্য বরকত দাও আমাদের ইয়ামানে। লোকেরা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহু! আমাদের নজদেও। (বর্ণনাকারী বলেন) আমার মনে হয়, তৃতীয়বারে তিনি বললেন : ‘হুকাকায যালাযিলু ওয়াল ফিতানু ওয়াবিহা ইয়াত্বলুউ ক্বারনুশ শয়তান’ সেখানে তো কেবল ভূমিকম্প আর ফিতনা। আর তথা হতে শয়তানের শিং উদিত হবে। আলোচনাউক্ত হাদিস শরীফের ভাষ্য পাল্টানোর জন্য এবং ইবনে ওহহাব নজদীকে উক্ত হাদিস শরীফের আওতামুক্ত করতে অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নজদ বলতে ইরাক’কে বুঝানো হয়েছে। আর ইবনে ওহহাব তো ইরাকী নয়। জবাব অনেক লম্বা, আমি বিস্তারিত লিখবনা শুধু একটা কথাই বলব। পাঠক!আপনারা সবাই জানেন, হজ্বের ইহরাম বাধার জন্য বিশ্ববাসীর নির্ধারিত মীকাত আছে। আর সেগুলোর মধ্যে নজদের জন্য মীকাত হলো-“করনুল মানাযিল”। যেমন বুখারী শরীফের ১৫২৬ নং হাদিস শরীফসহ আরো অনেক হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, ‘ওয়ালি আহলি নাজদিন কারনুল মানা-যিলা’ ‘নজদবাসীদের মীকাত হলো করনুল মানাজিল’। কিন্ত ইমামে আ’যমের ইরাক, তার মীকাত হলো ‘যাতে ইরক।’ যেমন বুখারী শরীফের কিতাবুল হজ্বের ১৩ নং বাবের নাম হলো, “বাবু যাতু ইরাকিন লিআহলিল ইরাকি” “ইরাকবাসীর মীকাত হলো যাতে ইরক”। মীকাতের ভিন্নতায়ই প্রমাণ করে নজদ আর ইরাক ভিন্ন দুটি এলাকা।
এই ইবনে ওহহাব নজদী সম্পর্কে হানাফী ফিকহের অন্যতম নির্ভরযোগ্য কিতাব ফতওয়া-ই শামী’র কিতাবুল জিহাদের বাবুল বুগাতে উল্লেখ আছে, ‘খারেজী ইবনে ওহহাব নজদ থেকে বের হযে়ছে। তারা কা’বা শরীফ মদিনা শরীফ দখল করে (সেখানে তান্ডব চালিয়েছিল) এরা নিজেদেরকে হাম্বলী বলে (ভূয়া) পরিচয় দিযে় থাকে। তার অনুসারীদের আকীদা হলো, যারা তাদের (কুফরী) মতবাদের বিপরীত আকীদা পোষণ করবে তারা সকলেই মুশরেক। (নাউযুবিল্লাহ) আহলে সুন্নাহ’র অনুসারীদেরকে কতল করেছিল তারা এটা বৈধ মনে করত। এরা আমাদের উলামায়ে কেরামগণকে পাইকারীহারে হত্যা করেছিল। (ফতওয়া-ই শামী, ০৬ নং খন্ড, ৪১৩ নং পৃষ্ঠা)
এই বদ মাযহাবীদের সাথে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) এর কোনই সম্পর্ক ছিলনা। যা আপনারা এতক্ষণের আলোচনায় পরিপূর্ণরূপে উপলব্দি করেছেন।
একটি বিষয় উল্লেখ না করলে কিছু সন্দেহ থেকে যাবে। কেউ বলতে পারেন দেওবন্দী ওলামাগণ তো ইবনে ওহহাব নজদীকে মান্য করে থাকেন। আর তারাও তো সাইযি়্যদ ছাহেব (র.) এর ছিলছিলার অনুসারী? তারা তো নিজেদের কিতাবে ইবনে ওহহাব নজদীকে খুব ভাল আকিদার লোক বলেছেন? যেমন ফতওয়ায়ে রশিদিয়ার ২৯২ নং পৃষ্ঠায় আছে,
‘মুহম্মদ আব্দুল ওহহাব-কে লোকেরা ওহাবী বলে থাকে। আর সে খুব ভাল মানুষ ছিল। শুনেছি সে হাম্বলী ছিল কিন্ত মাযহাব না মেনে হাদীসের উপর আমল করত…। ওহাবী আকীদা… মুহম্মদ বিন আব্দুল ওহহাবের অনুসারীদেরকে ওহাবী বলে। তাদের আকিদাহ খুবই ভাল ছিল।’
জবাবে বলতে হয়, হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) এর যামানায় দেওবন্দ মাদরাসা ছিলনা, ছিলনা দেওবন্দী ছিলছিলার অস্তিত্ব। সুতরাং দেওবন্দী কারো আমল, আকীদাহ কিংবা কথা-বার্তা সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) এর উপর বর্তানোর কোনই কারণ নেই। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়, দেওবন্দী ওলামাযে় কেরাম তাদের একদম নিকটবর্তী উস্তাযগণকেই গুরুত্ব দেন না। যেমন তারা তাদের মুর্শীদের মুর্শীদ শায়খুল আরব ওয়াল আজম হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মোহাজিরে মক্কী (র.) কে মানেন না। সুতরাং দেওবন্দ দেখে হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.)-কে মূল্যায়ন করা মোনাফেকী বৈ কিছুই নয়। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতিয়মান হয় যে আওর মুহম্মদিয়া তরীকা আর ইবনে ওহহাব নজদীর “মুহম্মদী আন্দোলন” দু’টি দুই ধারার একটি আরেকটির সাথে কোনই সম্পর্ক নেই।

আওর মুহম্মদিয়া তরীকার বৈশিষ্ট্য :
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) প্রবর্তিত প্রসিদ্ধ তরীকা তরীকায়ে মুহম্মদীয়া বা আওর মুহম্মদীয়া তরীকাটি আলাদা কোন তরীকা নয়, এটা হিন্দুস্থানের প্রসিদ্ধ তরীকা চিশতিয়া, কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া, মুজাদ্দিদে আলীয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া তরীকাগুলোর নির্যাসমাত্র। এখানে নতুন কোন যিকির নেই কিংবা আলাদা কোন সবকও দেওয়া হয়নি। এই তরীকার মূল বৈশিষ্ঠ্য হলো শুধু খানকা শরীফে বসে ইলমে তাসাওউফের খেদমত করেই শেষ নয়; নূর নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ পরিপূর্ণরূপে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা।
নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের দাওয়াত দিযে়ছেন, আপন ছাহাবায়ে কেরামগনকে তা’লিম-তরবিয়ত করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, যুদ্ধ-জীহাদও করেছেন। আর এই আদর্শ বাস্তবায়নই ছিল আওর মুহম্মদীয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
হাদীযে় বাঙ্গাল, মোজাদ্দিদে জামান, হযরত কারামত আলী জৈনপুরী (র.) উনার ‘যাদুত তাকওয়া’কিতাবে বলেছেন, ‘প্রত্যেক ওলীআল্লাহ রূহানীভাবে একেকজন নবীর অধীনে কামালত হাছিল করেন। আমার মূর্শীদ কিবলা স্বয়ং হুযুরে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে রূহানী ফযে়জপ্রাপ্ত বিধায় তিনি তাঁর তরীকার নাম মুহম্মদীয়া রেখেছেন।’
স্বয়ং সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) তাঁর মনের কথা ব্যক্ত করতে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহপাক রব্বুল আলামীন দয়া করে আমাকে যে যোগ্যতা দিযে়ছেন তার বদৌলতে আমার ইচ্ছা হয়, কাফেরদের মোকাবেলায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধাস্ত্র, ঢাল-তলোয়ার, তীর-নেজা, কামান-বন্ধুক ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের পোষাক পরিধান করে কলিমা শাহাদাতের বাণী বুলন্দ করতে জিহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ি। আমি নিজের হাতে পরীখা খনন করব, কুঠার হাতে নিযে় লাকড়ী ফাঁড়ব, হুদুদ-কিসাস জারী করব। এসকল নেয়ামত অর্জন করার নিমিত্তে আমার তরীকার নাম দিযে়ছি, “তরীকায়ে মহম্মদীয়া।’

সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) লিখিত কিতাবাদি প্রসঙ্গ :
আহমদ রেযা খান সাহেব ও তার মতাদর্শীরা বলে থাকে, ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক কিতাবখানি সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) লিখেছেন। কিন্ত আমরা চ্যলেঞ্জ করে বলতে পারি, উনার লিখিত কোন কিতাব পৃথিবীবাসী কেউ দেখাতে সক্ষম হবেনা। এমনকি উনার মলফুজাতের কোন বই/পুস্তকও কেউ দেখাতে পারবেনা।
মওযু, মতরুক তথা জাল হাদীসের কোনই অভাব নেই। তাই বলে কি এগুলোর জন্য দয়াল নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামকে দায়ী করা হবে? (নাউযুবিল্লাহ) কেউ যদি করে তাহলে কি তার ঈমান থাকবে? নিশ্চয়ই না। তাহলে বেঈমানেরা হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.) এর নামে ভ্রান্ত একটি কিতাব চালিযে় দিল এজন্য উনাকে দায়ী করা হবে কিরূপে?
পাঠক!ইয়াহুদ-নাসারারা তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত-ইঞ্জিল বিকৃত করে ফেলেছে এজন্য দায়ী কারা? আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনকে দায়ী করবেন? (নাউযুবিল্লাহ)

রেযা খাঁ’র ফতওয়া :
চরমপন্থী আহমদ রেযা খাঁ ও তার অনুসারীরা উক্ত সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবের উপর ভিত্তি করে সাইযি়্যদুল আওলিয়া, মোজাদ্দিদে যামান, আওলাদে রসুল, আমিরুল মুমিনীন হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) কে কাফের ফতওয়া দিয়ে থাকে। (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)
ইসলামী শরীয়তের ফয়সালা মোতাবেক কাউকে কাফের ফতওয়া দিতে হলে তার জন্য সু-স্পষ্ট কারণ বিদ্যমান থাকা জরুরী। এখন আমাদের কথা হলো সন্দেহের উপর নির্ভর করে আল্লাহ’র হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের খাছ আওলাদ, আল্লাহ পাকের মহান ওলীকে কাফের ফতওয়া দানকারী রেযা খাঁ গুষ্ঠির কোন দলীল নেই। কাউকে মনগড়া কাফের ফতওয়া দিলে এই ফতওয়া নিজের উপরেই বর্তায়। এ হিসাবে রেযা খাঁ নিশ্চিত রূপে কাফের।
কাউকে মনগড়া কাফের ফতওয়া প্রদান করলে যদি সে কাফের রূপে পরিগনিত হয় তবে রেযা খাঁ যে কাফের এতে কোনই সন্দেহ নেই। কেননা শতশত লোকেরা রেযা খাঁ’কে কাফের ফতওয়া দিযে় বই রচনা করেছেন। এরকম কয়েকটি বই হলো-রেজভী ধর্মমতের স্বরূপ, রেজভী ফিৎনা, রেজভী ফিৎনার স্টাইল, রেযাখানী মাযহাব, আস সাহাবুল মিদরার, বাসতুন বানা, কাতোয়ুল ওয়াতীন, সাইফে ইয়ামানী বর হলকুমে রেযাখানী, সাযে়কাযে় আসমানী, আল জাওয়াবুল মাহমুদ আন আকাযীবি রহতিল হাসুদ ইত্যাদি।
প্রিয় পাঠক! আমার ক্ষুদ্র লিখনীর মাধ্যমে স্পষ্ট রূপে প্রমাণীত, সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) আওলাদে রসুল। তিনি তেরশত হিজরী শতাব্দীর মোজাদ্দীদ। তিনি ওহাবী নন। আওর মুহম্মদিয়া তরীকা পৃথিবীর আ’লা একটি তরীকা। বালাকোট প্রান্তরে তিনি জিহাদ করে শহীদ হয়েছেন। তাঁর লাশ মোবারক না পাওয়া তাঁর একটি জ্বলন্ত কারামত। হযরত সাইয়্যিদ ছাহেব (র.)’র লিখিত কোন কিতাব কিংবা মলফুজাত নেই। উনার উপর প্রদত্ব রেযাখানী ফতওয়া দলীল বিহীন ও মনগড়া ইত্যাদি।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে হক বুঝার তৌফিক দান করুন ও হক ছিলছিলার উপর ইস্তেকামত দান করার পাশাপাশি আওলিয়াযে় কেরামের মাধ্যমের আল্লাহ পাকের হাবীব হুযুর পুরনূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ইশক এবং মুহব্বত হাসিল করার তৌফিক দান করুন। আমিন!

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *