নিজেকে কুরবান করে দাও

নিজেকে কুরবান করে দাও- মোটে চারটি শব্দ। কিংবা এগারোটা অক্ষর। সিকি নিঃশ্বাসে বাক্যটা উচ্চারণ করতে আশা করি কোন বেগ পেতে হবে না। কিংবা ছোট ছোট দম করে পড়ার চিন্তাও মাথায় ঢুকবে না। কিন্তু যদি বলা হয়, বাক্যটার হাকীকত বা গভীর ব্যাখ্যার দিকে মনোযোগ দেয়ার কথা, তাহলে মনে হয়- অনেকগুলো বাক্য পড়তে হবে। দফায় দফায় দম নিতে হবে। চোখের পলক ফেলতে হবে শতবার।
তো কুরবান, কোরবান- দুটোই বলা যায়, লেখাও যায়। এর স্বাভাবিক অর্থ জানতে হলে এতটুকুতে যথেষ্ঠ যে,
১.আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ত্যাগ- কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
আজকে বনের পথ হারালেম ঘরের পথের ছলে,
তুমি শুধু মুখ তুলে চাও, বলুক যে যা বলে।।
২. উৎসর্গ- কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
এবার আমায় সঁপে দিলাম তোমার চরণ তলে,
তুমি শুধু মুখ তুলে চাও, বলুক যে যা বলে।।
৩. বিশেষ উদ্দেশ্যে জীবন বা আত্মদান। অর্থাৎ কুরবানীর পশুর মতো আল্লাহর জন্য নিজের শরীরের রক্ত প্রবাহিত করা।
এ সমস্ত অর্থের সমর্থনে কুরআনের আয়াত আছে। তাফসীর আছে। হাদীস আছে। ব্যাখ্যা আছে। সংক্ষেপ এ প্রবন্ধে কুরআন পাকের দুটি আয়াত তুলে ধরে ক্ষ্যান্ত হবো। প্রথমটি আছে সুরা আল কাওসারে। অর্থ- অতএব আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়–ন ও সালাত আদায় করুন। (সুরা কাওসার: ০৩)
দ্বিতীয় আয়াত সুরা আনআমে। অর্থ- নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য। (সুরা আনআম: ১৬২)
আমার খুব ভালো লাগা একটি আয়াত। ভক্তি গদগদ কন্ঠে বারবার তেলাওয়াত করি। যখনি যতবার এ আয়াতটা পড়ি, আমি যত বড় পাপী হই না কেন, আমার স্বত্তার ভিতর আবেগে একটা শিহরণ খেলে যায়। কান্নার ভাবাবেগ সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। আমি আমার আব্বাকেও কি এক মায়াময় কান্না কান্না কন্ঠে প্রায় জুমআর বয়ানে, পবিত্র দুই ঈদের বক্তব্যে এই আয়াত পড়তে শুনি। বিশ^াস হয় না? আমার তো মনে হয়, আপনারও এমন অনুভূত হয়।
এবার লক্ষ্য করুন, প্রথমে আমি কুরবানীর যে অর্থ তুলে ধরেছি- নিশ্চয়ই মনে আছে। সেটা ছিলো বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক অভিধান থেকে। তারপর উল্লেখ করলাম আয়াতের অর্থ। কুরবানীর অর্থ তাহলে মিলে গেলো। সেটা কি? যে- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ বা উৎসর্গ কিংবা জীবনদান।
এবার যদি আমি কুরবানী শব্দকে সংজ্ঞায়িত করতে চাই তবে বলবো, এমন বস্তু বা কাজের নাম যার মাধ্যমে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি বা নৈকট্য অর্জন করা যায়। হ্যাঁ, আল্লাহর সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে অন্য কাউকে ভাগ বসানো যাবে না। হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। অর্থাৎ যখন ত্যাগ বা উৎসর্গ করবো, তখন যেন কাউকে দেখানোর জন্য না হয়।
মজার একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো সহজে বুঝতে সহায়ক হবেন। ইনশাআল্লাহ বুঝবেন। হযরত আদম আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই পুত্র সন্তানের কুরবানীর ঘটনা। কুরআন ঘোষনা করছে-
তারা (হাবিল ও কাবিল) দুইজনই কুরবানী করেছিলো। তাদের একজনের কুরবানী কবুল হয়েছে। অপরজনের কুরবানী কবুল হয়নি। তখন সে (কাবিল) বললো, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করবো। (হাবিল) বললো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই গ্রহণ করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হাত প্রসারিত করো, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে আমার হাত প্রসারিত করবো না। কেননা আমি বিশ^জগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অত:পর তুমি দোযখীদের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। অত:পর তার (কাবিলের) অন্তর তার ভাইকে হত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করলো। অনন্তর সে তাকে হত্যা করলো। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে শামিল হয়ে গেলো। (সুরা মায়িদা: ২৭-৩০)
এ আয়াতে খুব সহজেই কুরবানীর শ্রেষ্ঠ মর্ম তুলে ধরা হয়েছে। যে, ঘোষণা হয়েছে- একজনের অন্তরে ইখলাস ছিলো, তাই কবুল করা হলো। অন্যজনের ইখলাস না থাকাই কবুল করা হয়নি। কারণ আল্লাহর নামে কুরবানী করার সময় ভিন্ন কিছু তার মনে নিহিত ছিলো। অথচ তারা দুইজনই কুরবানী করেছে!
মর্ম কথা হলো, ইখলাস থাকতে হবে। তাহলে বলা যায়, আপনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বা ছোট ছোট বস্তুর কুরবানীও আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। যদি বড় বড় বস্তু কুরবান করা হয়, আর তাতে যদি ইখলাস না থাকে, তাহলে এ কুরবানী কবুল হলো না। কারণ আয়াতে শর্ত দেওয়া হয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা। যেমনটি বাংলা অভিধানেও একই শর্ত তুলে ধরা হয়েছে।
যুগে যুগে কুরবান করার বা কুরবান হওয়ার নজীর বিদ্যমান। যারা নিজেকে কুরবান বা আত্মলীন করতে পেরেছেন, তারাই সফলকামী হয়েছেন। সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকেই কুরবান করা বা হওয়ার ইতিহাস বিদ্যমান। হযরত আদম-হাবিল থেকে শুরু করে সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম সকলেই নিজেকে আল্লাহর রাহে কুরবান করেছেন। বিশাল বিস্তৃত এর ইতিহাস।
রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে সাহাবা কেরামের কুরবান করার ইতিহাসটাই আমাদের সামনে প্রকাশ্যমান। দেদীপ্যমান। সমুজ্জ্বল হয়ে আমাদের সামনে নমুনা হিসেবে কাগজের পাতায় লিখিত আছে। আমরা সহজেই সেগুলো অধ্যয়ন করে কুরবান করার, কুরবান হওয়ার গভীর মর্ম ও প্রেরণা লাভ করতে পারি।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোহবতে এসে যারাই ঈমান এনেছেন, তারা সবাই সাহাবী। সাহাবীদের ঈমান আনার আগের ও পরের চিত্র দিন-রাত ফারাক। নবীজীর সোহবতের সামান্য পরশেই তাদের জীবন সোনালী জীবনে পরিণত হয়েছে। সোহবতের এতো দাম। এতো মূল্য। ঈমান আনার সাথে সাথেই কোন এক অদৃশ্যের ইশারায় তারা হয়ে গেলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। নিজেদের জানকে কুরবানী করে দিলেন আল্লাহর রাসুলের কদম পাকে। সাহাবীরা গর্ব করে বলতেন, আমরা আপনার ডানে-বামে-সামনে-পিছনে থাকবো। সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বললেও কণ্ঠাবোধ করবো না।
আল্লাহ তাআলা আরো ঘোষণা করেছেন -আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি খুশী, তারাও আল্লাহর প্রতি খুশী।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সাহাবীদেরকে মর্যাদাবান করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন। অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান। এগুলো কি কারণে? নিশ্চয়ই কুরবান করার ও কুরবান হওয়ার কারণে।
এক হাদীসে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন -আমার সাহাবীগণ নক্ষত্র তুল্য। তাদের মধ্যে তোমরা যাদেরই অনুসরণ করবে, হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে।
যে সাহাবীগুলো আল্লাহর নবীজীর জন্য নিবেদিত হয়ে নিজের জানকে কোরবানী করেছিলেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আত্মলীন করেছিলেন, তাদের নিয়ে পৃথিবীর মানুষগুলো সমালোচনা করবে- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা সহ্য করতে পারবেন না। তাই তো তিনি কঠিন ভাষায় উম্মতকে সাবধান বাণী শুনায়েছেন। তিনি বলেছেন,
তোমরা আমার সাহাবীকে গালি দিয়ো না। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ। যদি তোমাদের কেউ উহুদ পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তবে তা তাদের এক মুদ বা তার অর্ধেকেরও সমকক্ষ হতে পারবেনা।
অন্যত্র বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার সাহাবীকে গালি দিবে, তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সকল মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তার নফল বা ফরজ কিছুই কবুল করবেন না।
কুরবানের বিষয়টি যদি আমরা খুব গভীর ভাবে ভাবতে থাকি, একটি সুক্ষ্ম বিষয়ের ইঙ্গিত এখানে পাই। সেটা হলো, মহব্বত বা ভালোবাসা। কারো প্রতি যদি উৎসর্গিত হতে হয় বা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তবে ভালোবাসার মাধ্যমেই সম্ভব। অন্যথায় তার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করা অসম্ভব। পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নজরে পড়লো সুন্দর একটি গোলাপ ফুল। কিনলেন। ইচ্ছা করলেন, কাউকে দিবেন। উৎসর্গ বা হাদিয়া দিবেন, যাকে আমরা ইংরেজীতে বলি, গিফট। কিন্তু কাকে করবেন- আপনাকে কি তা ভেবে নির্বাচন করতে হবে? অবশ্যই না। কারণ, তখন আপনার চেহারায়, কল্পনায় ভেসে আসবে আপনার প্রিয়তমের সমুজ্জ্বল চেহারা। হয়তো তখন নিজের ক্ষুধা কিংবা আপন ব্যস্ততা অথবা বিভিন্ন দায়-দায়িত্ব বা কর্তব্যের প্রতি উদাস হয়ে সেই প্রিয়তমের প্রতি ত্যাগ স্বীকার করে গোলাপ ফুলটি দিতে যাবেন। উদ্দেশ্য- তার সন্তুষ্টি বা নৈকট্য অর্জন। অন্যভাবে বলা যায়, প্রিয়তমের মনের পছন্দ ধারণ বা খুশী করা। কারণ ভালোবাসার সংজ্ঞা হলো-
নাহ তু বে হাজার হি আচ্চা, নাহ ওয়াসালে আচ্চা,
ইয়ার জিস হাল মেঁ রাখখে ও-হী হাল আচ্চা।
: না বিচ্ছেদ- না মিলন/ বন্ধু যেভাবে রাখে সেভাবেই ভালো।
দেখুন, মানুষের ভালোবাসা হোক সেটা আল্লাহ কিংবা রাসুলের সাথে অথবা মানুষের সাথে- যখন তুঙ্গে থেকে তুঙ্গে ওঠে, তখন তার মনপ্রাণ বড় বেয়াড়া হয়ে যায়। সান্নিধ্য কামনা করে। নিজেকে তার কদমে পর্যন্ত বিলীন করতেও উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আশিকে রাসুল, রাসুলে নোমা হযরত সূফী ফাতেহ আলী ওয়ায়েসী র. প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেমে মাতোয়ারা ছিলেন। তাই বিষয়টি আমাদের গভীর ভাবে উপলব্ধির করার মতো। আপনাকে যদি কোন বস্তুর খুব রহস্য উদঘাটন করতে হয়, তবে একটু গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে। দেখবেন, মা’রেফাতের পর্দা একটু একটু করে উন্মোচন হচ্ছে। আপনি ভেদ তত্ব জানতে পারছেন। এটাই কিন্তু তাসাওউফের অন্যতম নীতি।
আসছে ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ। এদিনে মানুষ বিধান মোতাবেক বিভিন্ন পশু আল্লাহর রাহে কুরবানী করবে। এদিনের কথাও একই। ইখলাসের সাথে কুরবানী করতে হবে। মহব্বতের সাথে কুরবানী দিতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে সম্মান রক্ষা কিংবা লোক দেখানো কুরবানীর রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। মুখে বলে- আল্লাহর রাহে কুরবানী, অন্তরে তাদের রয়েছে অন্য কিছু। এ বিষয়টার প্রতি আমি একটু আগেই ইঙ্গিত দিয়ে এসেছি। তো এ রেওয়াজটা ভুলের মধ্যে নিপতিত রয়েছে। তারা ভাবেন, গোস্ত বন্টন করবেন তো কুরবানী হয়ে গেলো। হাজার লক্ষ টাকা খরচ করে গোস্ত বিতরণের পর যদি কুরবানী কবুল না হয়, তবে আর কি হলো? কিন্তু সে কথা আল্লাহ কুরআন পাকেই ঘোষণা করে সাবধান করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এর গোস্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। (সুরা হজ্জ: ৩৭)
অতএব কুরবানী যদি কবুল হতে হয়, তবে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইখলাসের সাথেই পালন করতে হবে। কুরবানীর অনেক মাসআলা মাসায়েল আছে। জেনে শুনে সঠিক ভাবে আমল করা উচিত; জেনে শুনে আমল করা ফরজ তাদের জন্য- যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব বা ফরজ।
পরিশেষে দুআ কামনা করে অধম লেখক তার লেখা শেষ করছে- আয় আল্লাহ তাআলা! আমাদের যাবতীয় সকল কুরবানী কবুল করে নিন। অধমের এই ক্ষুদ্র লেখার বাহ্যিক জাঝা হিসেবে আমাদের মনোভাবকে উন্নত করে দিন। আভ্যন্তরীণ জাঝা হিসেবে আপনি আপনার মতো করে দান করুন। আমিন। বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল আবররারি সাহহিল ইয়া রব্বাল আলামিন।

Comments

comments

About

Check Also

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ইদানিংকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। জাতি সংঘ সহ সারাবিশ্বের সব দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *