শুধু তার নামাজই খুশুখুজুওয়ালা

পাঠক! আপনি যেই হোন, শিরোনামের ‘তার’- কে আমার মনে করে ভেবে নেবেন যে, আমি যদি এরকম নামাজ পড়তে পারি, তবে আমার নামাজও হবে খুশুখুজুওয়ালা। তাই লেখাটি কারো জন্য লেখার আগে আমি আমার জন্য লিখেছি। তারপর হয়তো আপনার জন্য। পত্রিকায় প্রকাশিত হলো আমার প্রতি তাকিদ এবং দৃঢ় তৃপ্তি ও আত্মবিশ^াস লাভের জন্য। অতএব মাওলার দরবারে ফরিয়াদ, তিনি যেন লেখকসহ পাঠককে ফায়েদা নসীব করেন। আমলহীনতার কারণে পাকড়াও থেকে হেফাজত করেন। বলুন, আমিন।
নামাজ মুমিনের মিরাজ স্বরুপ। আল্লাহর সাথে মুমিনের দীদারের মাধ্যম। আল্লাহর মুকাররব বা প্রিয় হওয়ার অসিলা। শারিরীক ও আত্মিক প্রশান্তি অর্জনের এক মহাযন্ত্র। ইতিহাস ঘাটলে এটাই প্রকাশ পায় যে, যুগে যুগে নবী-রসুল, বড় বড় আওলিয়া বা পরহেয-মুত্তাকীদের এক পরমপ্রিয় ও ধৈর্যধরা আমল ছিলো। সাধারণ মানুষগুলো সেই রকম আমল করতে দেখলে ঈর্ষাম্বিত হতো, যদি এমন করতে পারতাম! সেক্ষেত্রে তাদেরকে অবশ্যই অলীদের সোহবতে আসতে হতো। অত:পর তারাও রিয়াজত সাধনা করতে করতে একসময় নামাজপ্রিয় হয়ে উঠতো।
কিন্তু সেই থেকে এইÑ আজ আমাদের দ্বারা সেই নামাজের সুরত ও ধরণ কতখানি পাল্টে গেছে! আমাদের মেজাজ ও স্বভাব এতোটাই দুনিয়ামোহের চুম্বকে জড়িয়ে গেছে, তেলাওয়াত-রুকু-সেজদা-দরুদ-দুআ কত দ্রুত পড়তে হয়! আলিফকে আইন বানাই, ছোট হা-কে বড় হা’ বানাই। দ কে জ বানাই। কাফ কে ক্বফ বানাই। কোন কোন শব্দের মাঝের অক্ষর বাদ দিয়ে পড়ে চলে যাই। সেজদায় মাথা রাখলাম, তো উঠিয়ে ফেললাম। রুকুতে মাথা নোয়ালাম, তো সোজা হয়ে গেলাম। কখন তাশাহহুদ পড়লাম, কখনই বা দরুদ-দুআ পড়লাম- নিজেও ঠাওরাতে পারবো না। আমি নামাজে দাড়িয়েছি, আর আমাকে কে যেন বাইরে ডাকছে! রুকুতে গিয়েছি, আর আমাকে কে যেন টানছে! সেজদায় গিয়েছি, আর আমাকে কে যেন তাড়াতাড়ি করার জন্য অস্থির করে তুলছে! হ্যা, ওটাই শয়তান। ওটাই ইবলিশ। ওটাই কুপ্রবৃত্তি। ওটাই খামখেয়ালী। ওটাই দুনিয়ার মোহ। কিন্তু কথা হলো, এটাকে কোন ধরণের নামাজ বলা যায়? বলতে কি পারবো, ইবাদাতের হকও আদায় হয়ে গেছে? আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। আমাদের উপর রহম করুন। নামাজের প্রতি আমাদের দিলে ভালোবাসা, মহব্বত ঢেলে দিন।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আল্ইাহি ওয়া সাল্লাম নামাজের জন্য পরম ব্যকুল ছিলেন। উদগ্রীব ছিলেন। তিনি বলতেন, নামাজ হলো আমার চোখের প্রশান্তি। আবার কখনো বেলালকে ডেকে বলতেন, বেলাল! নামাজের মাধ্যমে আমাকে তৃপ্তি দাও। মানে আজান দাও। নামাজে দাঁড়াব। আমার কবিতার ভাষায়,
“হে বেলাল! সময় হয়েছে। দাওরে আজান নামাজের,
বোকা সে তো। সালাত বিনা সুখ পেতে চায় জীবনের।
সালাত তরে ব্যাকুল থাকা- এই হালাতটা রাসুলের,
সালাত বিনা সুখ চাওয়া- এই হালাতটা শয়তানের।”
তো যাই হোক, প্রথমত আমাদের অনুভব করতে হবে খুশুখুজুর কি বিধান বা হুকুম। পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াতের আলোকে খুশুখুজু আবশ্যক হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন, সূরা বাকারার ৪৫নং আয়াতে আছে, “ধৈর্যের সাথে সাহায্য প্রার্থনা করো নামাজের মাধ্যমে, অবশ্য কেবল বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।” আবার সূরা মুমিনুনে আছে, “মুমিনরা সফলকাম, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র… তারা শীতল ছায়াময় উদ্যান (জান্নাতুল ফিরদাউসের) উত্তোরাধিকার লাভ করবে। তাতে তারা চিরকাল থাকবে।” Ñএ সমস্ত আয়াত আমাদের সামনে আসলে, নামাজের মধ্যে খুশুখুজু যে আবশ্যক- তা বুঝার আর বাকী থাকে না। যদিও অন্য ব্যাখ্যা রয়েছে- কিভাবে ওয়াজিব বা আবশ্যক মনে করা যায় এটাকে।
নামাজের খুশুখুজু আনয়নের জন্য নিজের মানসিকতা ঠিক করতে হয়। নিজের মনকে বলতে হয়, আল্লাহ! আমি যেন ইতমিনান বা পরম প্রশান্তির সাথে যেন নামাজ পড়তে পারি। মানে নিজেকে নিজেই ভাবতে হবে, আমাকে সুন্দর মনে নামাজ পড়া দরকার। হ্যাঁ, অজু ও অজু পরবর্তী তাহিয়্যাতুল অজুর নামাজ পড়া, (ফরজ নামাজে) কাতার সোজা করা ও পূর্বে কিছু তাসবিহাত পাঠ করা সহ নানান পদ্ধতি অনুসরণ করা হাদীস কর্তৃক স্বীকৃত। এগুলো পালন করলে অবশ্যই সহজেই একাগ্রতা ও ইতমিনান আনয়নে সহায়ক হবে। যাইহোক-
১. মানসিকতা বা নিজের খেয়াল থাকাটা বড় একটা ব্যাপার। এটা যদি ঠিক থাকে, পরবর্তী কাজ হলো, আমার নামাজ শুরু করা। খুশুখুজু আমি পাচ্ছি কিনা, পরীক্ষাটা এবারই হবে। আমি নামাজ শুরু করেছি। আমার নামাজে প্রত্যেকটি আরকানÑ তেলাওয়াত, রুকু, সেজদা, চোখ নামানো, তাশাহহুদ, দরুদ, দুআগুলো ঠিকমতো ধীরস্থিরভাবে আদায় করছি কিনা! আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেকটি রুকনে নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আপন স্থানে স্থাপনপূর্বক অন্য রুকনে গেলেই তবে প্রশান্তি লাভ করতেন। হযরত কাতাদা রা. একটি হাদীস বলেছেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঐ লোকটা সবচে খারাপ, যে আপন নামাজ চুরি করে। কাতাদা বললেন, রাসুলুল্লাহ! নামাজ কিভাবে চুরি করা যায়? বললেন, যে ব্যক্তি রুকু ও সেজদা পরিপূর্ণ করে না, (সে নামাজ চোর)।
আল্লাহর রাসুল এ ধরণের ব্যক্তিকে এতটাই ঘৃণা করেছেন যে, চোর বলে আখ্যা দিলেন। প্রিয় পাঠক! আমরা কি চোর হতে চাই? রাসুলুল্লাহর দরবার থেকে কি চোর আখ্যা পেতে চাই? না, না, তা কখনোই চাই না। আমরা নবীজীর আশিক হতে চাই। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের প্রতি দয়া করুন। আমিন।
২. এরপর আমাদের আরেকটা কর্তব্য যে, আমরা নামাজের মধ্যে মৃত্যুকে স্মরণ করবো। এটা খুব কঠিন একটা আমল। সাধারণ মানুষদের পক্ষে তখনই সম্ভব, যখন তারা নেককার আলিমের সোহবতে নিজেকে সে গুণে গুণান্বিত করবে। অতীত যামানা বলেন আর হাল যামানা বলেন- সাক্ষী, বড় বড় আলিম আল্লাহওয়ালাগণ এ গুণে বিশেষিত ছিলেন। কানজুল উম্মাল, জমউ’ল জাওয়ামে’, জামেউ’ল আহাদিস ইত্যাদি গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে- আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা নামাজে মৃত্যুকে স্মরণ করো। কারণ যদি মানুষ নামাজে মৃত্যুকে স্মরণ করে, তবে তার নামাজটা বড় সুন্দর, উত্তম ও উপযুক্ত হয়ে ওঠে। তখন তার নামাজ দেখে মনে হবে যে, সে অন্য কারো জন্য নামাজ পড়ছে না (শুধু প্রভুর জন্যই পড়ছে)।” আবার হযরত আবু আইউব আনসারী রা. বর্ণিত হাদীসে আছে- নবীজী এক ব্যক্তিকে নসীহত করেছিলেন, তুমি যখন নামাজ পড়ো, বিদায়ী নামাজ মনে করে পড়বে। (মু’জামুল কাবীর লিত তবারানী)
৩. আরো একটা বিষয় আছে যে, নামাজের মধ্যে কুরআন কারীমের আয়াতসমূহ নিয়ে গভীর ভাবনা ভাবা। চিন্তা করা। ফিকির করা। বরং তো কুরআন কারীম নাজিল হয়েছে এই জন্যই। আল্লাহ পাক বলেন,
“এটি একটি বরকতময় কিতাব যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি। বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।” (সূরা ছোয়াদ-২৯)
আর আয়াতে কারীমা নিয়ে ফিকির করার শক্তি যদি আমার অর্জন করতে হয়, তবে প্রাথমিক ভাবে আমি যা তেলাওয়াত করবো, তার অর্থ জানা থাকতে হবে। তাহলেই ফিকির ধাপ অতিক্রম করা সহজ হয়ে যাবে। এতটুকু যখন আমার অর্জিত হবে, ইনশাআল্লাহ কুরআন শরীফের পবিত্র ছোঁয়ায় চোখ থেকে ঝরবে পানি। হৃদয় হয়ে যাবে বিগলিত। প্রকম্পিত হবে দেহ।
কুরআন প্রভাবে নামাজী প্রভাবিত হবেই যদি তার ফিকির করার শক্তি থাকে। আল্লাহ তাই বলে দিয়েছেন সূরা ফুরকানের ৭৩নং আয়াতে- “এবং যাদের কাছে তাদের রবের আয়াতসমূহ তেলাওয়াত স্মরণ বা আলোচনা করা হলে তাতে তারা অন্ধ বা বধির সদৃশ আচরণ করে না।”
বিখ্যাত মুফাসসির হযরত ইবনে জারীর র. বলেছেন, আমি অবাক হয়ে যাই মানুষ কুরআন তেলাওয়াত করে, অথচ আয়াতের অর্থ জানে না। তাহলে কিভাবে সে কুরআনের স্বাদ আস্বাদন করবে? (তাফসীরে তবারী: ১/১০)
রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন আয়াতের ফিকির করতেন, আয়াতটা বারবার পড়তেন। পড়ে গভীর অনুভব করার চেষ্টা করতেন। তখন তার চোখ বেয়ে এমন অঝোর ধারায় পানি গড়াতো, দাড়ি বুক ভিজে যেতো। যেমন রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বারবার তেলাওয়াতকৃত তেমনি একটি আয়াত-
যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবু তারা আপনার বান্দা। কিন্তু যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন,(তবু তারা আপনার বান্দা) তথাপি আপনি (হবেন) পরাক্রান্ত মহাবিজ্ঞ। (সূরা মায়েদা: ১১৮)
৪. কুরআন কারীমের আয়াতগুলো আয়াত আয়াত ভেদে পড়া। অর্থাৎ, ৪/৫ আয়াত একসাথে একশ^াসে না পড়া; থেমে থেমে পড়া। কেননা এভাবে পড়লে কুরআনের আয়াত হৃদয়ঙ্গম করা ও ফিকিরের সাথে অনুধাবন করা সহজ হয়। আর এভাবে তেলাওয়াত করাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত। এতে ছাওয়াব বেশী। কারণ, এভাবে তেলাওয়াত করতে গেলে সময় লাগে বেশী এবং কষ্টও হয় বেশী। বারবার দমও নিতে হয়। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে থেমে থেমে বা আয়াত আয়াত করে তেলাওয়াত করতেন, সে ব্যাপারে উম্মে সালমা রা. কর্তৃক একটি হাদীস বিদ্যমান। সুতরাং সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়, নামাজের ভিতর এভাবে থেমে থেমে আয়াত পড়লে নামাজের খুশুখুজু আনয়ন সম্ভব। কারণ, আমি একটি করে আয়াত পড়ে থামছি, অর্থ জানা থাকলে সেদিকে খেয়াল করারও সুযোগ পাচ্ছি। ফলে একটি ভাব ও চিন্তা আমার মাঝে রেখাপাত করছে। তখন ব্যক্তিমাত্রই অনুভব করেন যে, আমার ভিতরে একধরণের কম্পন হচ্ছে। আর কম্পন হওয়াটা কুরআন স্বীকৃত। অতএব, আমাদের নিজেদেরকে এ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা দরকার। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সহায় হোন। আমিন।
৫. খুশুখুজুর অন্যতম আরেকটি কারণ হলো, কুরআন কারীমের আয়াতগুলো সুন্দর সুরে মধ্যম আওয়াজে পড়া। অর্থাৎ, ব্যক্তির কণ্ঠ অনুযায়ী সুন্দর ও স্পষ্ট শব্দে ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করবে। মহান আল্লাহ পাক প্রতিটি সৃষ্টিজীবকে ব্যক্তিগত কণ্ঠ দিয়েই পাঠিয়েছেন। অতএব, সবার কণ্ঠ অবশ্যই সুন্দর। সে তার মতো সুন্দর করে পড়বে, তবে স্পষ্ট অক্ষরে ও স্পষ্ট আওয়াজে যেন পড়া হয়। কারণ, এভাবে তেলাওয়াত করলে মনটা আল্লাহর দরবারে কোমলভাবে নিবেদিত হয়। যেমন সে ফিকির করতে পারে, তেমনি সে কাঁদতে পারে। কারণ আপনার সুন্দর ও মধুর সুরে তেলাওয়াত কুরআন পঠনের স্বাদ আস্বাদন করতে খুবই সহায়ক বরং ফলদায়ক। আর নামাজের খুশুখুজু তো তখনই আশা করা যায়। আল্লাহর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কে আরো সুন্দর করে বলে দিয়েছেন, তোমরা তোমাদের তেলাওয়াতকে সুন্দর সুরের মাধ্যমে সুন্দর করো। কেননা সুন্দর সুর কুরআনের সুন্দরতা ও সৌর্ন্দযকে বাড়িয়ে দেয়। (মুস্তাদরাকে হাকেম: ১/৫৭৫)
সুন্দর তেলাওয়াতের দ্বারা এটা কখনোই এটাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়নি যে, খুব টান টান করে পড়তে হবে। উচ্চসুরে বা উচ্চ বাচনভঙ্গি দিয়ে তেলাওয়াত করতে হবে। বরং আল্লাহর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় ঐ মানুষের তেলাওয়াতটাই সবচে’ সুন্দর, যা তেলাওয়াত শুনলে মানুষের মধ্যে একটা কম্পন সৃষ্টি হয় বা আল্লাহর ভয় জাগরিত হয়। (ইবনে মাজাহ: ১/১৩৩৯)
৬. শাহাদত আঙ্গুলী উঠানো- আল্লাহর স্মরণের অন্যতম একটি বিষয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে আজমাইন এ আমল অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করতেন। অথচ আমাদের মাঝে এই বিষয়টি বড়ই অবহেলিত আকারে পড়ে আছে। মানুষ জানে না নামাজের মধ্যে শাহাদতী আঙ্গুল উঠানোর কি ফায়েদা? কি ফজিলত? আপনি তাশাহহুদের পাঠান্তে- “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” পড়লেন, তখন যদি আপনি আপনার আঙ্গুলটি উঠান, প্রমাণিত হবে নামাজের মধ্যে আল্লাহর ওয়াহদানিয়াতের প্রতি আপনার খেয়াল আছে। আল্লাহর কথা স্মরণ আছে। নামাজের খুশুখুজু আছে বলে মোটামুটি প্রতীয়মান হয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
ডনশ্চয়ই এটা অর্থাৎ শাহাদতী আঙ্গুল উঠানো শয়তানের কাছে উত্তপ্ত লোহার চেয়েও কঠিন। (ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল: ২/১১৯)
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এ সুক্ষ্ম বিষয়ের ভুল হওয়া থেকে হেফাজত করুন। এর উপর দায়েমীভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
৭. আহলে সালাফ বা পূর্ববর্তী বুজুর্গদের জীবন নিয়ে বিশেষত তাদের নামাজের হালাত ও কাইফিয়াত বা পদ্ধতি জানার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। অলী আওলিয়া কেরামের নামাজ কেমন ছিলো, সে বিষয়ে গভীর ধ্যান ও চেতনা নিয়ে অধ্যয়ন করা। ফিকির করা। কারণ, তাদের নামাজের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য দিশা স্বরুপ। তারা নামাজ পড়তেন খুটির মতো দাড়িয়ে দাড়িয়ে, তাদের দেখে মনে হতো পড়ে থাকা এক টুকরা কাপড়ের মতোন। সিজদায় যেতেন নিক্ষিপ্ত ক্ষেপনাস্ত্রের মতো কিন্তু গেলে আর উঠতে চাইতেন না। নামাজে যখন দন্ডায়মান হতেন, চেহারা বিবর্ণ বা হলুদ বর্ণের হয়ে যেতো আল্লাহর ভয়ে, তারা ভাবতেন কোন সাহসে কার সামনে কি নিয়ে দাড়াচ্ছি! কখনো ডানে-বামে কি আছে বুঝতে পারতেন না। যাইহোক, এভাবে অনেক বর্ণনা দেয়া যাবে। এতটুকু তুলে ধরা হলো আপনার মনে অনুভবের অংকুরের জন্য।
তো আমরা যদি তাদের হালাত নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে তাদের তাওয়াজ্জুহে ও পরশে আমরাও সহজে প্রভাবিত হবো। আমাদের নামাজটাও খুশুখুজুযুক্ত হবে। ইখলাছযুক্ত হবে।
৮. নামাজের মধ্যে যে সব স্থানে দুআ করার সুযোগ রয়েছে, সেটা জানার পরও অবহেলা করা নামাজের খুশুখুজু কমতির নুন্যতম একটি কারণ। যেসব জায়গায় দুআ করার সুযোগ আছে, যেমন- সিজাদ, দুই সিজদার মাঝখান, বৈঠকে ইত্যাদি। এ সমস্ত স্থানে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ করতেন অত্যন্ত গুরুত্ব ও ভক্তির সাথে। কারণ, সিজদা হলো আল্লাহর নিকটতম হওয়ার সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয়তম মুহুর্ত। কিভাবে দুআ করতে হবে বা কি বলে দুআ করতে হবে- হাদীস পাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। আমাদের নামাজের ভক্তি ও খুশুখুজু বাড়ানোর স্বার্থে আমাদেরকেই তা শিখে নেয়ার দায়িত্ব। ফলে এতো সহজেপ্রাপ্তির জন্য এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। আল্লাহ সবকিছুর তাওফিকদাতা।
৯. পেশাব-পায়খানা আটকে রেখে নামাজ না পড়া। কারণ, তখন খুশুখুজুর ছিটেফোটাঁও থাকে না।
১০. ঘুম প্রাবল্যের সময় না ঘুমানো। খুশুখুজুর ব্যাপারে একই কথা। তখন তো মনোযোগই থাকে না।
১১. চোখ এদিক-ওদিক না করা। চোখ উপরে ওঠানো। অনেকে আবার এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা করে ওপরে উঠায়। এতে খুশুখুজু কমে যায়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়টাই কঠিন ভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের কি হলো, তোমরা বারবার চোখ উপরে উঠাও!
১২. প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে নামাজ না পড়া। বরং পড়াই নিষেধ। এতে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। খুশুখুজু তো পরের কথা।
১৩. নামাজ এমন স্থানে না পড়া, নিজের খুশুখুজু বাধাপ্রাপ্ত হয়, আবার অন্যের জন্য কষ্টের কারণ হয়। যেমন, সামনে ফাকা রেখে বা কোন সুতরা না রেখেই নামাজ পড়া। এতে নিজের গুনাহ তো হবেই, মনোযোগ আগেই শুন্য আকাশে উড়াল দিবে।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে, মুটামুটি একটা পর্যালোচনা বা খুশুখুজুর ব্যাপারে একটা চিরুনী অভিযান চালানো সম্ভব হলো। আল্লাহ যেন আমাদেরকে গাফলতের চরম ঘোর থেকে বের করে এনে খুশুখুজুওয়ালা নামাজী বানায়ে দেন। আমিন ছুম্মা আমিন।

Comments

comments

About

Check Also

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ইদানিংকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। জাতি সংঘ সহ সারাবিশ্বের সব দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *