নজরুলীয় দুর্বিনয় : শেষ কোথায়?

“বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির”
নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গগনবিদারী উচ্চারণ আর জাগরণের মন্ত্রে দীপ্ত বিদ্রোহের এ গানটি লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই তিনি বিদ্রোহী কবি। তাঁর সাহিত্য বিচারে কেউ তাঁকে বলেছের সাম্যের কবি, কেউ বলেছেন মানুষের কবি, মানবতার কবি। কেউ বলেছেন প্রেমের কবি আবার কেউ বলেছেন ইসলামী রেনেসাঁ বা জাগরণের কবি। মূলত তিনি একই সঙ্গে সকল অভিধায় অভিষিক্ত হবার পূর্ণ দাবি রাখেন। তাঁর কাব্য বিচার-বিশ্লেষণে যে কেউই এটা স্বীকার করবেন।
আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে কবি নজরুল এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। যেহেতু সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অনিশ্চিত, বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল পরিবেশের সাক্ষী হযে় কবি প্রতিভার সূত্রপাত, সেহেতু তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে নিপীডি়ত জনগণের দীর্ঘশ্বাস, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ট বিদ্রোহ। বঞ্চিতের প্রতি নিবিড় সহানুভূতি নিযে় কবির চেতনার গভীরে যে ক্ষোভ অসহনীয় উত্তাপে ফুটে উঠেছিল তা প্রকাশের তীব্র আকুতিই তাঁর কাব্য প্রেরণার মূল উৎস। বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আরো বঞ্চিত করে বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ করে যে আইন, কবি ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি ঘোষণা করেন :
“আমি দূর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল
আমি দলে যাই যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।”
মূলত কবির বিদ্রোহী উচ্চারণ শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রতিবাদ। এ সংগ্রামী প্রতিবাদ থেকে কবি তখনই শান্ত হবেন যখন অবসান ঘটবে সকল অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার। কবির ভাষায় :
“আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়নের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।”
কবি নজরুলের প্রতিবাদী এমন অনেক কবিতা পডে় তাঁকে কেউ কেউ ‘বেপরোয়া’ ভাবলেও তাঁর এ বেপরোয়া বিচরণের একটি সীমারেখা আছে। এ সীমারেখা চিহ্নিত করেছেন প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ইসহাক সিদ্দীকী তার ‘নজরুলীয় দুর্বিনয় : মনস্তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত’ নামক এক প্রবন্ধে এভাবে- “কিন্তু আরবি ‘আল্লাহ’ শব্দটির সাথে সাথে নজরুলীয় ঔদ্ধত্য লিপ্ত হয়নি কখনো তাঁর কবিতা কিংবা গানে। অথচ তাঁর ইসলামী ও মরমী রচনাবলীতে এ শব্দের রযে়ছে সুনির্মল, ¯িœগ্ধ ও পরম সম্মানিত স্থান, যা সমস্ত ক্রোধ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, ঘৃণা ও স্বেচ্ছাচারের উর্ধ্বে। আমরা জানি, কাল-পাত্র নির্বিশেষে মুসলিম মানসে আল্লাহ নামের যে অনন্য মাহাত্ম্য ও ব্যঞ্জনা এর বিকল্প পরমার্থিক অন্য কোনো নামে নেই, বিভাষা তো দূরের কথা। এ দিক থেকে দেখতে গেলে পরম সত্তার নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী সেই জন্মগত ভেদজ্ঞান চরম দুর্বিনয় প্রকাশের কালেও নজরুলকে রেখেছিল সুরক্ষিত ও সচেতন।”
কাজী নজরুল ইসলাম স্বীয় বক্তব্যেও আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় ফুটিযে় তুলেছেন। যেমন তাঁর বক্তব্যে আছে :
১. আল্লাহ আমার প্রভূ। রাসুলের আমি উম্মত, আল কোরআন আমার পথপ্রদর্শক।
২. বিদ্বেষ আমার ধর্মবিরুদ্ধ। আমার আল্লাহ নিত্য পূর্ণ পরম অভেদ্য, নিত্য পরম প্রেমময়, নিত্য সর্বদ্বন্ধাতীত। কোনো ধর্ম, কোনো জাতি বা মানবের প্রতি বিদ্বেষ আমার ধর্মে নাই, কর্মে নাই, মর্মে নাই। মানুষের বিচারকে আমি স্বীকার করি না, ভয়ও করি না। আমি একমাত্র পরম বিচারক আল্লাহ ও তাঁর বিচারকে জানি। (আমার লীগ কংগ্রেস)
কবি স্বীয় কবিত্বশক্তিকেও আল্লাহর দান হিসেবে স্বীকার করে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। তিনি বলেছেন : আমার কবিতা আমার শক্তি নয়, আল্লাহর দেওয়া শক্তি। আমি উপলক্ষ মাত্র। বীণার বেণুতে সুর বাজে, কিন্তু বাজান যে গুণী সকল প্রশংসা তাঁরই।
অসংখ্য কবিতা ও গানেও কবি আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং তাঁরই হামদ গেযে়ছেন। সর্বোপরি সকল হিংসা-বিদ্বেষ ও স্বেচ্ছাচারিতার উর্ধ্বে এক আল্লাহতে আত্মনিবেদন করত তাঁর উপর তাওয়াক্কুল তথা পূর্ণ ভরসা রেখেছেন। কবি দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করেন :
“উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।”
শেষ কথা হলো, কবি নজরুল স্বাধীনতার প্রশ্নে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের শাসন-শোষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন। তাই তাঁর অনেক কবিতা ও গানে দ্রোহের বাণী উচ্চারিত হযে়ছে, চরম দুর্বিনয় প্রকাশিত হযে়ছে তাঁর লেখা ও বক্তব্যে। কিন্তু এ দুর্বিনয় ও বেপরোয়া বিচরণ আরবি ‘আল্লাহ’ শব্দের সাথে লিপ্ত হয়নি। মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস ও দৃঢ় আস্থা।

Comments

comments

About

Check Also

ইবাদতের বসন্তকাল রমজান

ঋতুরাজ বসন্ত যেমন প্রকৃতিতে অপার সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ এনে দেয়। তেমনি রমজান মাস পরওয়ারদেগারের পক্ষ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *