ছাহেব কিবলা ফুলতলী : আন্দোলন সংগ্রামের কিঞ্চিৎ

‘‘সবোর্ত্তম জিহাদ হল জালিম শাসকের সামনে হক কথা বলা।’’ হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) এ জিহাদ চালিযে় গেছেন আজীবন, আমরণ। তাঁর নির্ভীকতা ও সাহসিকতা কিংবদন্তিতুল্য। সত্যপথের অভিযাত্রী এ প্রবাদপুরুষ তাঁর ঈমানী দাযি়ত্ব পালনে হযে়ছেন বুলেটের মুখোমুখি, গিযে়ছেন জেলে। তবুও থেকেছেন অবিচল অটল হিমাদ্রির মতো। ভীতি, প্রলোভন, ক্লান্তি বা বয়সের ভার কোন কিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি বিন্দুবিসর্গ পরিমাণ। তাঁর সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহ থেকে চয়নকৃত কযে়কটি আজকের পাঠকের উদ্দেশ্যে।

এক
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে বিভক্ত হল সিলেট অঞ্চলও। কুশিয়ারার এপারে সিলেটের জকিগঞ্জ, ওপারে করিমগঞ্জ (আসাম)। একই জেলার দু’অংশ দু’দেশে বিভক্ত। এপারে পাকিস্তান, ও পারে ভারত। একই তাহযিব তামুদ্দুনের অংশীদার দুপারের লোকজনের যাতায়াত ও যোগাযোগ অব্যাহত। ১৯৫০ সালে আসাম সরকার ‘মুসলিম এডুকেশন বোর্ড’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। অস্তিত্ব বিনাসী এ ঘোষণায় অস্থির আসামের মুসলিম সমাজ। বদরপুর থেকে খবর এল ওপারের মুসলমানদেরকে চরম সংকটাপন্ন অবস্থার। মুর্শিদ বদরপুরী (রহ.)-র খবর পেযে় আর স্থির থাকতে পারলেন না ফুলতলী ছাহেব কিবলা। সীমান্ত পেরিযে় চলে গেলেন আসামের বদরপুর।
সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন শাহজালালের নিশানবরদার, শাহ কামালের উত্তরাধিকার, তরিকাযে় মুহাম্মদিয়ার সিপাহসালার সাহসী সন্তান হযরত আল্লামা মো. আব্দুল লতীফ চৌধুরী-ছাহেব কিবলা ফুলতলী। ডাক দিলেন প্রতিরোধ আন্দেলনের। গডে় তুললেন দুর্বার আন্দোলন। ঝাঁপিযে় পড়লেন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে। ২/৩ টি সভার প্রতিক্রিয়ায় টনক নড়ল আসাম সরকারের। প্রতিবাদ সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। সেই সাথে গ্রেফতারি পরওয়ানা ছাহেব কিবলার ওপর। কিন্তু দমবার পাত্র নন তিনি। কর্মসূচি অব্যাহত। ‘ডবকা’ ও ‘মুড়াঝড়’ স্থানে দুটি সভা তখনও বাকি। নির্ধারিত সমযে় ছদ্মবেশে জনতার সাথে মিশে সভামঞ্চে উপস্থিত হলেন। দিলেন সংগ্রামী বক্তৃতা। তৎকালে (বৃটিশ আইনে) বক্তৃতারত কোন বক্তাকে গ্রেফতারের বিধান ছিল না। প্রেফতার করতে হত বক্তৃতা শেষে। কিন্তু ততক্ষণে তিনি উধাও।
উদ্বিগ্ন সরকার মরিয়া হযে় এবার জারি করল গুলির আদেশ। গুলির অর্ডার মাথায় নিযে় পরবর্তী সভায় হাজির হলেন হাতি চডে়, বক্তৃতাও দিলেন হাতির পিঠে দাঁডি়যে়। বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই মাগরিবের আযান। ইত্যবসরে জনতার ভিডে় মিশে মুস্তাকিম আলী চৌধুরীর সাথে জামা বদল করে ঝর্ণার পানিতে অযু করতে গিযে় পলকে ঝর্ণা পেরিযে় জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। এবারও ব্যর্থ পুলিশ ও সেনাবাহিনী।…. অবশেষে পরাজয় হল সরকারের। জয় হল ছাহেব কিবলার। জয় আসামের মুসলিমদের। আন্দোলনের মুখে সরকার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হল।

দুই
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামল। তার আর্শীবাদ ধন্য ইসলামী অ্যাডভাইজারি কাউন্সিলের ডাইরেক্টর ড.ফজলুর রহমান প্রদত্ত ইসলামের অপব্যাখ্যার প্রতিবাদে উত্তাল দেশের উভয় অঞ্চল। ফুলতলী ছাহেব কিবলা সিলেটে এক বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিলেন। সরকার তৎপর হল সমাবেশ বন্ধ করতে। মন্ত্রী দেওয়ান আব্দুল বাসিত চৌধুরী (সিলেটি) এসে সমাবেশ বন্ধ করার অনুরোধ জানালে, ছাহেব কিবলা তাঁর দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, সমাবেশ হবেই। এক পর্যাযে় মন্ত্রী একটু নমনীয় হযে় একজন অতিথির নাম উল্লেখ করে, তাকে সম্মেলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পরামর্শ দেন। ছাহেব কিবলা তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, প্রোগ্রামের নড়চড় হবে না। যেভাবে ঘোষণা হযে়ছে, সেভাবেই হবে। রেগে গেলেন মন্ত্রী। সভায় গুলিবর্ষণের হুমকি দিলেন। ছাহেব কিবলা বললেন: দেওয়ান সাহেব! ভয় দেখাবেন না। আপনার পূর্ব পুরুষরাতো বীরপুরুষ ছিলেন। আপনি সরকারের গোলামী করে পৌরুষ হারিযে় ফেলেছেন। আপনার পুলিশদের আপনি গুলির অর্ডার দিন। ইন্শাআল্লাহ, আমিও ইসলামী ফৌজ নিযে় তার যথার্থ মোকাবেলা করব।
যথাসমযে় বিপুল সমারোহে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ-অনুষ্ঠিত হল। পরবর্তীতে দেওয়ান বাছিত সাহেব লজ্জিত ও অনুতপ্তভাবে হাজিরি দিলেন ছাহেব কিবলার দরবারে। তিনি মুরিদও ছিলেন। উভযে়র মধ্যে বিদ্যমান ছিল সম্পর্ক, আর অটুট ছিল জীবনভর।

তিন
১৯৫৬ সালে তদানীন্তন সরকারের ‘নিউস্কীম মাদ্রাসা বিলোপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা হাই কোর্ট ধারে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সম্পর্কিত সরকারি ‘আদেশ নামা’ ছিঁডে় টুকরো টুকরো করে ছাহেব কিবলা বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ দিলেন, ‘‘ইসলামী শিক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলাম। এ জিহাদ চলবে।’’ এতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া শুরু হল। সারাদেশে চলতে থাকল প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ সমাবেশ। আজো টিকে আছে নিউস্কিম মাদ্রাসা।

চার
সিলেট শহরের ‘সারদা হলে’ একবার যাত্রা প্রদর্শনীর আযে়াজন প্রস্তুতি চূড়ান্ত। প্রশাসন জডি়ত থাকায় স্থানীয় আলেম সমাজ প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হযে় অবশেষে ছাহেব কিবলা ফুলতলীর স্মরণাপন্ন হলেন। তিনি এলেন। সিলেটের ‘ডি.সি.’র সাথে দেখা করলেন। ‘ডি.সি’ বললেন, এটা ‘এডিসি’র দাযি়ত্বে তার সাথে কথা বলুন। ছাহেব কিবলা তার মুখের উপর প্রশ্ন ছুঁডে় দিলেন, ‘এডিসি’ কি আপনার চেযে় বড়? অগত্যা গেলেন এডিসির কাছে। সে বলল, ‘বুখারী শরীফে তো গান-বাজনার কথা আছে।’ তার এ মূর্খসুলভ ঔদ্ধ্যত্যের উপর চপেটাঘাত বসালেন এ বলে, ‘‘তুমি সরকারের চাকরি কর, না বুখারি শরীফ পড়াও?’’ ‘এডিসি’- তখন লাজওয়াব। সেখান থেকে বেরিযে় এসেই ফোন ধরালেন বিভাগীয় কমিশনার (চট্টগ্রাম) কে। বললেন, আপনার ‘ডিসি’, ‘এডিসি’ সামলান। নতুবা উদ্ভুত পরিস্থিতির দায় প্রশাসনের। লাটে উঠল যাত্রানুষ্ঠানের সব আযে়াজন।

পাঁচ
মাদ্রাসা শিক্ষকদের একক সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কে ভেঙ্গে খানখান করার সব আযে়াজন সমাপ্ত। মাওলানা এম.এ.মান্নানের ডাকে বিজয় স্মরণীতে আহ্বান করা হল সংগঠনের জাতীয় সম্মেলন। প্রধান অতিথি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রধান অতিথির ডানে-বামে বাংলার দুই মর্দে মুজাহিদ শর্ষীণা ও ফুলতলী পীর সাহেবদ্বয়। প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে বক্তব্য রাখলেন দু’জনেই। ছাহেব কিবলা ফুলতলী তাঁর বক্তব্যে এক ঐতিহাসিক কাহিনীর অবতারণা করে বললেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব! জমিয়াতের উপর হাত দিবেন না। ওটা আমাদের সংগঠন। পীর-মাশাযে়খদের আর্শীবাদ ধন্য সংগঠন। কেউ ওটা ভাঙ্গার চেষ্টা করলে তার পরিণতি শুভ হবে না।

ছয়
বিগত (৯৬-২০০০) আওয়ামী শাসনামলে কতিপয় অজুহাত তুলে কযে়ক’শ মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হল, আরো বন্ধকরার পাঁয়তারা চলছিল। প্রতিবাদ হচ্ছিল দেশজুডে়। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ চত্বরে অনুষ্ঠিত হল প্রতিবাদ সমাবেশ। জমিয়াতের অন্যতম উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক আল্লামা ছাহেব কিবলা ফুলতলী (রহ.) উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হল সমাবেশ থেকেই ‘‘বিক্ষোভ মিছিল করে যাওয়া হবে প্রধানমন্ত্রী দপ্তরে পেশ করা হবে স্মারকলিপি। চারদিকে সশস্ত্র দাঙ্গা পুলিশ। মাদরাসা হুজুররাতো আর মাঠের লড়াকু সৈনিক নন। ভয় পাচ্ছেন অনেকে। শুরু হযে়ও হচ্ছে না বিক্ষোভ মিছিল। সামনে এসে দাঁড়ালেন ছাহেব কিবলা ফুলতলী (রহ.) মাথায় তাঁর সেই সবুজ পাগডি়। হাতে লাটি। তেজদৃপ্ত চেহারা। তিনি বজ্রনির্ঘোষে বললেন, আমি থাকব মিছিলের সর্বাগ্রে। যদি গুলি হয় প্রথমে লাঘবে আমার বুকে। আমি শহীদ হব। কে কে রাজি আছ আমার সাথে যেতে, এগিযে় এসো। সামনে চল। এক বিদ্যুৎ প্রবাহ যেন ছডি়যে় গেল। নারাযে় তাকবীর, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিযে় শুরু হল বিক্ষোভ মিছিল। বীর দর্পে এগিযে় চলল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর অভিমুখে’’। (বর্ণনা : কবি রুহুল আমীন খান)

সাত
৭ ফেব্র“য়ারী ২০০৭। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযে়র একটি হলের বিতর্কিত নামকরণ বিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সিলেট কোর্ট পযে়ণ্টে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন আল্লামা ছাহেব কিবলা ফুলতলী (রহ.)। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও জনসমর্থনের কারণে কর্তৃপক্ষ সেদিন তাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়।

আট
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ফাযিল-কামিল স্তরকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালযে়র অধিভূক্ত করে, মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্ব বিনাসী সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে ৬ শতাধিক গাডি় বহর নিযে় ঢাকা অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চ করলেন। জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে সমাপ্ত হল লংমার্চ। শাপলা চত্বর থেকে পল্টন মোড় লোকে লোকারণ্য। মঞ্চে দাঁড়ালেন ছাহেব কিবলা। চেহারায় জ্বলছে তাঁর তেজঃবহ্নি। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘‘বন্ধ কর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালযে়র অধীনে মাদ্রাসা ন্যস্ত করার ষড়যন্ত্র। কাযে়ম কর ইসলামী আরবী বিদ্যালয়। বাতিল কর মাদ্রাসায় ৩০% মহিলা শিক্ষক নিযে়াগের বাধ্যতামূলক আদেশ। অন্যথায় কেবল সিলেট থেকে নয়, সব বিভাগ ও জেলা থেকে লংমার্চ ঢাকায় আসবে।’’
প্রতিক্রিয়া হল সরকারি মহলে। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে সমঝোতার পদক্ষেপ নেয় হল। সরাসরি আলোচনা হল। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী সব দাবী বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করলেন। ছাহেব কিবলা বললেন, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধানের খেলাফ করলে তাঁর গজব ডেকে আনা হয়। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন।’’
বিপদ আসন্ন বুঝে সরকার ফাযিল-কামিল শ্রেণীকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালযে়র পরিবর্তে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালযে়র অধিভূক্ত করে উপস্থিত আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষা পায় বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, ওয়াদা খেলাফের গজব তারা ডেকে এনেছিল ঠিকই। সে ইতিহাস জাজ্বল্যমান।

নয়
আজ আর নয়। আল্লামা ছাহেব কিবলা ফুলতলী (রহ.) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সমযে় ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বরাবরই জাতীয় অভিভাবকত্বের ভূমিকা পালন করেছেন আমৃত্যু। নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা আরো শাণিত ও সমুজ্জ্বল। বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে মুসলিম নির্যাতন ও নিধনের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ইসলামী বিশ্ব পরমশ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ রাখবে বহুদিন, বহুকাল। আর তিনি আমাদের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে ‘রাহ্নুমা’ হযে় ধ্র“বতারার মতো শুভ্র সমুজ্জ্বল থাকবেন চিরকাল।

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *