কুরবানীর তাৎপর্য ও কয়েকটি মাসআলা

মানুষ আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। আপন সেরা সৃষ্টিকে দয়াময় আল্লাহ নানা উপায়ে স্বীয় সান্নিধ্য ও নৈকট্য দান করেন। এসকল উপায়ের অন্যতম হলো কুরবানী। নৈকট্য, ঘনিষ্টতা, উপঢৌকন ও সান্নিধ্য লাভের উপায় ইত্যাদি অর্থ জ্ঞাপক ‘কুরব’ শব্দ থেকে কুরবানী শব্দের উৎপত্তি। যেহেতু কুরবানীর মাধ্যমে মানুষ তার আপন রবের নৈকট্য ও ঘনিষ্টতা অর্জন করে থাকে সেহেতু একে কুরবানী বলা হয়।
প্রথম মানব ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ.)-এর যামানা থেকেই কুরবানী প্রথা শুরু হয়েছে। আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল ও কাবিল এর কুরবানীই প্রথম কুরবানী। অবশ্য, তখন এর পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। বর্তমানে প্রচলিত কুরবানী হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মাধ্যমে শুরু হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর মহান ত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত কুরবানী যেমন হজ্জের বিধানের অন্তর্ভূক্ত তেমনি এটি সাধারণভাবে সামর্থবান প্রত্যেক মুসলমানের উপরও আবশ্যকীয় (ওয়াজিব)।
কুরবানী অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল। হাদীস শরীফে আছে, হযরত যায়দ ইবনু আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কুরবানী কি? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নাত। সাহাবায়ে কিরাম আবার আরয করলেন, এতে আমাদের কি কল্যাণ নিহিত রয়েছে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। তোমরা মোটা তাজা পশু যবেহ করো। কেননা এগুলো পুলসিরাতে তোমাদের বাহন হবে (ইবনু মাজাহ)।
হযরত আয়িশা (রা.) বর্ণিত অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ঈদের দিনে আদম সন্তানের সর্বোৎকৃষ্ট আমল হলো কুরবানী করা। কুরবানীদাতা কিয়ামতের দিন কুরবানীকৃত পশুর শিং, লোম ও হাড়গুলোসহ উপস্থিত হবে। নিংসন্দেহে কুরবানীর উদ্দেশ্যে যবেহকৃত পশুর রক্ত যমীনে পড়ার আগেই তা আল্লাহ’র দরবারে কবূল হয়ে থাকে। (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ)
কুরবানী আল্লাহর দরবারে মকবূল হবার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ শর্ত অবশ্য রয়েছে। আর তা হলো- কুরবানীদাতার নিয়ত অবশ্যই খালিস হতে হবে। কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি। কুরআন মজীদের ভাষ্যানুযায়ী তাকওয়ার ভিত্তিতে কৃত কুরবানীই কেবল কবূল হয়ে থাকে।

কুরবানী শুরুর ঘটনা
কোন্ প্রেক্ষিতে কিভাবে কুরবানী এ কুরবানী শুরু হলো তাঁর সুদীর্ঘ বর্ণনা মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদীসে নববীতে রয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র ইসমাইল (আ.) যখন একটু বড় হন তখন ইবরাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখেন তিনি প্রিয়তম পুত্রকে কুরবানী করছেন। নবীগণের স্বপ্ন ওহী। তাই তিনি স্বপ্নের আলোকে পুত্রকে কুরবানীর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তিনি এ বিষয়ে পুত্রকেও জিজ্ঞাসা করেন। পুত্রতো ভবিষ্যতের নবী। সুতরাং তিনি কি আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে যেতে পারেন? তিনি সানন্দে জানিয়ে দিলেন যে, পিতাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে তিনি যেন তা প্রতিপালন করেন। সাথে সাথে এ নিশ্চয়তাও দিলেন যে, আল্লাহ চাইলে পিতা তাঁকে এক্ষেত্রে ভীত কিংবা বিচলিত পাবেন না বরং ধৈর্যশীলই পাবেন। আল্লাহর নির্দেশমতো ইবরাহীম (আ.) যখন প্রিয়তম পুত্রকে কুরবানী করার জন্য মাটিতে কাত করে শোয়ালেন তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে তা কবূলের সুসংবাদ পেলেন। তখন আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের স্থলে একটি দুম্বা কুরবানী করলেন। ইবরাহীম (আ.)-এর প্রতি কুরবানীর এ নির্দেশকে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ‘স্পষ্ট পরীক্ষা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং সে পরীক্ষায় বিজয়ী হবার ফলে পুত্র কুরবানীর মতো বড় বিষয় থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন। আর এ মহান ত্যাগের স্মৃতিকে পরবর্তীদের মধ্যে আল্লাহ স্থায়ী করে দিয়েছেন কুরবানীর বিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে। ফলে আজো মুসলিম জাতি ঈদুল আযহায় পশু কুরবানীর মাধ্যমে সে কুরবানীর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি নিজেরাও ত্যাগের নজরানা পেশ করতে সচেষ্ট হয়।

কুরবানীর সময়কাল
কুরবানীর নির্ধারিত সময় হলো ১০, ১১ ও ১২ যিলহজ্জ এই তিন দিন। উক্ত দিনগুলোর যে দিন ইচ্ছা কুরবানী করা যেতে পারে। তবে প্রথম দিন অর্থাৎ দশ যিলহজ্জ কুরবানী করা উত্তম। তারপর পর্যায়ক্রমে ১১ ও ১২ তারিখেও কুরবানী করা যায়। তবে কোনো কারণ ব্যতীত বিলম্ব না করাই উত্তম। নির্ধারিত তিন দিন সকাল হতে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময় দিনে বা রাতে কুরবানী করা যায়। তবে রাতে কুরবানী করা মাকরূহ। (আলমগীরী, ৫ম খণ্ড)

কুরবানীর শর্তাবলী
নিন্মোক্ত শর্তসাপেক্ষে কুরবানী ওয়াজিব হয়। যেমন-
১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া। যাকাত, ফিতরা ও কুরবানীর নিসাব একই অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) অথবা সাড়ে সাত তোলা সোনা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) কিংবা সমমূল্যের টাকা বা ব্যবসায়িক মাল। কোনো স্বাধীন, জ্ঞানবান, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান যদি উপরোক্ত পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। যার উপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব, তার উপর কুরবানীও ওয়াজিব। তবে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পদ পূর্ণ এক বছর মালিকানায় থাকা শর্ত। কুরবানীর ক্ষেত্রে তেমন শর্ত নয়। বরং কুরবানীর দিনসমূহে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে কুরবানী ওয়াজিব হবে।
২. আযাদ হওয়া। সূতরাং ক্রীতদাস-দাসীর উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৩. মুসলমান হওয়া। সূতরাং কাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৪. মুকীম হওয়া, কাজেই মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তবে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য পূর্ণ সময় মুকীম হওয়া শর্ত নয়। তাই যদি কোনো ব্যক্তি প্রথম ওয়াক্তে মুসাফির থাকে আর শেষ ওয়াক্তে মুকীম হয়ে যায়, তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। এমনভাবে যদি শুরুতে মুকীম থাকে পরে সফর করে, শেষে আবার মুকীম হয়ে যায়, তাহলে তার উপরও কুরবানী করা ওয়াজিব। এ হুকুম তখন প্রযোজ্য হবে যখন সে কুরবানীর পশু ক্রয় করার পূর্বে সফর করবে। মালিকে নিসাব ব্যক্তি যদি দশই যিলহজ্জের পূর্বে কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু ক্রয় করে এবং ঐ তারিখের পূর্বেই সফরে বের হয় তবে কুরবানী করা না করা তার ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা করলে সে ঐ পশু বিক্রয় করে ফেলতে পারবে। আর যদি দশই যিলহজ্জের পরে পশু ক্রয় করে সফরে বের হয় তবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে মালিকে নিসাব নয় এমন ব্যক্তি যদি ঐরূপ করে তবে তার ঐ পশু দিয়ে উভয় অবস্থায় কুরবানী করা ওয়াজিব। (আলমগীরী, ৫ম খণ্ড)

কুরবানীর পশু
ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট দ্বারা কুরবানী করা জায়িয। এগুলো ছাড়া অন্য কোনো পশু দ্বারা কুরবানী জায়িয নয়। (হিদায়া, ৪র্থ খণ্ড)
ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কুরবানীর জন্য এক বছরের হওয়া জরুরী। যদি ছয় মাসের দুম্বা বা ভেড়া এরূপ মোটা তাজা হয় যে, দেখতে এক বছরের মতো মনে হয় তাহলে এ ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়িয। ছাগল যত মোটা তাজাই হোক না কেন এর জন্য এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরী। এক বছর থেকে একদিন কম বয়সী হলেও এর দ্বারা কুরবানী করা জায়িয হবে না। (শামী, ৫ম খণ্ড)
গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর হওয়া আবশ্যক। এর চেয়ে একদিন কম বয়সী হলেও কুরবানী সহীহ হবে না। (শামী, ৫ম খণ্ড)
কুরবানী আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়। তাই কুরবানীদাতার উচিত দোষমুক্ত ও মোটাতাজা পশু কুরবানী করা।

একই পশু দ্বারা একাধিক ব্যক্তির কুরবানী করা
গরু, মহিষ বা উট এই তিন প্রকার পশুর প্রত্যেকটিতে সাত ব্যক্তি পর্যন্ত শরীক হয়ে কুরবানী করতে পারবে। তবে এ অবস্থায় কুরবানী জায়িয হওয়ার জন্য শর্ত হলো, কারো অংশ যেন এক সপ্তমাংশ হতে কম না হয়। আর প্রত্যেক শরীককে কুরবানী দ্বারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত রাখতে হবে। যদি তাদের একজনও কেবলমাত্র গোশত খাওয়ার নিয়ত রাখে তবে কারো কুরবানীই হবে না। অনুরূপভাবে যদি কোনো শরীকের অংশ এক সপ্তমাংশ হতে কম হয় তবে সকলের কুরবানীই নষ্ট হয়ে যাবে। (আলমগীরী, ৫ম খণ্ড)
ছাগল, ভেড়া অথবা দুম্বা যত বড়ই হোক না কেন এগুলোতে একাধিক ব্যক্তি শরীক হতে পারবে না। এক একটিকে একজন ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানী করতে হবে।

কুরবানীর পশুর গোশত, হাড্ডি, চামড়া ইত্যাদির বিধান
কুরবানীর গোশত আত্মীয় স্বজনকে দিবে, নিজে খাবে এবং ফকীর মিসকীনকে দান করবে। উত্তম হল গোশতকে তিন ভাগ করে একভাগ মিসকীনকে দেওয়া, একভাগ আত্মীয় স্বজনকে দেওয়া আর একভাগ নিজ পরিবারের জন্য রাখা। তবে সম্পূর্ণ গোশত নিজেদের খাওয়াও জায়িয। (শামী ৫ম খণ্ড)
একাধিক ব্যক্তি একটি পশু কুরবানী করলে তার গোশত অনুমান করে ভাগ করা জায়িয নয় বরং ওযন করে ভাগ করে নিতে হবে। তবে গোশতের সাথে মাথা, পায়া, চামড়া ও হাড্ডি মিলিয়ে তা অনুমান করে ভাগ করে নিলে জায়িয হবে। ওযন না করলেও চলবে।
কুরবানীর গোশত, হাড্ডি বা মাথা ইত্যাদি কোনো অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে কাউকে দেওয়া জায়িয নয়। অনুরূপভাবে কুরবানীর পশুর চামড়াও কাউকে কোনো কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়িয নয়।
কুরবানীর চামড়ার প্রাপক হলো গরীব মিসকীন। সুতরাং কোনো মাদরাসা মক্তবের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াযযিন বা অন্য কোনো কর্মচারীকে বেতন হিসাবে তা দেওয়া জায়িয হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ)
কুরবানীর চামড়ার টাকা দিয়ে মসিজদ, মাদরাসা নির্মাণ করা বা মেরামত করা অথবা জনহিতকর কোনো কাজ করা যেমন রাস্তা-ঘাট, পুল ইত্যাদি নির্মাণ বা মেরামত করা জায়িয নেই। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড)
যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত একমাত্র তারাই চামড়ার টাকা পাবে। চামড়া বিক্রি করার পর যে টাকা হাতে আসে তা অবিকল দান করবে। তার মধ্যে পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। (শামী, ৫ম খণ্ড)
কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি না করে চাইলে নিজেও ব্যবহার করতে পারে। যেমন মুসল্লা বানানো, চামড়ার পাত্র ইত্যাদি তৈরী করা। এই চামড়া অপরকে হাদিয়া হিসাবেও দিতে পারে। তবে যদি টাকা পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় তাহলে এর একমাত্র হকদার হবে গরীব মিসকীন। তাদেরকে সাদকা করে দিতে হবে। (জাওয়াহিরুল ফিকহ)
কুরবানী করা যেমন সওয়াবের কাজ তেমনি কুরবানী না করার পরিণামও অত্যন্ত ভয়াবহ। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করে না তাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করেছেন। সুতরাং খালিস নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশায় আমাদের কুরবানী করা উচিত।

Comments

comments

About

Check Also

আল্লামা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল

ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে যে কয়জন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এ ভারত উপমহাদেশে কাব্য ও …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *