চিনে মুসলমানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসা

সিরাজুল ইসলাম সা’দ

নজিরবিহীন ভাবে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী উইঘুর মুসলমানদের ওপর কমিনিষ্ট পার্টির সরকার অমানবিক নির্যাতন, হত্যা, মারধর, ধর্ষণ, যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক, গুম, নিষিদ্ধ ঔষধ প্রয়োগ, নারী-পুরুষদের সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া ও অনৈতিক ট্রায়ালের মতো নানা মানবাধিকার লঙ্গন করছে। প্রায় ২০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে শিক্ষা কেন্দ্রের নামে ডিটেনশন ক্যাম্পে বিনা বিচারে আটকে রেখে বীভৎস কায়দায় নির্যাতন করছে। এ পর্যন্ত গোপনে ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, শত শত উইঘুরের মুসলমানকে একটি বন্ধিশিবিরে দুই হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে ফেলে রাখা হয়েছে। এ সব ভিডিও ও স্থিরচিত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে বিশ্বের সচেতন মানুষ আঁতকে ওঠেন। উইঘুর মেয়েদের সাথে চীনাদের জোরপূর্বক বিয়ে, ধর্ম পালনে বাঁধা দেয়া, সহায় সম্পত্তি কেড়ে নেয়া, নতুন মসজিদ নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা, পুরনো মসজিদ সংস্কার করতে গেলে প্যাগোডার আদলে পূণর্বিন্যাস করা, হানদের সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উইঘুরদের যাবতীয় ধর্মীয় পরিচয়, কৃষ্টি ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্য শেষ করে দিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে সর্বাত্বক চেষ্টা করছে চীন সরকার।
সম্প্রতি নিউজিল্যান্ড ও অষ্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে-বন্ধিশিবিরে আটক উইঘুর মুসলমানদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোরা বাজারে বিক্রি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে চীন।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট বলেছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার উইঘুরকে শিনজিয়াং থেকে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের কারখানায় পাচার করা হয়েছে।
গত ৫ অক্টোবর সিএনএন একটি সংবাদ প্রচার করে উইঘুর মুসলমানদের ব্যাপারে। এ সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে গোটা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিএনএনকে দেয়া প্রায় তিন ঘন্টার এক সাক্ষাৎকারে উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য পাশ করেন। বর্তমানে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরিবার পরিজন ফেলে ইউরোপের একটি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বন্দি উইঘুরদের প্রতি তিনি নিজে যে বীভৎস নির্যাতন চালিয়েছেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ত। এ দুঃসহ স্মৃতি তাকে এখনো তাড়া করে এবং রাতে ঘুমাতে দেয় না। তিনি জানান, স্বীকারাক্তি আদায়ের জন্য প্রায় প্রতিটি বন্দীকে পেটানো হতো। বৃদ্ধ, নারী এমনকি ১৪ বছরের কিশোরও এ ক্ষেত্রে বাদ পড়ত না। স্বীকারাক্তি আদায়ে একেকজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য একেক পন্থা অবলম্বন করতেন। কেউ বন্দীকে পানিতে ডোবাতেন, কেউ ইলেকট্রির শক দিতেন, কেউ বিবস্ত্র করে পেটাতেন, কেউ যৌন নির্যাতন করতেন, কেউবা অন্য বন্দীদের দিয়ে গণধর্ষণ-বলাৎকার করাতেন। এর পর স্বীকারোক্তি আদায় হলে পরবর্তী পর্যায়ে বন্দীদের ডিটেনশন ক্যাম্প বা কারাগারে রাখা হত। যেখানে তাদের জোরপূর্বক স্বেচ্ছাশ্রমে বাধ্য করা হতো।

The Chinatown Gateway on Beach Street in Boston. (Robin Lubbock/WBUR)


এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ২০১৪ সালে উইঘুর মুসলিমদের দমনে চীন সরকার মূল ভূখণ্ড থেকে এক লাখ ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করে। অফিসারদের জানিয়ে দেয়া হয়-উইঘুররা হল ‘চীনের শত্রু’ তাই তাদের দমন করতে হবে। সেই লক্ষ্যে পূর্ব থেকে একটি তালিকা তৈরি করা থাকত। তালিকা অনুযায়ী একেক দিন একেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে উইঘুরদের আটক করা হতো। এর বাইরে গ্রাম প্রধানের মাধ্যমে আলোচনায় বসার কথা বলেও গণহারে গ্রেফতার করা হতো। আর এর ওপরেই নির্ভর করত পুলিশের প্রমোশন। তিনি বলেন, ‘পুলিশে ১০ বছর চাকরি করেও প্রমোশন না পেলেও উইঘুর দমনে কাজ করায় স্বল্প সময়েই কয়েকবার প্রমোশন পেয়েছেন তিনি।’ (সিএনএন, ৫ অক্টোবর ২০২১, প্রকাশিত এই সংবাদের অনুবাদ করেছেন শফিকুল ইসলাম শান্ত। দৈনিক আমাদের সময়, ঢাকা, ৬ অক্টোবর ২০২১ প্রকাশিত )
বিবিসি জানায়, চীনের অনুরোধে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ‘কুরআন মজিদ’ চীনা অ্যাপ ষ্টোর থেকে সরিয়ে নিয়েছে। সারা বিশ্বের সাড়ে তিন কোটিরও বেশী মুসলিম এ অ্যাপটি ব্যবহার করেন এবং এর ওপর আস্তা রাখেন। শুধু চীনে ১০ লাখ ব্যবহারকারী রয়েছে। চীনে বহু ইমাম ও খতীবকে গুম করা হয়েছে। কমিনিস্ট শাসিত চীন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আগামী পাঁচ-সাত বছরে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে শীর্ষস্থান দখল করে নিবে। পুরো মুসলিম বিশ্ব চীনা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ কোটি কোটি ডলার। উইঘুর মুসলিমদের ভয়ঙ্কর নির্যাতন বন্ধে টুঁ শব্দ করার সক্ষমতা বা সাহস ওআইসি, আরব লীগ বা কোন মুসলিম রাষ্ট্রের নেই। তাই তো মুসলিম দেশগুলো দর্শকদের মত শুধু চেয়ে দেখছে। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান চীনা সংখ্যালঘু বিষয়ক নীতির প্রশংসাও করেছেন। চীনকে তেল মালিশ না করলে মুসলিম দেশগুলো চলতে পারবে না। চীন ঋণ দিয়ে সকলকে আটকে রেখেছে। আমাদের বাংলাদেশেও চীন বিনিয়োগ করছে উন্নয়নের জন্য। চীনের বিরুদ্ধে একবার কথা বললে উন্নয়নের চাকা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই মুসলমানদের আরো দুর্দশা ও নিপীড়ন অপেক্ষা করছে। তবে ইতিহাস প্রমাণ করে ইসলামের জয়যাত্রাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। তবে আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি না করে এসব ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে ময়দানে কথা বলতে হবে। পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন ‘তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে। (সুরা সফ-৮)।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *