নীল সাগরের তীরে

ভ্রমণে রয়েছে অনেক শিক্ষা ও উপকরণ। প্রকৃতির ছোঁয়া আর নির্মলতাই মানুষের মনে ভ্রমণের স্বাদ সৃষ্টি করে। সে উপলব্ধিকে সামনে নিয়ে গত ২৬ মার্চ রাত ৯-টায় বলাকা সার্ভিসে আমাদের কাফেলা রওনা হলো সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে এটাই জীবনের সূচনা সফর। ৫০ জনের বন্ধু কাফেলায় ছিল ইমাম, মুয়াজ্জিন, ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন সুধীজন ও বন্ধুমহল। আবহাওয়া ছিল মিষ্টি। ছিল দেহ-মনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। চারদিক জোসনা মাখা। জানালা দিয়ে দু-পাশের গাছ-গাছালি আর আকাশছোঁয়া খোলা মাঠের দৃশ্য অবলোকন করি, ফলে হৃদয়ে এক অনাবিল শিহরণ খেলে যায়। মাঝে মধ্যে হঠ্যৎ থেমে যাওয়া আর ছুটে চলার সন্ধিক্ষণে আমরা নোয়াখালীর সীমানা শেষ করে পৌঁছে যাই ফেনী মহিপাল। তখন রাতের ঘড়ি ১২-টার কাটায়। এটা হাইওয়ে রোড এবং চার জেলার চার রাস্তা এখানে এসে একটি বৃহৎ জিরোপয়েন্টে পরিণত হয়েছে। এ সড়কের বুক চিড়ে চট্টগ্রাম থেকে রাতভর মালবাহী যন্ত্রদানবগুলো রাজধানী অভিমুখে বেলাগাম ছুটে চলে। বিনিময়ে জ্যামে আটকা পড়ে সাধারণ যাত্রীবাহী গাড়িগুলো। রাত ২-টায় আমরা কালুরঘাঁট পেরিয়ে যাই। ইতোমধ্যে কর্ণফুলী সেতুর নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করি। অল্পক্ষণে পৌঁছে যাই সীতাকুণ্ড। সেখানে নেমে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ক্লান্তি দূর করে খাওয়ার প্রয়োজন পুরো করে নিলাম। জীবনের প্রথম চট্টগ্রামের মাটিতে পা রাখার অনুভূতি ছিল ভিন্নরকম। তাই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে চারদিকে তাকিয়ে ছিলাম পাহাড় দেখার অদম্য স্পৃহায়। মধ্যাহ্ন রাতের আবছা আধারে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পূণরায় সবাই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করে নেই। অল্প সময়ে জানালার ফাঁক দিয়ে হিমেল হাওয়ায় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই। আর গাড়ি এসে পৌঁছে চকোরিয়া।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চকোরিয়া ফজরের নামাজ পড়ার জন্য সবাই নেমে পড়লাম। এখানে আমাদের আগের সাংবাদিক ইউনিটের সাথে সাক্ষাৎ হয়। কারণ সবাই একসাথে আসার কথা থাকলেও সংখ্যাধিক্যের কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দেখলাম একটি কল দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। এ পানিগুলো এক ধরণের মিষ্টি। অথচ স্থলভাগ থেকে তার অদূরে লবনাক্ত বিশাল সমুদ্র। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম, আলহামদুলিল্লাহ! এই সুযোগে সবাই প্রয়োজন মতো পানি পান করে নেয়। সকাল হলো। পূর্ব দিকে সূর্যের আলো ধীরে ধীরে গাছগাছালির গায়ে হালকা লাল রংয়ের আভা ছড়িয়ে দিল। পাখির কলতানে গোটা পরিবেশ মুখরিত। বাম দিকের ছোট ছোট পাহাড়গুলো ক্রমেই পেছনে হারিয়ে যেতে লাগলো। সম্মুখ দৃষ্টি কেবল সমুদ্র দেখার অধির অপেক্ষায়! জীবনে নতুন কিছু দেখার রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি নীল সাগরের সৈকতে। কক্সবাজারের আসল সৌন্দর্য্যই নীল সাগরের বুক ছিড়ে বালুময় তীরে পাহাড় সমান ঢেউ আছড়িয়ে পড়া।
আমাদের গাড়ী সকাল ৮-টায় সৈকতের অদূরে অবস্থিত বিমান বন্দরের দক্ষিণ দিকের বাস টার্মিনালে গিয়ে পৌঁছে। এখানে রান্না করার সরঞ্জামাদি রেখে সবাই ‘ইনানী বিচ’ দেখতে চলে যাই। সেখানে রয়েছে পাথর এবং লোনা পানির এক অনন্য দৃশ্য। যাওয়ার পথে বাম দিকে উঁচু উঁচু পাহাড় আর ডান দিকে সাগরের ঢেউয়ের মিছিল, এ যেন এক স্বপ্নের পৃথিবী। সেখানে না গিয়ে এ সৌন্দর্য উপলদ্ধি করা সম্ভব না।
পাথর-জলে ইনানিবিচ : সকাল ১০-টায় বিচিত্র বর্ণের পাথর দিয়ে সাজানো ইনানিবিচ সৈকতে পৌঁছে যাই। কী অপূর্ব! প্রবেশ পথে শামুক দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন ধরণের জিনিস! আমরা সেখানে মন-প্রাণ উজাড় করে সমুদ্রের দৃশ্য ও পাথরের শীতল ছোঁয়া অনুভব করলাম। সমুদ্র সৈকতের এই প্রথম সফরকে স্মৃতিপটে সমৃদ্ধ করে রাখতে খালি পায়ে সাদাবালির উপর ঘুরে বেড়াই অনেকক্ষণ। তারপর শামুক কুড়িয়ে আকাশ-পানির বিশাল দিগন্তটা চোখ ভরে দেখে নেই। তারপর আবার সবাই গাড়িতে এসে আসন গ্রহণ করি।
হিমছড়ির আকাশ ছুঁয়ে : আমাদের গাড়ি ছুটে চলে হিমছড়ির উদ্দেশ্যে। ৫৩ টাকার টিকেটের বিনিময়ে পৌঁছে যাই হিমছড়ির আকাশে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যদিও ক্লান্তি অনুভব হচ্ছিল তবে চূড়া দেখার আনন্দ ছিল ভাষাতীত। আকাশে না পৌঁছলেও হিমছড়ির পাহাড় হয়ে আকাশের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। এক দেখায় যেন মন ভরে না। কয়েকটা পাহাড়ের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে হিমছড়ির এ দর্শণীয় স্থানটি। উপর থেকে সমুদ্রের দৃশ্য ক্যালেন্ডারের চিত্রের মতোই সুন্দর। কুলে আঁচড়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন আর বাতাসের ঝাপটায় এক ধরণের মোহনীয় ঝংকার ওঠে। উষ্ণ মৌসুমের কারণে পাশের পাহাড় থেকে এ পাহাড়গুলিকে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভাজন করা হয়েছে। যাতে বিপদস্থানের দিকে কেউ যেতে না পারে। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত মাঝখানে এমন একটি জায়গা রয়েছে যার অধিকাংশ বৃক্ষ জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঝর্ণা দেখার জন্য পাহাড়ের বিকল্প দিক হয়ে আমরা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম যেখানে নামার কোনো সিঁড়ি নেই। এছাড়া অন্ন পাশ দিয়ে যেতে পাহাড় থেকে নামতে হবে এবং সময় লাগবে সাত-আট মিনিট। উপর থেকে নিচের দূরত্ব প্রায় ২০০ গজ। কোনো ভাবে পাঁ পিছলে গেলেই নিচে চলে যেতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে সতর্কতার সাথে মাটির সাথে মিশে মিশে কোনো মতে নেমে ঝর্ণা দেখতে চলে যাই। পানিগুলো খুবই অপরিষ্কার। তবুও কেউ কেউ আবেগে হাত-মুখ ধুয়ে নিচ্ছে। অনেকে সেরে নিচ্ছে গোসল। তারপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে কক্সবাজার মূল পয়েন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই। গাড়ির ভেতর থেকে ডানদিকের হিমছড়ির অসংখ্যা আকাশচুম্বী পাহাড় দৃশ্যগোচর হয়। ১২-টায় কক্সবাজার বাস টার্মিনাল এসে দুপুরের খাবার খেয়ে জোহরের নামাজ পড়ি।
কক্সবাজার সৈকতে : অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা সমুদ্র সৈকতে রওনা হই। প্রথমে ঝাউবন, বালুময় মাঠ তারপরেই পৃথিবীর বৃহত্তম সমদ্র সৈকত কক্সবাজার। দু’দিকে নীল সাগরের হাতছানি। সবাই নেমে যাই লোনা পানির অবারিত ঢেউয়ের মোহনায়।
সৈকতে আঁছড়ে পড়া লোনা পানির নিদারুন স্পর্শ অনুভবে দোলা দিয়ে যায়। আকাশছোঁয়া জলদিগন্তে দৃষ্টি দিলে ইচ্ছে করে এ ঢেউয়ের মিছিলে গা ভাসিয়ে দূর সাগরে হারিয়ে যাই। সূর্যের আলো সমুদ্রের চলমান ঢেউয়ে কিরণ ছড়িয়ে সৃষ্টি করে নতুন নতুন চমক। বালুময় তীরে দক্ষিণা বাতাসের হিল্লোলে ঝাউয়ের শাখে বায়ুবাজনা বেজে ওঠে। কূলে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সাথে তীরে চলে আসে সাদা বালি আর বিচিত্র বর্ণের ক্ষুদ্র শামুক। শেষ বিকেলে প্রাণভরে সূর্য ডুবার দৃশ্য উপভোগ করি।
২৬ শে মার্চ ছিল সমুদ্র সৈকতের দিগন্তহীন ঢেউয়ে হারিয়ে যাওয়ার দিন। এ হারিয়ে যাওয়া এবং সূর্য ডুবার দৃশ্যপট জীবনের প্রতি একটি নীরব ইঙ্গিত। জীবনটা এভাবে একদিন শেষ হয়ে যাবে আর ডুবে যাবে স্বপ্ন আশার তরীগুলো। হাজার মানুষ এখানে আসে ঠিকই কিন্তু সমুদ্রের নিঃসঙ্গ বা একাকিত্বের শিক্ষা নেয় না। সন্ধ্যার পরেই ক্লান্ত অবসন্ন মন নিয়ে নীল সাগরের তীর থেকে বিশাল অর্জন নিয়ে হৃদয়-মন তৃপ্ত করে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভুমি কক্সবাজারকে বিদায় জানাই।

Comments

comments

About

Check Also

হাওরের দেশে

‘বাংলা তোমার ধুলো আমার অঙ্গে নেবো মেখে বিশ্ব দেখার স্বাদ মেটাবো তোমায় দেখে দেখে।’ বাংলাদেশ! …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *