ইসলামের দৃষ্টিতে ওসীলা

মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে যত নিয়ামত দান করেছেন কোন কিছুই ওসীলাবিহীন দান করেননি। আমরা নিজেদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাব আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কিছুই ওসীলাবিহীন অর্জিত হয়নি। জন্ম, লালন-পালন ও সুস্থতা সব কিছুই আল্লাহপাক করে থাকেন কিন্তু এসব কিছু কারো না কারো ওসীলায় করে থাকেন। যেমন জন্ম ও লালন-পালন মাতা-পিতার ওসীলায়, সুস্থতা হেকিমের ওসীলায় এবং জ্ঞান গরিমা দান করেন উস্তাদের ওসীলায়। এক কথায় ওসীলা ছাড়া বেঁচে থাকা, দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি লাভের কোন উপায় নেই। তাই ওসীলা তালাশ করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন-‘হে ইমানদারগণ! (তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আল্লাহর প্রতি ওসীলা তালাশ কর এবং তাঁর পথে জিহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (সূরা মায়িদা : আয়া-৩৫)। যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় সেটাই হচ্ছে ওসীলা। উক্ত আয়াতে ‘ওসীলা’ শব্দটি আম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ নবী-রাসূল, আউলিয়ায়ে কেরাম, তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ও নিজের পূর্ববর্তী বা বর্তমান যেকোন সৎকর্মের ওসীলা নেয়া এই আয়াতের অন্তর্ভুক্তি। পাপমুক্তি ও বিপদমুক্তির জন্য ওসীলা নেয়ার এই চিরন্তন রীতিটি সৃষ্টির সূচনা থেকেই শুরু হয়েছে। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) যখন গন্ধম খাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন তখন তিনি তিনশত বছর কাঁদলেন। অতঃপর তিনি আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওসীলা নিয়ে দোয়া করলে আল্লাহপাক তাঁর দোয়া কবুল করলেন। হযরত আদম (আ.)-এর এই দোয়া কবুল করে আল্লাহপাক একটি রীতি জারি করে দিলেন যে, যতবড় পাপী হোক না কেন কেউ যদি নবী (সা.)-এর ওসীলায় দুয়া করে তার দোয়া অবশ্যই কবুল করবেন। দুনিয়া-আখেরাতে শান্তি ও মুক্তির জন্য সবচেয়ে বড় ওসীলা হচ্ছেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর ওসীলা ব্যতিত আমাদের মুক্তির কোন উপায় নেই।
রাসূলে পাক (সা.)-এর ওসীলা নেয়ার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন-‘যখনই তারা নিজেদের আত্মার উপর জুলুম করবে তখনই তারা আপনার দরবারে আসবে ও আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং রাসূল ও তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালুরূপে পাবে’ (সূরা নিসা : আয়াত-৬৪)। উক্ত আয়াত দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত-যারা মদীনায় যাবে তারা তো অত্যন্ত ভাগ্যবান-তারা মদীনায় গিয়ে রাসূল (সা.)-এর ওসীলা নিয়ে দোয়া করবে। আর যারা মদীনায় যেতে পারবে না তারা দুনিয়ার যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন সময় রাসূল (সা.)-এর ওসীলা নিয়ে যে কোন বিপদ বা পাপমুক্তির জন্য দোয়া করে তাহলে আল্লাহ তাদের দোয়া অবশ্যই কবুল করবেন-এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল-পাপ করবে আল্লাহর কাছে কিন্তু পাপমুক্তির জন্য রাসূল (সা.)-এর ওসীলা নিতে হবে কেন? বা রাসূল (সা.)-এর দরবারে যেতে হবে কেন? এর জবাবে আমি বলবো-‘রাসূল (সা.)-এর পবিত্র দরবার মূলত: আল্লাহর দরবার। রাসূল (সা.) হচ্ছেন মহান আল্লাহর কুদরতী দরবারের শ্রেষ্ঠ উকিল। দুনিয়াতে যেমন উকিল ব্যতিত হাকিমের সাথে কোন কথাবার্তা চলে না বা কোন কিছু লাভ করা যায় না তেমনি রাসূল (সা.)-এর ওসীলা ব্যতিত আল্লাহর সাথে কোন কথাই চলতে পারে না বা কোনকিছুই লাভ করা যাবে না।
আল্লাহপাক তাঁর কোন বান্দাকে কোন কিছু দান করতে চাইলে রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করবেন। রাসূল (সা.) হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলেই আল্লাহপাক তা তাকে দান করবেন।’ রাসূল (সা.)-এর ওসীলা ব্যতিত কোন ইবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-‘হে নবী! তাদের সম্পদ থেকে সদকা বা যাকাত গ্রহণ করুন ইহা দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন।
আপনি তাদের জন্য দোয়া করবেন, আপনার দোয়া তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর’ (সূরা তওবা : আয়াত-১০৩)। উক্ত আয়াতে যাকাত গ্রহণ করার পর আল্লাহপাক নবী (সা.)-কে তাদের জন্য দোয়া করার নির্দেশ দিলেন কেন? এর জবাবে আমি বলবো-‘ইবাদত করলেও তা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য রাসূল (সা.)-এর দোয়া, সম্মতি বা ওসীলা একান্ত প্রয়োজন। তাই তো মহান আল্লাহপাক উক্ত নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা যতই ইবাদত করিনা কেন তা কবুল হওয়ার জন্য অবশ্যই রাসূল (সা.)-এর ওসীলা নিতে হবে।’ রাসূল (সা.)-এর ওসীলা শুধু তার জীবদ্দশার সাথে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর ওসীলা যেমন তাঁর জন্মের পূর্বে ও পরে লওয়া জায়েজ ছিল তেমনি তাঁর ওসীলা লওয়া তাঁর ওফাতের পরে এমনকি কিয়ামতের দিনও তাঁর ওসীলা লওয়া জায়েজ। কিয়ামতের ময়দানে নবীজির ওসীলাতেই আমরা নাজাত পাব। নবী (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত যেকোন ব্যক্তি বা বস্তুর বা তাঁর স্মৃতি বিজড়িত যেকোন স্থানের ওসীলা নিয়ে দোয়া করলেও আল্লাহপাক সত্ত্বর দোয়া কবুল করেন।
নেককার লোকের ব্যবহৃত বস্তুর ওসীলায় আল্লাহ দুঃখ দূর করেন, রোগ আরোগ্য করেন-এটা পবিত্র কোরআন দ্বারাই প্রমাণিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-‘ইউসুফ (আ.) তার ভাইদেরকে বললেন যে, আমার জামা নিয়ে যাও উহা আমার সম্মানিত পিতার চেহারার উপর রাখ, তাঁর চক্ষুদ্বয় দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন হয়ে যাবে’ (সূরা ইউসুফ : আয়াত-৯৩)। উক্ত আয়াত দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত-নেককার লোকের ব্যবহৃত বস্তুর ওসীলায় আল্লাহ দুঃখ দূর করেন। রোগমুক্তি করেন ও মহাবিপদ থেকে মুক্ত করেন। নেককার লোক যেখানে অবস্থান করেন বা যেখানে নেককার লোকের মাজার আছে সেই ব্যক্তি বা স্থানের ওসীলা নিয়ে দোয়া করলেও আল্লাহপাক সত্ত্বর দোয়া কবুল করেন। এটাও পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। হযরত মরিয়ম ছিলেন একজন ওলী বা একজন নেককার বান্দী। আর হযরত জাকারিয়া (আ.) ছিলেন একজন নবী। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। হযরত মরিয়ম যে স্থানে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন, সেখানেই হযরত জাকারিয়া (আ.) একজন নেক সন্তানের জন্য দোয়া করলেন। সেই পবিত্র স্থানে দোয়া করায় আল্লাহপাক তাঁকে একজন নেক সন্তান দান করলেন-যার নাম রাখা হল ইয়াহইয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-(মরিয়ম যেখানে ইবাদত করতেন) ‘সেখানেই হযরত জাকারিয়া সন্তানের জন্য দোয়া করলেন’ (সূরা আল-ইমরান : আয়াত-৩৮)। আউলিয়ায়ে কেরামের মাজারে সফর করা বা আউলিয়ায়ে কেরাম যেখানে অবস্থান করেন বা ইবাদত করেন সেসব স্থানে গিয়ে দোয়া করলে যে যেকোন নেক উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়-তা উক্ত আয়াত দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত। উক্ত ঘটনা কোরআনে উল্লেখ করে আল্লাহপাক আমাদেরকে এই শিক্ষা দান করলেন-আউলিয়ায়ে কেরামের মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা অত্যন্ত পূণ্যের কাজ এবং আউলিয়ায়ে কেরামের মাজারে গিয়ে যে যা চাইবে আল্লাহর ওলীর ওসীলায় আল্লাহপাক তা তাকে অবশ্যই দান করবেন। মসনদে আহমদে বর্ণিত চল্লিশ আবদাল সম্পর্কিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘এ চল্লিশ আবদালের ওসীলায় বৃষ্টি বর্ষিত হবে, শত্র“র উপর বিজয় হবে, সিরিয়াবাসীদের থেকে আজাব দূর হবে’ (মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-৫৮২-৫৮৩)। যেকোন নেক কাজের ওসীলায়ও আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত দীর্ঘ হাদীস পাঠে জানা যায়-মাতা-পিতার খেদমত, শ্রমিকের সঠিকভাবে পারিশ্রমিক প্রদান এবং ব্যভিচার থেকে বিরত থাকার মত নেক কাজের ওসীলা নিয়ে দোয়া করলে আল্লাহ তা সত্ত্বর কবুল করেন (মিশকাত : পৃষ্ঠা-৪২০-৪২১)।

Comments

comments

About

Check Also

চিনে মুসলমানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসা

সিরাজুল ইসলাম সা’দ নজিরবিহীন ভাবে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী উইঘুর মুসলমানদের ওপর কমিনিষ্ট পার্টির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *