আল্লামা ছাহেব ক্বিবলাহ্ ফুলতলী (রহ.)-এর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন

আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব ক্বিবলাহ্ ফুলতলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। আধ্যাত্মিক সাধক, আলিম, মুহাদ্দিস, মুফাস্সীর, মুফতী, ক্বারীউল র্কুরা, আশিকে রাসূল, সমাজ সেবক, সুলেখক ও আদর্শ গণমূখী রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সমসামযি়ক আলিমদের মধ্যে আপন স্বাতন্ত্রে চিহ্নিত এক অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লামা ছাহেব ক্বিবলাহ্ ফুলতলী (রহ.)। ইসলামী আন্দোলনের এই অকুতোভয় অগ্রসৈনিক ১৯১৩ সালে প্রান্তিক জনপদ জকিগঞ্জের ফুলতলী গ্রামে সম্ভ্রান্ত আলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি সুলতানে সিলেট হযরত শাহজালাল (রহ.) এর অন্যতম সঙ্গি হযরত শাহ কামাল (রহ.) এর সাক্ষাত বংশধর।
এ পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক মানব সন্তানের আগমন হয়-যারা এক পর্যাযে় আসল নামের অন্তরালে ঢাকা পডে় যান জনগণের সম্বোধনের চাদরে। আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.) ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি ‘ছাহেব ক্বিবলাহ’ নামে খ্যাত ছিলেন। এ খেতাবে তাঁকে তূষিত করেন তাঁরই ভক্ত-মুরীদান ও মুহিব্বীনরা। এ খেতাবে তিনি এতটাই বিখ্যাত হযে় উঠেন যে ‘ছাহেব ক্বিবলাহ’ যেন তাঁর মূল নামে পরিণত হয়।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.) এর ছিল বর্ণাঢ্য ও গৌরবময় এক রাজনৈতিক জীবন। তিনি বৃটিশ বিরোধী তথা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। সমযে় সমযে় তিনি অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং অনৈসলামিক কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন ও সংগঠন পরিচালনার প্রতিটি পর্যাযে় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.) ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক আপোষহীণ সফল সিপাহসালারের নাম। তিনটি আমলেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর স্বরব পদচারনা গতানুগতিক রাজনীতিকে পদদলিত করে একটি ইসলামী গণমূখী রাজনৈতিক ধারা তিনি প্রবর্তন করেছিলেন।
তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র ইসলামী রাজনীতির ধারক ও বাহক। তিনি যামানার অন্যতম ওলী আল্লাহ ও খ্যাতনামা আলিম হওয়ার পাশাপাশি একজন দেশ প্রেমিক মানবসেবী ব্যক্তিত্বও ছিলেন। প্রজ্ঞা মেধা ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বযে় তাঁর মধ্যে বিরাজ করত উন্নতমানের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও চেতনা। পূর্বসূরী বুজুর্গগণ থেকে তরিকতের পাশাপাশি এই চেতনা ও শিক্ষা রপ্ত করেছিলেন তিনি। দেশ-জাতির প্রতি ভালবাসা ও দাযি়ত্ববোধ তাঁকে নিরব দর্শকের ভূমিকায় সকলের নিকট প্রিয় হযে় বসে থাকার পরিবর্তে তাঁর মধ্যে জাগিযে় তুলেছিল স্পষ্টতা। প্রচলিত রাজনীতির মধ্যে তিনি সক্রিয় না থাকলেও দেশের গতিধারা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশেষ করে মুসলমানদের স্বার্থ কোন দিকে এগুচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন। যখন যেভাবে সম্ভব উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবিলা বা সহযোগীতায় তিনি কুণ্ঠাবোধ করতেন না। সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দ্বারা মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে, পরামর্শ সভায় যোগদান করে, এমনকি গভীর রাতে দয়ামযে়র নিকট প্রার্থনা করে তিনি দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় ও বিরুদ্ধবাদীদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় জোরালো ভূমিকা রেখে গেছেন।
রাজনীতির গতানুগতিক চুরাবালিতে না হারিযে় দেশ, জাতি ও ধর্মের স্বার্থ রক্ষায় তিনি সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামান্যতম আঘাত আসলে তিনি সিংহ নিনাদে গর্জে উঠতেন। তিনি ছিলেন বিবেকবান রাজনীতিবিদ। রাজনীতি তাঁর কাছে বিলাস, ক্ষমতার সিঁডি় অতিক্রম করার কৌশল অথবা স্বার্থ রক্ষা ও উদ্ধার করার উপায় ছিলনা। সমাজ ও জনগণের সর্বিক কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর রাজীনিতির মুল উদ্দেশ্য। তাইতো লক্ষ করা যায়- আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ঈমাম আবু হানিফা (রহ.) এর স্বার্থক উত্তরসূরী হিসেবে তাঁর জীবনে একাধিকবার মন্ত্রীত্ব লাভের প্রস্তাব নির্দ্ধিধায় ফিরিযে় দিযে়ছেন।
ইক্বামতে দ্বীনের কঠিন দাযি়ত্ব পালনে তিনি কখনো বিচলিত হননি। সেজন্য কর্মজীবনের শত ব্যস্ততায় রাজপথের যে কোন যৌক্তিক আন্দোলন তাকে দমিযে় রাখতে পারেনি। কি রাজপথ, কি জনপদ, কি নগর, কি মহানগর সব যুগপৎ আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন নেতা। তার নেতৃত্বে ছিল না কোন মতানৈক্য। দলমত নির্বিশেষে জনগণ একবাক্যে যাকে রাহবার হিসেবে মানতো, তিনি হলেন ছাহেব ক্বিবলাহ ফুলতলী (রহ.)। তিনি যতক্ষণ না কোন সভামঞ্চে আসছেন ততক্ষণ সভা জমে উঠত না। ছাহেব ক্বিবলাহ অনুষ্ঠান স্থলে আসামাত্রই লোকে লোকারণ্য হযে় উঠতো। এককথায় দ্বীন-ইসলাম রক্ষার্থে নানা যৌক্তিক আন্দোলনে তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল ভরপুর।
নিম্নে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরা হল-

জমিয়তে উলামাযে় হিন্দ-এ যোগদান
চল্লিশের দশকে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে নব জাগরণের যে উত্তাল জোয়ার সৃষ্টি হয়, আল্লামা ফুলতলী (রহ.) তা থেকে দূরে থাকতে পারেননি। মুসলিম ভারতের সে যুগ সন্ধিক্ষণে ‘জমিয়তে উলামাযে় হিন্দ’এ যোগদানের মাধ্যমে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যে কটি সংগঠন মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল ‘জমিয়তে উলামাযে় হিন্দ’ তার অন্যতম। চতুর ইংরেজ কর্তৃক উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও বোকা বানিযে় ক্ষমতা দখল ও তাদের মসনদে টিকে থাকার বিরুদ্ধে ভারতের আলেম-উলামাদের বৃহৎ এই সংগঠনটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিযে়ছিল। ১৯৪০ সালে তিনি ‘জমিয়তে উলামাযে় হিন্দ’ এর পক্ষ থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সে সময়কার তরুণ প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব হযরত ফুলতলী ছাহেব তাঁর মুর্শিদের নির্দেশ ও অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতা আন্দোলনে জোরালো ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতের সমর্থনকারী।
১৯৪২ সালে ‘ইন্ডিয়া ত্যাগ কর আন্দোলন’এ তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়া ইউনিয়নের সাবেক প্রসিডেন্ট জনাব ফখরউদ্দিন আলী আহমদ, আসামের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মতলিব মজুমদার, হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), শ্রী অরুনকুমার চন্দন, রবিন্দ্র আদিত্য, কামেনীসেন, বীরেন্দ্র বাবু, সতীন্দ্র মোহন দেব, সুধীর কুমার ইস, সাহিত্যিক হুরমত আলী বড় লস্কর এবং তাঁর সমযে়র অন্যান্য নেতৃবর্গের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাছাড়া তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, মহাত্বা গান্ধী ও সি.আর দাশ প্রমূখ নেতাদের সাথে সভায় মিলিত হন। লর্ড হান্টার কর্তৃক সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) এর তরিকাযে় মুহাম্মদীয়া আন্দোলনকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। যখন উনার কাছে এ কথা পরিস্কার হযে় যায়, ‘জমিয়তে উলামাযে় হিন্দ’ সম্পূর্ণরূপে কংগ্রেস কর্তৃক প্রভাবিত হযে় পডে়ছে, তখনই ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ (রহ.) ঘোষণা দিযে় জমিয়ত ত্যাগ করেন।

আসামের গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভায় নেতৃত্বদান
ফুলতলী ছাহেবের রাজনৈতিক আন্দোলন শুধু দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সুদূর বিদেশের মাটিতেও তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে মুসলমানদের সম্মান, ইজ্জত রক্ষা পেযে়ছিল। ১৯৫০ সনের ঘটনা। একবার ভারতের আসাম প্রাদেশিক সরকার ‘মুসলিম এডুকেশন বোর্ড’ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিল। তখনকার সমযে়র আলেম-উলামা সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে সম্মত হলেও রাজপথে ভূমিকা নিতে কারো সাহস ছিল না। অবশেষে সবাই মিলে ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করলে তিনি পর পর দুটি জনসভা করে এর প্রতিবাদ জানান।
তিনি আসামের নওয়াগাও জেলার ডবকা, লংকা এবং মুরাঝার জনসভা করেন। প্রতিবাদ সভা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোওয়ানা জারি হযে় যায়। তারপর পুলিশের লোকেরা তাকে খুঁজতে থাকে। এই সংকটময় অবস্থাতে ছাহেব ক্বিবলাহ (রহ.) নেতৃত্বে আসাম প্রদেশে একটি নয়, দুটি নয় আরো বহু বহু প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হলে আসাম সরকারের নির্দেশে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে শেষপর্যন্ত দেখামাত্র গুলির অর্ডার দেয়। ‘রাখে আল্লা! মারে কে?! এতসব তোয়াক্কা করেও ছাহেব ক্বিবলাহ অবশেষে পাকিস্তানের সীমানা দিযে় বাংলাদেশে নিরাপদে পৌছান।

নেজামে ইসলামে যোগদান
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সমযে় ছাহেব ক্বিবলাহ তৎকালীন ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্যে শীর্ষ সংগঠন ‘নেজামে ইসলাম’ এ যোগদান করে গঠনমুলক ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি এ সংগঠনের সহ সভাপতি পদে আসীন হযে় নিষ্ঠার সাথে গুরু দাযি়ত্ব পালন করেন। ‘নেজামে ইসলাম’ ছিল ইসলামী আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের সম্মুখ সারির সংগঠন। আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছিলেন চট্টগ্রামের মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ, ময়মনসিংহের মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা সামছুল হক ফরিদপুরী এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এর সমসামযি়ক।

বাংলাদেশ আন্জুমানে আল-ইসলাহ গঠন
সত্তর দশকের শেষদিকে তিনি সকল বাতিল ও কুফ্রী মতবাদ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের সমন্বিত আদর্শে ঐক্যবদ্ধ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সঠিক আকিদা-বিশ্বাস জনসমক্ষে প্রচার করার গুরুত্ব উপলদ্ধি করেন। তারই নিরিখে দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশাযে়খদের সমন্বযে় ১৯৭৯ইং সনের ১লা মার্চ গঠন করেন সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক গণসংগঠন ‘বাংলাদেশ আন্জুমানে আল ইসলাহ’।
ব্যাক্তি ও সমাজ সংশোধনের পাশাপাশি দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে এ সংগঠন জোরালো ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থা, দেশের গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন ও ধর্মের বিরুদ্ধে যে কোন ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সংগঠনটির ভূমিকা অতি উজ্জ্বল। নব্বইযে়র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, সালমান রুশদি কর্তৃক প্রকাশিত ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ ও ডেনমার্কে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে তথায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদ, চেচনিয়া, বসনিয়ায় মুসলিম নিধনের প্রতিবাদ, সভ্যতার চারণ ভূমি ফিলিস্তিনের অসহায় মুসলমান সহ ইরাক, ইরান, কাশ্মীর ও তাজাকিস্তান, সিরিয়া, বার্মা, আফগানিস্তান, ভারতের মুসলমানদের পক্ষে আন্দোলন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযে়র হল ও ভবন নাস্তিকদের নামে নামকরণ বিরোধী আন্দোলন, শাহজালাল (রহ.) এর মাজার প্রাঙ্গনে বোমা বিস্ফোরনের প্রতিবাদ, ফতোয়া বন্ধের পায়তারার প্রতিবাদ, মুরতাদ আহমদ শরীফ ও তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, স্বতন্ত্র আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে ঐতিহাসিক লংমার্চ, রাসুল (সাঃ) এর উপর নির্মিত কাল্পনিক চলচিত্রের প্রতিবাদ, ব্লগারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সহ ধর্মীয় ও জাতীয় যে কোন সংকট মুহুর্তে সংগঠনটি আপোষহীণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

বাংলাদেশ আন্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা
আশির দশকের শুরুতে ইসলাম নামধারী কতিপয় সংগঠন ও সমাজ বিভ্রান্তিকর তাদের লেখনী, আত্মঘাতী প্রচারণা ও লোভ-প্রলোভনের মাধ্যমে ইসলামী তাহযিব তামাদ্দুনকে বিনষ্ট করার জন্য আধাজল খেযে় লেগেছিল। ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো কোমলমতি মুসলিম ছাত্র সমাজের মন ও মনস বিগডে় দিচ্ছিল। এমনি ক্রান্তি লগ্নে সকল ষড়যন্ত্র, অপকৌশল ও ভ্রান্ত মতবাদকে পদদলিত করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পরিপূর্ণ অনুগামী, মেধা ও মননে অনন্য, বিদ্যা ও বুদ্ধিতে পারঙ্গম, তাযকীয়াযে় নফসের মাধ্যমে আদর্শ চরিত্রের অধিকারী, জাতীর ভবিষ্যত কর্ণধার একদল আদর্শ নাগরিক গঠনের লক্ষ্যে উৎসাহী ছাত্র সমাজের সমন্বযে় আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ১৯৮০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রতিষ্ঠা করেন “বাংলাদেশ আন্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া”। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংগঠন সব সময় আল্লামা ছাহেব ক্বিবলাহর দিক নির্দেশনায় ইসলামের পক্ষে তাদের সর্ব শক্তি ব্যয় করছে। যখনি ইসলাম, মুসলমান ও জাতীয় স্বার্থের উপর কোন আঘাত আসে তখনি এ সংগঠন বলিষ্ট পদক্ষেপে তার মোকাবেলায় এগিযে় যায়।

সুন্নী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন সংগ্রাম
আল্লামা ছাহেব ক্বিবলাহ্ ফুলতলী (রহ.) এর পূর্ণ র্কমময় জীবন অতিবাহিত হযে়ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণের ভেতর দিযে়। এটি সহজ হযে়ছিল শরীয়ত ও তরিকত যৌথ পালনের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যাবতীয় হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ অনুসরণের বিকল্প নেই। এই সত্য কথাকেই ছাহেব ক্বিবলাহ ফুলতলী (রহ.) সারা জীবনভর প্রচার করে গিযে়ছেন। দেশ-বিদেশের বরেণ্য ওলামা ও পীর-মাশাযে়খবৃন্দ ছাহেব ক্বিবলাহর এই প্রচারে একাত্মতা ঘোষণা করতঃ সুন্নীয়তের মতাদর্শ আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন। বিগত ২০০৪ইং সনের ১৯ ও ২০ মার্চ সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে দুই দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক শানে-রিসালাত মহাসম্মেলনে’ আনুষ্ঠানকিভাবে সেই ঐক্যের সূচনা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও আরব, মিসর, কুযে়ত, পাকিস্তান, ভারত ও ইউরোপ-আমেরিকার খ্যাতিসম্পন্ন ওলামা-মাশাযে়খ ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অংশগ্রহণের মধ্যদিযে় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ (রহ.)। শরীয়ত ও মারিফত এই উভয়বিধ জ্ঞানের সফল পতাকাবাহী আল্লামা ফুলতলী (রহ.) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ও জাগ্রত থাকতেন। তিনি সবসময়ই বলে থাকতেন: ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা-বিশ্বাস এই জমিনে প্রতিষ্ঠিত করতে আমার দেহের রক্ত কোরবান করতে প্রস্তুত’। ছাহেব ক্বিবলাহ’র এই দ্ব্যার্থহীন সাহসী উচ্চারণ মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হযে় গিযে়ছিল। আর সেজন্যেই আশির দশকের গোড়ার দিকে জগন্নাথপুরের মাটিতে কতিপয় দুষ্কৃতিকারীদের হিং¯্র থাবায় রক্তে রঞ্জিত হযে়ছিল তাঁর পবিত্র দেহ। সেদিনের তাঁর রক্ত কোরবান বৃথা যায়নি। ছাহেব ক্বিবলাহ’র প্রতিটি রক্তের ফোঁটা থেকে কোটি-কোটি মুরীদান, আশেকান ও মুহিব্বীনের জন্ম হযে়ছে। এর বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তাঁর নামাযে-জানাযায়। কেননা, দেশের এই বৃহত্তম জানাযায় প্রায় বিশ লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল।

নাস্তিক-মুরতাদ বিরুধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান
নব্বই দশকে সারাদেশে যখন নাস্তিক-মুরতাদদের অনৈসলামিক কার্যক্রম চরম পর্যাযে় পৌঁছেছিল বিশেষকরে সালমান রুশদী, তসলিমা নাসরিন ও আহমদ শরীফ প্রমূখ নাস্তিকদের লেখনীর খোঁচা যখন সারা দেশের মুসলমানদের হৃদযে় আঘাত হেনেছিল, এমনি মূহূর্তে নাস্তিক-মুরতাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যিনি সিংহের ন্যায় গর্জে ওঠেন, তিনি হলেন শাহজালাল (রহ.) এর সুযোগ্য উত্তরপুরুষ, বালাকোটের মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর তরিকার শ্রেষ্ট আমানতদার আল্লামা ছাহেব ক্বিবলাহ ফুলতলী (রহ.)। তারই চৌকস নেতৃত্বে নাস্তিক-মুরতাদদের লেখনী বাজেয়াপ্ত সহ তাদেরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে তৎকালিন সরকার বাধ্য হযে়ছিল।

অন্যান্য যৌক্তিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দান
ইসলাম বিরুধী যেকোন কার্যকলাপের বিরুধীতায় ছাহেব ক্বিবলাহ ছিলেন সোচ্চার। দেশের কোন স্থানে এ ধরনের আন্দোলনে তিনি যতক্ষণ না বক্তব্য দিযে়ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন আন্দোলন সফল হয়নি। সিলেটে অনুষ্ঠিত ইসলাম ও মানবতা বিরুধী সকল আন্দোলন সমূহ তার বাস্তব সাক্ষী। বিশেষকরে ১৯৯২ইং সনে ভারতের অযোধ্যায় মুসলমানদের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে রাজপথে রক্তিম আন্দোলন, ২০০১ইং সনে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযে়র নামকরণ বিরোধী আন্দোলনে ছাহেব ক্বিবলাহর স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহন এবং রাজপথে নেতৃত্ব প্রদানকে সিলেটবাসী এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
এমনিভাবে ধর্মীয় ও জাতীয় যে কোন সংকট মুহুর্তেই আল্লামা ফুলতলী (রহ.) সিংহ পুরুষের ভূমিকা পালন করতেন। আন্তর্জাতিক ব্যাপারে ও তিনি ছিলেন একজন স্পষ্টবাদী বক্তা। ১৯৭৯ সালে সোভিযে়ত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগানিস্থানে আক্রমন, ১৯৯১ সালে ইরাক কর্তৃক কুযে়ত দখল, ইঙ্গ-মার্কিন কর্তৃক ইরাক আক্রমন, সভ্যতার চারন ভূমি ফিলিস্তিনের অসহায় মুসলমানদের উপর ইসরাইলের আক্রমন, বসনিয়া, চেচনিয়া, কসোবো, কাশ্মীর, ভারত, ইরান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান ও রোহিঙ্গার নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষে তিনি ছিলেন বজ্রকন্ঠ প্রতিবাদী। তাঁর সাহসী ভূমিকা সাধারন জনগনকে আন্দোলিত ও উৎসাহিত করত।

ফতোয়া বন্ধের প্রতিবাদে সক্রিয় ভূমিকা
২০০১ইং সনের ডিসেম্বর মাসের একটি ঘটনা। নওগাঁ সদর উপজেলার ‘আতিথা’ গ্রামের এক গৃহবধূ সাহিদার ফতোয়াকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট কর্তৃক ‘ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়’র প্রতিবাদে যে সকল দেশবরণ্যে আলেম ও মাশাযে়খ ঐতিহাসিক ভূমিকা নিযে়ছিলেন, ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ ছিলেন তাদের অন্যতম। সেদিনকার এদেশের পীর-মাশাযে়খ বৃন্দের যৌথ আন্দোলনের মুখে সরকার চিরতরে ফতোয়া ব›েদ্ধর পাঁয়তারা স্থগিত করতে বাধ্য হযে়ছিল। এই ফতোয়ার স্বপক্ষে সেদিন ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ যে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, তা কোটি কোটি মুসলিম জনতার মুখপত্র দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় সাক্ষাৎকার আকারে প্রকাশিত হয়। ফতোয়া সম্পর্কে হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হলে জবাবে তিনি বলেন: ‘শরীয়তে মোহাম্মদীতে চার মাজহাব কর্তৃক স্বীকৃত ফতোয়ার বিরুদ্ধে আদালত কর্তৃক যেকোন রায় মুসলমান মাত্রই প্রত্যাখান করতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে যদি কোন আদালত এরুপ কোন রায় প্রদান করে তাহলে তা ইসলাম সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা থেকেই হতে পারে। তবে এটা ঠিক, এই রাযে়র মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের ঈমানী চেতনাকে আহত করা হযে়ছে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের আদলতের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হযে়ছে। এক্ষেত্রে দেশের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানাব, তারা যেন ইসলামের মৌলিক আক্বিদা বিরোধী যে কোন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন। কেননা তাদের জানা উচিৎ যে, ঈমান হল মুসলিম জাতির প্রাণস্বরূপ। যার মধ্যে ঈমান নেই, সেই ব্যক্তি মৃতবৎ বলে কুরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক ঘোষণা দিযে়ছেন। একজন জীবিত ব্যক্তিকে প্রাণে মারার চেষ্টা করা হলে সে নিরবে বসে থাকবে কি? নাকি সে আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে?
ফতোয়া তথা ইসলামী শরীয়তের যে কোন বিধানকে বাধা গ্রস্থ করা মুমিনের প্রাণে আঘাত করারই শামিল। এ প্রসঙ্গে একটি প্রবাদ মনে পডে়, যার সারমর্ম এরূপ: একটি বিড়ালের উপর কুকুর আক্রমন করত, লেজে বা পাযে় কামড় দিলে সে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু যখন তাঁর বুকে আঘাত করে তখন সে জীবন রক্ষার্থে কুকুরের উপর ঝাঁপিযে় পডে়। তাই বলি, মুসলিম জনতার প্রাণ স্বরূপ ঈমানে আঘাত করলে তারা নিরবে বসে থাকবে এমন নিশ্চয়তা দেখা যায় না। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি দেশকে অনাকাঙ্খিত কোন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে না দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি’।

শাহজালাল (রহ.)-র দরগায় বোমা হামলার নজীরবিহীন প্রতিবাদ
২০০৪ইং সালের জানুয়ারি মাসে পীর-মাশাযে়খ ও ওলী-আল্লাহবিরোধী একটি কুচক্রী মহল সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহজালাল মুজাররদে ইয়ামনী (রহ.)’র মাজার প্রাঙ্গণে বোমা হামলা করে মাজারের পবিত্রতা নষ্ট করে। তারই প্রতিবাদে ২৩ জানুয়ারি সিলেটে আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর নেতৃত্বে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও তাঁর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ছাহেব ক্বিবলাহর সুযোগ্য নেতৃত্বে উক্ত সভাটি ছিল সিলেটের ইতিহাসে একটি নজীর বিহীন ঘটনা যা ইতিপূর্বে আর কোন সংগঠন বা ব্যক্তির পক্ষে সফল করা সম্ভব হয়নি। সকল স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় সেদিন পৃথক পৃথক ভাবে বিশালাকারে বিবৃতি তুলে ধরা হয়।

ঐতিহাসিক লংমার্চ
ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহর জীবনের সর্বশেষ আন্দোলন এটি। ২০০৬ইং সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দেশের ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা শিক্ষা ধ্বংসের অপকৌশলকারীদের বিরুদ্ধে এবং ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্স-এর মান প্রদান এবং স্বতন্ত্র আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে তৎকালীন জোট সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে ‘ঐতিহাসিক লংমার্চ’র সফল নেতৃত্ব দিযে়ছিলেন আল্লামা ফুলতলী। উপমহাদেশের ইতিহাসে বিশাল গাডি়র বহর নিযে় এতবড় লংমার্চ বাস্তবায়ন করা আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। ইসলামী শিক্ষার দূর্গ রক্ষা করার নিমিত্তে ছাহেব ক্বিবলাহর এই আন্দোলন কালের স্বাক্ষী হযে় থাকবে। ফাজিল ও কামিল জামাতের শিক্ষার্থী যারা যথাক্রমে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের মান পেযে়ছে তাদেরকে অবশ্যই ফুলতলী ছাহেবের এই ত্যাগ স্বীকারের কথা মনে রাখতে হবে। যতদিন এ জমিনে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন থাকবে, ছাহেব ক্বিবলাহর এই যুগান্তরকারী অবদান ততদিন জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

ড. কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন
১৯৭৪ সালে তৎকালীন সরকার প্রফেসর ড. কুদরত-ই খুদাকে সভাপতি করে শিক্ষা কমিশন গঠন করে। যা ‘ড.কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন’ নামে পরিচিত।
এ কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামী শিক্ষা সংক্ষোচন করে ক্রমান্বযে় ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধকে সমূলে বিনষ্ট করে স্যাকুলার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
এ কমিশনের কযে়কটি সুপারিশ ছিল:
১। ধর্মীয় শিক্ষা প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পুরাপুরী বাতিল করা হবে।
২। ধর্মীয় শিক্ষাকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা যাবে না।
৩। সরকারী খরচে সারা দেশে প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একি ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ (রহ.) এ কমিশনের বিরুদ্ধে সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিষ্ট্রারী ময়দানে এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশের আযে়াজন করেন। দেশবরেণ্য শিক্ষাবীদ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবীদ, আইনজীবী ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ এ সমাবেশে অংশ গ্রহণ করে নিজেদেরকে ধন্য করেছিলেন। ঐ সমাবেশ থেকে আল্লামা ফুলতলি ছাহেব ক্বিবলাহ (রহ.) তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে উপস্থিত সাংবাদিকগণের মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন-‘নিজের শেষ রক্ত বিন্দু দিযে় হলেও অজশ্র আউলিয়াগণের পূণ্য স্মৃতি বিজডি়ত এই দেশে ‘ড.কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন’ রিপোর্ট বাস্তবায়ন হতে দিব না। আমি এই সমাবেশ থেকে ঘোষণা করছি-আমরা এ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট মানিনা মানিনা মানিনা’। আল্লাহর অশেষ রহমত ঐ ঘোষণার পর থেকে ‘ড.কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন’র রিপোর্ট আজ পর্যন্ত আলোর মূখ দেখেনি।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল আল্লাহর আনুগত্য থেকে বঞ্চিত করতে চায় এমন কোন শক্তির কাছে তিনি কখনো মাথানত করেননি। সে শক্তি সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানই হোক বা অন্য কোন অমিততেজ অস্তিত্বই হোক। সত্যিকার অর্থেই আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ছিলেন একজন গণমূখী রাজনীতিবিদ। বস্তুত বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সত্যিকার কল্যাণ সাধন ও মুক্তি প্রদানই ছিল তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূল কথা। একজন সফল শীর্ষ পর্যাযে়র এবং ব্যাপক জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ না করে বরং সারাটি জীবন ধরে দ্বীনের খেদমতে আন্জাম দিযে়ছেন তথাপিও জীবনভর তিনি জনসাধারণের মুক্তি সাধনের জন্য কাজ করেছেন এবং রাজনীতিবিদদের জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করা উপদেশ দিযে়ছেন।
সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে পারস্পরিক সৌহার্দ, সমঝোতা ও সমন্বয় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আল্লামা ফুলতলী (রহ.)’র আকুতি ছিল সবার নিকট সুস্পষ্ট। দীর্ঘ ৯৫ বছরের জীবনে এ সমাজের বহু ঘটনা ও অর্জনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি। এ দিক থেকে তিনি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের মূর্ত প্রতীক। রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা-ভাবনার স্বচ্ছতা, সুরুচি ও সুনীতি সম্পর্কে তাঁর একনিষ্টতা, জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা এবং সমাজ ভাবনায় তাঁর ন্যায়-নিষ্ঠা যে কোন দিক থেকে তাঁকে বিচার করিনা কেন? সবগুলি এক একটা মহামূল্যবান মণি-মুক্তার মত। ভিন্নমত ও পরস্পর বিরোধী মতাদর্শের উষার মরুভূমিতে তাঁর সহনশীল মানসিকতা, সমন্বয়ধর্মী মধ্যপন্থা অনেকটা শ্যামল- সবুজ মরুদ্যানের মতো।

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *