আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ। খুব ছোটবেলায় তাঁকে প্রথমবার দেখেছিলাম। আমাদের পাশের বাডি়তে তিনি এসেছিলেন। কিন্তু সে দেখা ছিল অনেকটা ছায়ার মতো। অনেক লোকের ভিডে় গুটি গুটি পাযে় এগিযে় যতটুকু দেখা যায়। কিন্তু সেদিনের দেখায় তাঁর ছবি চোখে ধরে রাখতে না পারলেও মনে গেঁথে গিযে় ছিল। এরপর জীবনে তাঁকে অনেকবারই দেখা হযে়ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিলÑ এতো দেখার পরও চোখের তৃপ্তি মিটেনি। আজ অনেকদিন পরও তার সান্নিধ্যের কিছু মুহূর্ত জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠছে। তিনি আমাদের অস্তিত্বে অনুভবে জডি়যে় আছেন। তার সৌম্য শান্ত চেহারাখানি আমাদের মন ও মনন জডি়যে় আছে। ভক্তের প্রতি এতো ভালবাসা এতো দরদ ছিল তাঁর প্রত্যেকেই বলে যে তাকে সবচেযে় বেশি ভালবাসতেন তিনি। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর অনুসারীদের ব্যাকুলতা কান্না আর মাতমই প্রমাণ করে কতোটা আসন গডে়ছিলেন ভক্তকুলের অন্তরে। বোধ ও বয়সের কমতি থাকায় তাঁকে যেভাবে অনুধাবন করার কথা ছিল হয়তো সেভাবে পারিনি। কিন্তু তাঁর প্রতি যে দুর্বলতা কিশোর বয়সে তৈরি হযে়ছিল এ আর কম কি। আমার মনে হয় এমন কোন সপ্তাহ নেই যে তিনি মৌলভীবাজারে আসেন নি। মৌলভীবাজারের মানুষকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি বলতেনÑ ‘মৌলভীবাজারের মানুষ আমাকে মায়া করেন, আমিও তাদেরকে মায়া করি।’ মৌলভীবাজারবাসীর প্রতি তাঁর একটু আলাদা দরদ ছিল। এমন কোন মাস নেই যে মাসে তাঁর সাথে আমাদের দেখা হয়নি। তাঁর কাছে বসা; বয়ান শোনা; খাবারের শেষে তার প্লেটে থেকে যাওয়া খাবার খেতে সবার সাথে যে প্রতিযোগিতা এতো খুব সহজে ভুলার নয়।
তাঁর ইন্তেকালের পর একদিন তাঁর স্মৃতিচারণ করতে যেযে় মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ আমিনুল বাহার জামালী (মরহুম) বলেন, ‘ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ এমন এক উস্তাদের নাম যিনি নিজের খাওয়াযে়; পড়াশুনা করিযে় আমাদের মানুষ করেছেন। এরপর কর্মজীবনে আমরা কি করবো তারও ব্যবস্থা করে দিযে়ছেন। তিনি আমাদের বিযে়-শাদীর ব্যবস্থা করে দিযে়ছেন। এমনকি আমাদের সন্তান সন্ততি কি করছে; কিভাবে চলছে তারও খোঁজখবর রাখতেন’।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ এক কিংবদন্তীর নাম। নবী প্রেমই ছিল তাঁর জীবনদর্শন। মানুষের অন্তরে রাসুলের ভালবাসা প্রোথিত করে দিতে তিনি সারাটি জীবন ব্যয় করেছেন। বয়সের ভারে যখন ন্যুব্জপৃষ্ঠ তখনো মাইলের পর মাইল পাডি় দিযে় মানুষের হেদায়াতের জন্য মাহফিল করেছেন। মানুষকে সহীহ আকীদা বিশ্বাসে পরিচালিত করতে তালিম দিযে়ছেন। ভ্রান্ত আকীদার মানুষের সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিযে়ছেন। তিনি মাঝে মাঝে আফসোস করে বলতেনÑ ‘আমি এই বয়সে এত দূর-দূরান্ত যাই ভালো ভালো খাবার খেতে নয়, আমি যাই মানুষকে সতর্ক করতে, যাতে তারা নতুন নতুন দলে ভিডে় ঈমানহারা না হয়।’ তাঁর মাহফিলে যারা উপস্থিত হতেন তারা ভালো করে জানেন, তিনি ওয়াজ মাহফিলে যেসব বয়ান রাখতেন তার বেশির ভাগ বয়ানই ছিল আকীদা-বিশ্বাসের উপর। তিনি সব সময় নতুন আবিস্কৃত মতবাদ ও দল থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন। তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য বাতিল আকীদা পন্থীদের সেলের মতো বিদ্ধ করতো; কিন্তু তিনি ছিলেন সত্য বলায় অবিচল। তাঁর এই সত্য ভাষণের কারণে বাতিলপন্থীরা তাঁকে ১৯৮০ সালে মেরে ফেলতে চেযে়ছিল। কিন্তু ব্যর্থ হযে়ছে। আল্লাহ তাঁর মকবুল ওলিকে তাঁর দ্বীনের স্বার্থে অলৌকিকভাবে বাঁচিযে় রেখেছিলেন।
আমাদের দেশে সাধারণ অর্থে যে পির-মুরিদী প্রচলিত তিনি সেরকম কোন পির ছিলেন না। শুধু ভক্ত মুরিদানদের হালুয়া রুটি খেযে় যারা পিরাকী করেন তাদের থেকে তাঁর ফারাক ছিল যোজন-যোজন। তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক; মুজাদ্দিদে জামান; মুজাদ্দিদে দ্বীন। একজন আমানতদার ব্যক্তি। তাঁর উস্তাদরা কুরআনের শুদ্ধ পঠন তার হৃদযে় ঢেলে দিযে় যে প্রতিশ্র“তি নিযে়ছিলেন তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন পৃথিবীর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াতের প্রতিষ্ঠানÑ ‘দারুল কেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্বারী হযে় কুরআনের শুদ্ধ তেলাওয়াত শিক্ষা দিচ্ছেন। আজো তাঁর বাডি়তে গিযে় দারুল ক্বেরাতের শেষ জামাত ‘ছাদিছ’ পড়তে হয়। রমদ্বান মাসে ছাদিছ পড়তে আসা ছাত্রদের জন্য ছাহেব বাডি়র পক্ষ থেকে আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হযে় থাকে।
গত জানুয়ারিতে (২০১৩) মিশরের বিশ্বক্বারী মরহুম আব্দুল বাছিতের ছেলে ক্বারী ইয়াসীর বাছিত ফুলতলী ছাহেবের ইসালে সাওয়াব মাহফিলে এসেছিলেন। তখন সাপ্তাহিক পূর্বদিক অফিসে তাঁর একটি স্বাক্ষাৎকার নিযে়ছিলাম আমি। তাঁকে একটি প্রশ্ন করেছিলামÑ আপনি তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান, কোথাও ফুলতলী ছাহেবের এই পদ্ধতির দারুল কেরাত বা কুরআন শিক্ষার ক্লাসিক্যাল ব্যবস্থা দেখেছেন? তিনি বলেছিলেনÑ ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থা থাকলেও তাজবীদ সহকারে রমদ্বান মাস কেন্দ্রিক এমন ব্যবস্থাপনা আমার চোখে পডে়নি।’ এসময় তিনি তাঁকে আল্লাহর মকবুল ওলি অভিহিত করে তাঁর জন্য দোয়া করেন।
ধর্মীয় কোন বিষযে় তিনি কারো সাথে আপোষ করেননি। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে যেমন কথা বলেছেন তেমনিভাবে তৎপরবর্তীকালীন দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ-বিএনপিরও বিরুদ্ধেও দ্বীনের স্বার্থে অবস্থান নিযে়ছেন। আওয়ামী লীগের ফতোয়া বিরোধী অবস্থানের বিপরীতে তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কড়া সমালোচনা করেছেন। ঠিক বিএনপি সরকারের আমলে মুরতাদ তাসলীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে গনআন্দোলন গডে় তুলেছেন। যার কারণে তার পরিবারের অনেক লোককে কারাবরণ করতে হযে়ছে। তাঁর এই জীবনাদর্শ ও জীবনদর্শন তার অনুসারী ও অনুগামীদের জন্য সমযে়র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার এক সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত।
কিছু না বলা কথা
এক.
তাঁর সাথে জডি়যে় থাকা কিছু না বলা কথা এখন তাঁর ইন্তেকালের পর না বলে পারছি না। আমি ক্লাস নাইনে এসে ভর্তি হই মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসায়। এখানে ভর্তির পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন তালামীযের সাথে যুক্ত হই। মাদরাসার সকল শিক্ষক-ছাত্র-অফিস সহকারী সবাই ছাহেব কিবলাহর ভক্ত। সবার মুখে তাঁরই কথা। তার গুনগান। কিন্তু এখানেও ঘাপটি মেরে ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিল। তারা ছাত্রদেরকে গোপনে তাদের দলে ভিড়ানোর জন্য কাজ করতো। বিভিন্ন অফার দিতো। আমাকেও তারা তাদের দলে ভিড়ানোর প্রচুর চেষ্টা করেছে। নতুন পরিবেশে এসে এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে অনেকটা ঘাবডে় যাই; কিছুটা ভয়ও। এরমধ্যে আমাদের শ্রেণীকক্ষে তাদের একটি অঙ্গসংগঠনের স্টিকার ছিড়তে গিযে় শিবিরের রোষানলে পডি়। তারা একদিন আমাকে দাঁড় করিযে় হুমকিও দেয়। এই অবস্থার মধ্য দিযে়ই প্রতিকুলতা মোকাবেলা করার সাহস বেডে় যায়। ধীরে ধীরে সংগঠনের সিনিয়র ভাইদের সাথে পরিচিত হযে় উঠি।
তারও কিছুদিন পর আমাদের ক্লাসে এসে ভর্তি হলেন নতুন এক ছাত্র। তার সাথে পরিচিত হওয়ার পর মনের শক্তি বহুগুণ বেডে় গেল। তার নাম করিমুল ইসলাম। তিনি কুরআনে হাফিয ছিলেন। সংগঠনের অনেক কিছুই তার কাছ থেকে আমার শেখা। ধীরে ধীরে আমাদের দুজনের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট হযে় গেল। এর ভেতর আমরা দুজন সাংগঠনিক কাজে সিরিয়াস হযে় যাই। আমরা তখন আলীমের ছাত্র। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে মাদরাসার প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে জামায়াতপন্থী এক জেনারেল শিক্ষক আমাদের মাদরাসায় নিযে়াগপ্রাপ্ত হন। আমরা যখন মাদরাসার অভ্যন্তরে সংগঠনের কাজ দ্রুত গতিতে চালিযে় যাচ্ছি তখন তিনি বিভিন্নভাবে আমাদেরকে বাঁধা দিতে লাগলেন।
আমরা প্রায় প্রতিদিন রুটিনমত মাদরাসার প্রতিটি ক্লাসে গিযে় ছাত্রদের সাথে কুশল বিনিময় করতাম। একদিন ক্লাসে ক্লাসে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বাতিল আকীদাপন্থী ওই স্যার আমাদেরকে ক্লাসে যেতে বাঁধা দিলেন। তখন তার সাথে আমাদের তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। এসময় তিনি মাদরাসার এক সিনিয়র শিক্ষকের কাছে (উনি মরহুম, এজন্য নাম উল্লেখ করছি না) আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করলেন। তিনি কোন কিছু না বুঝেই অতিরিক্ত নিরপেক্ষতা দেখাতে যেযে় আমাদেরকে তার পা ধরাযে় মাফ চাওয়ালেন। মাদরাসার একজন জুনিয়র শিক্ষকের পা ধরাযে় আমাদেরকে মাফ চাওয়ানোতে আমরা মারাত্মক অপমান বোধ করলাম। এই অপমানে চোখে দিযে় আপনা আপনি জল ঝরল। এই কষ্ট পাওয়ার কারণ ছিল এইÑ যিনি আমাদের মছলক সংগঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিযে় তার আকীদার সংগঠনের ছাত্রদের মদদ দিচ্ছেন। আর আমাদের মছলকের ‘নিরপেক্ষবাদীরা’ কিছু তো করতে পারছেনই না তার উপর অন্যায়ভাবে আমাদেরকে মাফ চাইতে হল। এদিন রাগে ক্ষোভে আমরা মাদরাসা থেকে বাসায় চলে যাই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই আর মাদরাসায় সংগঠনের কাজ করবো না।
তখন বিকাল ৩টা। রাগে-ক্ষোভে ফোঁসতে ফোঁসতে আমরা ঘুমিযে় যাই। এর মধ্যে একটি স্বপ্ন দেখি। দেখি আল্লামা ছাহেব কিবলাহ আমাদেরকে দুই গ্লাস পানি পডে় দিচ্ছেন। এক গ্লাস আমাকে আর একগ্লাস করিমুল ভাইকে। ঘুম ভাঙার পর মন খুশি হযে় যায়। বুঝতে পারি ছাহেব কিবলাহ আমাদেরকে ভুলেন নি। আমরা তাঁর নজরেই আছি।
দুই.
আমরা একবার তালামীযের পক্ষ থেকে ছাহেব বাডি়র উদ্দেশ্যে শিক্ষা সফরে যাবার উদ্যোগ নেই। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। ছাহেব বাডি়তে পৌঁছার পর আমাদেরকে ছাহেবের ভেতর বাডি়তে নিযে় যাওয়া হলো। তিনি আমাদের সকলের খোঁজ খবর নিলেন। আমাদের জন্য দুআ করলেন। অতঃপর অন্যদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে বললেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর ফুলতলী মাদরাসার ছাত্রসংসদ থেকে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর আযে়াজন করা হয়। আমাদের একজন বক্তৃতা শুরু করেছেন এমন সময় খবর এলো ছাহেব কিবলাহ আমাদেরকে দেখতে আবার এসেছেন। আমরা সবকিছু ফেলে তার দিকে দৌঁড় দিলাম। দেখি অসুস্থ শরীর নিযে় তিনি আমাদেরকে দেখার জন্য হুইল চেয়ারে করে এসেছেন। এসে আমরা খেযে়ছি কি না তার খবর নিলেন। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের পুরো উপস্থিতির দিকে নজর বুলালেন। আবার আমাদের জন্য দোয়া করলেন।
আমরা তাকে দেখতে যাওয়ায় তিনি খুব খুশি হযে়ছিলেন। আর আমরাও দেখেছিলাম তালামীয কর্মীদের প্রতি তাঁর ভালবাসার নমুনা।
তিন.
সাংগঠনিক ব্যস্ততায় আলীম ফাইনাল পরীক্ষার আগে ভালভাবে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। এর মধ্যেই পরীক্ষা সমাগত। শুধুমাত্র পরীক্ষায় অ্যাটেন্ড করার জন্য অ্যাটেন্ড করি। সব বিষয় মোটামুটি ভাল হলেও ইংরেজি পরীক্ষা খুব খারাপ হলো। আমার ধারণা ছিল আমি ইংরেজিতে ফেল করবো। এ অবস্থায় দুঃচিন্তায় ভোগছিলাম। শেষে একদিন মনস্থির করলাম এই সাবজেক্টের কথা বলে ছাব কিবলার কাছ থেকে দোয়া নেব। একদিন সিলেটের সোবহানীঘাটে তাঁর বাসায় গেলাম। তাঁকে ইংরেজিতে খারাপ হওয়ার কথা জানিযে় দোয়া চাইলাম। তিনি হাত তোলে দোয়া করলেন। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে দেখি ইংরেজিসহ সকল বিষযে়ই উত্তীর্ণ হযে়ছি।
পরিশেষে তাঁর দরজা বুলন্দি, তাঁর মছলক, তাঁর মত ও পথ যেনো আমাদের সকলের মুক্তির পাথেয় হয় রাব্বুল আলামীনের দরবারে এ দোয়াই করছি।