মানব সমাজ আজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। দিন দিন বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। মানুষের সম্পদ, সম্ভ্রম; এমনকি জীবনও নিরাপত্তাহীন। মানুষের হাতেই মানুষ জিম্মি। শিশু ও নারী নির্যাতন এখন নিত্য- নৈমিত্তিক ঘটনা। অবৈধ লালসা, অশুভ কামনা ও অসহিষ্ণু মনোভাব মানুষকে হিংস্র করে তুলেছে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, হত্যা মহামারি আকার ধারণ করেছে।
সমাজকে এসব সমস্যার কালো মেঘ থেকে মুক্ত করে সোনালী আভায় উদ্ভাসিত করতে ইসলাম দিযে়ছে সমযে়াপযোগী সর্বাধুনিক দিক নির্দেশনা তথা সর্বোৎকৃষ্ট জীবনব্যবস্থা।
ইসলামে কোন অপরাধই সামান্য নয়। সমাজ থেকে সার্বিক অপরাধের মূলোৎপাটনের জন্য ইসলাম আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। সর্বপ্রকার পক্ষপাত, দলীয়করণ ও ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সামাজিক ন্যায়বিচারের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ। সম্ভ্রান্ত এক মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হলে দন্ড থেকে মুক্তির জন্য যখন গোত্রপতিরা সুপারিশ করতে এসেছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন সাফ জানিযে় দিলেন, ‘মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করত, আমি তাঁরও হাত কেটে দিতাম।’ মদ পানের অপরাধে হযরত ওমর (রা.) স্বীয় পুত্রকেও দোররা থেকে রেহাই দেননি। অপরাধ নির্মূলের জন্য দণ্ড আরোপই যথেষ্ট। তাই ইসলাম যেমন নির্ধারণ করেছে প্রতিটি অপরাধের- ভিন্ন ভিন্ন দণ্ডবিধি, অপরদিকে সংশোধনের জন্য দেখিযে়ছে পরকালে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের অনাবিল অশেষ সুখের সম্ভাবনা। অপরাধ দূরীকরণে যুক্তি ও কৌশলের মাধ্যমে মানসিকতা পরিবর্তনের ওপরও গুরুত্ব দিযে়ছে ইসলাম। একজন যুবক যখন ব্যভিচারের অনুমতি চেযে়ছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে শাস্তি কিংবা ধমক না দিযে় যুক্তির মাধ্যমে তার হৃদযে়র সুকুমার বৃত্তি জাগ্রত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমার মাতা কিংবা ভগ্নির সাথে কেউ এমনটি করতে চাইলে তুমি কি সুযোগ দেবে।’ এতে ঐ যুবক অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হয়।
প্রত্যেক মুসলমানের নিকট অন্য মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম সবই পবিত্র। এগুলোর হানি করা নিষিদ্ধ; দণ্ডনীয়। কেউ এমনটি করলে বিচারে সমপরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ রযে়ছে। পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা- জীবনের পরিবর্তে জীবন, চোখের বিপরীতে চোখ, কানের বদলে কান। সব আঘাতেরই প্রতিঘাত আছে। তবে ক্ষমাই শ্রেয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ যে তোমার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করল, তুমি তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করো, যে তোমার ওপর অত্যাচার করল, তুমি তাকে ক্ষমা করো, আর যে র্দুব্যবহার করল, তুমি তার সাথে সদ্ব্যবহার করো।’
শুধু মুসলমানের নয়, মানুষ হিসেবে নির্বিশেষে অমুসলিমদেরও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিযে়ছে ইসলাম। মদীনার সনদে ইহুদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিকদেরও মুসলমানদের সমান নাগরিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও ধর্মীয় অধিকার সহ সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করা হযে়ছিল। এমনকি অমুসলিম যুদ্ধবন্দীদের সাথে সদ্ব্যবহার করার প্রকৃষ্ট উপমা রযে়ছে ইসলামে। মানুষতো দূরে থাক, বরং অহেতুক যে কোন প্রাণী বধ করা; এমনকি অকারণে গাছের পাতাটি ছেঁড়াও ইসলামে গর্হিত ও অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। সৃষ্টজীব ও পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর তাগিদ দিযে় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক কথায় বলেছেন, পৃথিবীতে যা যা আছে, সব কিছুর ওপর তোমরা সদয় হও, আকাশে যিনি আছেন (আল্লাহ), তোমাদের করুণা করবেন।
চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণসহ যাবতীয় মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ পৃথিবীতে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না।’
সুদ-ঘুষ, দুর্নীতির অভিশাপে সমাজে ধনী আরও ধনী হয়, গরিব আরও নিঃস্ব হয়। অযোগ্যরা পদ দখল করে সমাজকে বিষিযে় তোলে। তাই ইসলাম এগুলোকে সম্পূর্ণ হারাম ও দণ্ডনীয় ঘোষণা করে আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সততার সাথে ব্যবসা ও অন্যান্য পেশার প্রতি উৎসাহিত করেছে। সাথে সাথে বিত্তশালীদের প্রতি যাকাতের নির্দেশ দিযে়ছে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক, আর মানব সৃষ্ট বিপর্যয় হোক, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বিপদগ্রস্থের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিযে়ছে ইসলাম। কত চমৎকার ভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহায্য করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বলেছেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ কোনো বান্দাকে সাহায্য করেন, যতক্ষণ সে তার ভাইযে়র সাহায্যে রত থাকে।’ নারী, মানব জাতির অর্ধেক হযে়ও যুগে যুগে অবহেলিত হযে় আসছে। বিশেষতঃ আইয়ামে জাহেলিয়ায় পশু পাখির মূল্যও পায়নি নারী। কন্যা শিশুকে জীবন্ত পূঁতে রাখা হতো। ইসলাম নারী-শিশুর সেই দুর্দিন ঘুচিযে় সম্পদ ও সম্ভ্রমের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বিদায় হজের ভাষণে অত্যাচারী পুরুষদের সতর্ক করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।’ এভাবে শিশু ও বৃদ্ধের অধিকার নিযে়ও ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ করে না এবং বড়কে সম্মান করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’
হাক্কানী আলেম-উলামা, পীর-মাশাযে়খ, যারা নবীগণের উত্তরসূরী ও আল্লাহর খলীফা হিসেবে মানুষকে সৎ পথে আহ্বান করেছেন এবং অসৎ পথ থেকে ফিরিযে় রাখার চেষ্টা করছেন, ইসলাম তাদের সমুন্নত মর্যাদা ঘোষণা করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘ যারা ঈমান গ্রহণ করবে এবং জ্ঞান প্রাপ্ত হবে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বহুস্তরে সমুন্নত করবেন।’
দেশ ও দেশের মাটি, সংস্কৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা সৃষ্টিগত। যতক্ষণে দেশ ও দেশীয় সংস্কৃতি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, ততক্ষণ তা গ্রহণযোগ্য। হিযরতের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম ভূমির দিকে ফিরে ফিরে তাকিযে়ছেন আর বলেছেন, ‘হে আমার মাতৃভূমি! যদি আমার নিজ জাতির লোকেরা আমাকে বের হতে বাধ্য না করত আমি তোমাকে ছেডে় যেতাম না।’ এটি তো সুস্পষ্ট যে, দেশের প্রতি গভীর মমতাবোধ থাকা সত্ত্বেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু ইসলামকে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই হিযরত করেছিলেন। কবি সাহাবীগণ ইসলামের ঐতিহ্য নিযে় কবিতা লিখতেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ভালোবেসে লিখতেন, এমনকি উহুদ পাহাডে়র মতো বিষয় নিযে়ও তাদের কবিতা ছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে বাঁধ সাধেননি, বরং উৎসাহ দিযে়ছেন।
সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম শুধু অন্তঃসারশূন্য অনুষ্ঠান সর্বস্ব কোন ধর্ম নয়; বরং মানব জীবনের আনুষঙ্গিক সব বিষযে়র সমাধান দিযে়ছে ইসলাম। মানুষ শুধু শান্তির সম্মুখীন হোক, ইসলাম তা আদৌ চায় না; ইসলামের বিধি-নিষেধ হচ্ছে মানবতার পক্ষে, মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের স্বার্থে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ নিশ্চয়ই সে জাতির উন্নতি সাধন করেন না, যারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করে।’ ইসলামের ভিত্তিতেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর নিকৃষ্টতম সময়, বর্বরতার যুগকে সোনালি যুগে রুপান্তরিত করেছিলেন মাত্র তেইশ বছরের কর্মসূচিতে। সামাজিক সমস্যাবলি সমাধান করে সুন্দর স্বনির্ভর দেশ ও সমাজ গঠনের জন্য আমাদেরকে তা-ই অনুসরণ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
Check Also
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ইদানিংকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। জাতি সংঘ সহ সারাবিশ্বের সব দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি …