ভাগ্যরজনী লাইলাতুল বারাআত করণীয় ও বর্জনীয়

শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ই শাবানের রাতকে বলা হয় ভাগ্যরজনী, লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত। কোরআন শরীফের ভাষায় ‘লাইলাতুম-মুবারাকা’ এবং হাদিস শরীফের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন-শা’বান’ আমাদের ভারত মহাদেশে ‘শবে বারাআত’ নামে প্রচলিত। শব ফার্সি শব্দ। ‘শব’ অর্থ রাত ‘বারাআতুন’ অর্থ নাজাত বা নিষ্কৃতি। তাই এই রাতের নাম ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা ‘শবে বারাআত’। সংক্ষেপে ‘শবে-বারাআত। বর্তমান সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি আমাদের মুসলমানদের মধ্যে একদল লোক এই রাতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করছে, তেমনি অপর আরেক দল এই রাতকে কেন্দ্র করে নানা রকম নাজায়েজ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে! দুটিই ইসলামী শরিয়তে গর্হিত কাজ। তাই শাবান মাস এবং শবে বারাআত সম্পর্কে আমাদের সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। শাবান মাস অত্যাধিক গুরুত্বপুর্ণ এবং ফদ্বিলতের মাস। স্বয়ং রাসুল সা. এই মাসকে তার মাস নামে অভিহিত করেছেন। রাসুল সা. বলেন: রামাদ্বান আল্লাহর মাস এবং শাবান আমার মাস। শা’বান পবিত্রতা দানকারী এবং রামাদ্বান গোনাহ মাফকারী । (কানযুল উম্মাহ-২৩৬৮৫)। শাবান মাস আসলেই রাসুল সা. অধিক পরিমাণ নফল রোজা রাখতেন: হযরত উসামা বিন যায়েদ রা. বলেন, আমি একদা রাসুল সা.কে জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ সা. আমি আপনাকে শাবান মাসের চেয়ে অধিক রোজা অন্য কোন মাসে রাখতে দেখিনি । রাসুল সা. বললেন এটা ঐ মাস যেটা রজব এবং রামাদ্বানের মধ্যবর্তি, এ মাসে মানুষ গাফেল থাকে অথচ উহা এমন এক মর্যাদাবান মাস যে মাসে বান্দাহর আমল সমূহ তার প্রতিপালকের সম্মুখে পেশ করা হয়, সুতরাং আমি পছন্দ করি যেন আমার আমল পেশ করা হয় এমতাবস্থায় যে, আমি রোজাদার। (মসনদে আহমদ, তাবরানী, বায়হাক্বী-শু’বুল ঈমান-৩৮২০)। হযরত আনাস বিন মালিক রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সা. এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় (নফল) রোজা ছিল শাবান মাসের রোজা । (মসনদে আহমদ, তাবরানী) বুখারি শরীফের বাব ‘সিয়ামুন্নবী সা. ফি গাইরে রামাদ্বান’ অধ্যায়ে দেখা যায় যে নবী সা. শাবান মাসে এমন ভাবে রোজা রাখতেন মনে হতো যেন আর কখনো রোজা বাদ দিবেননা। নবী করিম সা. এর প্রিয় সাহাবিরাও শাবান মাসকে গুরুত্ব দিতেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আমলে লিপ্ত হতেন। হযরত আনাস বিন মালিক রা. বর্ণনা করেন: নবী সা. এর সাহাবীরা যখন শাবান মাসের চাঁদ দেখতেন তখন কোরআন শরীফ তিলাওয়াতে মশগুল হতেন। মুসলমানগণ তাদের যাকাত আদায় করতেন, যাতে দূর্বল ও অভাবগ্রস্ত লোকজন রামাদ্বানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। শাবান মাসের চাঁদ দেখার পর গোসল করতেন এবং দুনিয়াবী কাজ থেকে বিরত থাকতেন। হজুর সা. অন্যত্র ইরশাদ ফরমান: শাবান মাসে বহুল পরিমাণ পূণ্য বন্টন করা হয় বলে এই মাসের নাম শাবান রাখা হয়েছে। (গুনিয়াতুত্বালিবীন-ফাদাঈলে শবে বরাত)
ভাগ্যরজণী (লাইলাতুন নিসফি মিন-শা’বান) বা শবে বরাত: শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ই শাবানের রাত হলো ভাগ্যরজনী, লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, এই রাত সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন: আমি একে (কোরআনে কারিম) নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সুরা দুখান:৩-৪)।

এ আয়াতে কারিমার তাফসীরে মুফাসসিরীনে কিরামগণ দু’টি মত ব্যক্ত করেছেন । হযরত ইকরামা সহ একদল মুফাসসিরীন বলেছেন শবে বারাআত আবার অন্য দল বলেছেন শবে কদর। কোরআন শরীফে যেহেতু সুরা বাকারার ১৮৫ নাম্বার এবং সুরা কদ্বরের ১ নাম্বার আয়াতে কোরআনুল কারিম রামাদ্বান মাসে নাযিলের কথা এসেছে তাই মুফাসসিরীন এটার সামাধান করতে গিয়ে বলেন শবে বারাতের রাতে কোরআন লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে আনা হয় তারপর আল্লাহ জিব্রাইল আ. এর মাধ্যমে রামাদ্বান মাসের কদরের রাতে নবী সা. এর কাছে কোরআন নাযিল করেন। তাই দুটি রাতই গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আলী রা. হতে সুনানে ইবনে মাজা ও বায়হাকী শুআবুল ঈমানে বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন যখন শা’বান মাসের অর্ধেকের রাত অর্থাৎ ১৫ই শাবানের রাত হবে তখন তোমরা রাতে জাগ্রত থাকবে এবং দিনে রোজা রাখবে। কেননা আল্লাহ পাক সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয়ে আহবান করেন কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী থাকলে ক্ষমা প্রার্থনা করুক আমি থাকে ক্ষমা করে দেব । কোন রিযেক প্রার্থনাকারী থাকলে রিযেক প্রার্থনা করুক আমি থাকে রিযেক দান করব । কোন বিপদগ্রস্ত বিপদ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করলে আমি তাকে বিপদ থেকে রেহাই দিব। এরূপ আরও অনেক কিছু এমনকি ফজর পর্যন্ত এ আহবান চলতে থাকে। (রুহুল মা’আনী ২৬ খন্ড ১১১ পৃষ্টা)। ইকরামা রা. বলেন এ রাতেই সারা বৎসরের কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করা হয়। জীবিত ও মৃতদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। উসমান বিন মুহাম্মাদ রা. বলেন রাসুল সা. ইরশাদ করেন এ রাতে এক শাবান থেকে অপর শাবান পর্যন্ত প্রত্যেক কাজের সময় নির্ধারণ করা হয়। এমনকি কোন ব্যক্তি বিবাহ করবে এবং তার সন্তান কি জন্মাবে তাও নির্ধারণ করা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতে সকল ফয়সালা করে থাকেন এবং শবে কদরের রাতে তা দ্বায়িত্বশীল ফেরেস্তাদের কাছে সোপর্দ করেন। (তাফসীরে বাগাবী ৪/১৪৮-৪৯)। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন-আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে (শবে বারাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন। এবং দু’শ্রেণির ব্যক্তি ব্যতিত সবাইকে মাফ করে দেন। এ দু’শ্রেণি হলো হিংসুক ও অন্যায়ভাবে হত্যাকারী। (রুহুল মা’আনী ২৬ খণ্ড ১১১ পৃষ্টা)। ক্বাছীর বিন মুররা হাদ্বরামীর বর্ণনায় আছে মুশরিক এবং হিংসাকারী ব্যতিত সকল মু’মিনকে ক্ষমা করেন। (আলবাণী- আল-জামে সহিহ, ২য় খণ্ড. ৪২৬৮)। মুমিনদের মা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআ’লা মধ্য শা’বানে (১৫ তারিখের রাতে) দুনিয়ার কাছের আকাশে অবতীর্ণ হন। তারপর কালব গোত্রের বকরীর পালের লোমের চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে তিনি মাফ করে দেন। তবে মুশরিক, হিংসুক, আতœীয়তার সম্পর্ক বিনষ্টকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য এবং সর্বদা মদ্যপানকারী ব্যক্তিদের প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন (রহমতের) দৃষ্টি দিবেন না। (তিরমিযী শরীফ, বায়হাকীশরীফ-শু’আবুল ঈমান)। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা-ই প্রতীয়মান হয় যে, কবীরা গোনাহ ব্যতিত ছোট-খাট বা সগীরা গোনাহ সমূহ শবে-বারাআত সহ অন্যান্য মহিমান্বিত রাতের বরকতে রাব্বুল আলামিন মাফ করে দেন। মধ্য শা’বানে (১৫ তারিখের রাতে) রাসুল সা. জান্নাতুল বাক্বীতে কবর জিয়ারত করেন। একই রাত্রে দীর্ঘ নফল নামাজ আদায় করেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সা. নামাজের সেজদায় একটি দোয়া পাঠ করছেন। “হে আল্লাহ! আমি আপনার শাস্তি থেকে ক্ষমার আশ্রয় চাচ্ছি, আপনার অসন্তুষ্টি হতে সন্তুষ্টির আশ্রয় চাচ্ছি, আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনার সত্তা চির মহান, আমি আপনার যথার্থ প্রশংসা করতে সক্ষম নই। আপনি হচ্ছেন তেমন যেমন আপনি নিজে আপনার প্রশংসা করেছেন। (বায়হাকী শরীফ-শু’আবুল ঈমান ৩য় খন্ড পৃষ্টা নং ৩৮৩)। মধ্য শা’বানে (১৫ তারিখের রাতে) ১০০ রাকাত নফল নামাজ মোট ১০০০ বার সুরা ইখলাস দিয়ে (প্রতি রাকাতে ১০বার সুরা ইখলাস) পড়ার কথা গুনিয়াতুত তালিবীনের ১৬৭ নাম্বার পৃষ্টায় উল্লেখ আছে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে জানতে পারলাম শাবান মাসে এবং মধ্য শা’বানে (১৫ তারিখের রাতে) আমাদের অনেক করণীয় ও বর্জনীয় আমল আছে। নিম্নে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
করণীয় আমল : (১) এই রাতে আল্লাহর রাসুল সা. এর অনুসরণে অনেক দীর্ঘ নামাজ আদায় করা। বিশেষ করে তাহাজ্জুদ সহ অন্যান্য নফল নামাজ আদায় করা। (২) পরের দিন রোজা রাখা। (৩) এই রাতে পুরুষদের জন্য কবরস্থানে যাওয়া এবং মা বাবা সহ মৃত আতœীয় স্বজনদের জন্য দোয়া করা মুস্তাহাব। (৪) কোরআন তেলাওয়াত করা। (৫) বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা। (৬) যিকির-আযকার, দুরুদ শরীফ পাঠ ইত্যাদির মাধ্যমে রাত কাটানো। (৭) সদকাহ খয়রাত কিংবা অন্যকে খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে অথবা শরীয়ত সম্মত অন্য যে কোন পন্থায় মুর্দেগানদের ঈসালে সওয়াব করা। (৮) মীলাদ শরীফের মাহফিল করা। (৯) বেশি বেশি ইস্তেগফার করা। (১০) শবেবরাতে (১৪ শাবান দিবাগত রাতে) গোসল করাও মুস্তাহাব। (১১) আল্লাহর দরবারে কাতর হয়ে দোয়া করা এবং ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি অতিবাহিত করা।
বর্জনীয় আমল : (১) আতশবাজী (২) আলোকসজ্জা করা (৩) গোরস্থানে মেলা ও উৎসব করা (৪) অন্যের অসুবিধা হয় এমন ভাবে উচ্চ আওয়াজে কোন কিছু না করা । আল্লাহ আমাদেরকে শাবান মাস এবং শবে বারাআত অর্থাৎ মধ্য শা’বানের (১৫ তারিখের রাত) পবিত্র রাতের মাহাত্মকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করার জন্য দেহ ও মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করার ক্ষমতা দান করুন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবার হক আদায় করার ক্ষমতা দান করুন। কারো সাথে কোন অন্যায় করে থাকলে মাফ চাওয়ার তাওফিক দান করুন। অন্তরকে কলুষমুক্ত করে ভক্তি, আশা ও ইয়াকীন সহকারে মনকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর গোলামীতে সঁপে দিয়ে যাবতীয় কাজে এখলাসের দিকে ধাবিত হয়ে আল্লাহকে মন-প্রাণ থেকে গভীর ভাবে ডাকার তাওফিক দান করুন।

Comments

comments

About

Check Also

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ইদানিংকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। জাতি সংঘ সহ সারাবিশ্বের সব দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *