নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

দুই.
সফিউর রহমানের সহিত মাসুদার পরিণয়ক্রিয়া নিষ্পন্ন হইয়া গেল। রফিজ মিয়ার দায়িত্ব এবং কর্তব্য মেয়ের বিবাহ দেওয়া। সেই দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করিতে পারিয়া তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন। মেয়ে সুখি হইবে কিনা, পাত্রটি মনঃপূত হইল কিনা, এসকল সংবাদ লইবার আবশ্যকতা বোধ করিলেন না।
আমাদের সমাজে এমনি অভিভাবকেরা তাহাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের সুখ-শান্তিকে জলাঞ্জলি দিয়া থাকে। তাঁহারা কদাচ তলাইয়া ভাবিতে চাহেন না যে, তাঁহাদের এই রূপ অভিভাবকত্ব ফলানোর জন্যই কতো দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি হইতে পারে। এরই ফলে কতো নব প্রস্ফুটিত কুসুম হতাশার ব্যথা বুকে লইয়া অকালে ঝরিয়া পড়ে!
কাজীর গাঁ। সফিউর রহমানের গৃহ। মাসুদা বধূ হইয়া এখানে পদার্পণ করিল। পিতার ইচ্ছায় তাহার বিবাহ হইয়াছে। পাত্র যে মনঃপুত হয় নাই, তাহা আমরা জানি। তবু প্রতিবাদ করে নাই। স্বামীর ঘরে আসিয়াছে সত্য, তবু তাহার মনে শান্তি নাই। সুখ-শিহরণ নাই। নেহাৎ যন্ত্রচালিতের মতো তাহাকে আসিতে হইয়াছে। কুমারী মেয়ের এতোকালের স্বপ্ন, আজ বাস্তবের ছোঁয়া পাইয়া সফল হইবে। ইহার চাইতে পুলকের বিষয় আর কী থাকিতে পারে? তবু, কই, মাসুদার দেহ-মনতো অজানা কোন পুলকে রোমাঞ্চিত হয় না!
মাসুদার সম্মতি ব্যতিরেকে যদিও বিবাহ হইয়াছে, তবুও সে ভাবিল যে, বিবাহ যখন হইয়া গিয়াছে, তখন আর কী করিবার আছে? কোন্দল করিলে অশান্তি বাড়িবে, সুফল কিছুই ফলিবে না। আর হইবে নানান রকমের অপবাদ। কতজনে কত কথা বলিবে। অশ্লীল ইংগিত করিয়া লোকে হাসাহাসি করিবে। ইহাতে তাহার অপমান, তাহার পিতা-মাতার অপমান। কাজেই বীতশ্রদ্ধ হইলে চলিবে না। ঘৃণা করিয়া লাভ নাই। যে স্বামী পাইয়াছে, তাহার মন যোগাইয়া চলিবে সে। তাহারই সংসারে সে নিজেকে খাপ খাওয়াইয়া লইবে। মুখ বুঝিয়া হজম করিবে। কোনো প্রতিবাদ সে করিবে না। পিতার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।
এমত অবস্থা শুধু তাহার একার নয়, মাসুদা তাহা জানে। এমনি কতো মেয়ে অবাঞ্চিত স্বামীর ঘর-সংসার করিয়া যাইতেছে। যুগ-যুগ ধরিয়া ইহা চলিতেছে। এই মহানাটকের যবনিকা নাই। ইহার অভিনয়ে কাল চলিয়াছে, আজ চলিতেছে, ভবিষ্যতেও হয়ত চলিবে। দুঃখের মধ্যে সান্ত্বনা অইটুকু যে, এ-ব্যথা শুধু তাহার একার নয়। এ-ব্যথার ব্যথী আরও অনেক আছে।
মেয়েরা যে অনন্যোপায়। তাহাদের অন্য গতি নাই। পুরুষদের সবপথ খোলা। স্বেচ্ছায় হউক কি অভিভাবকের ইচ্ছায় হউক বিবাহের পর স্ত্রী রতœটি যদি মনের মতো না হয়, তবে বিদায় করিতে তাহাদের বেগ পাইতে হয় না। তাই কস্মিনকালেও তাহারা ‘মনের মতো বউ’ ব্যতীত দাম্পত্য ধর্ম পালনে রাজি নয়। আর, মেয়েদের বেলায় ‘মনের মতো স্বামী’ না হইলে তাহার ঘর করিব না-মামাবাড়ির আব্দার নাকি যে, বলিলেই হইল? উহু, তাহা বিলবার যো-টি নাই। পুতুল খেলা নাকি যে, ইচ্ছা হয় খেলিলাম, ইচ্ছা হইল না-ভাংগিয়া ফেলিলাম? তাহা অনায়াসেই পুরুষের পক্ষে সম্ভব, পুতুল খেলা বৈকি! কিন্তু মেয়েদের বেলায় ‘নৈবতুল্য কদাচনঃ’। অতএব, মুখ বুঝিয়া সহ্য করা ব্যতীত মেয়েদের আর কী উপায় আছে? সহনশীলতাই যে রমণীর বড়ো গুণ। তাহা কি তা সর্বংসহা হইতে হইবে। আর-
তুমি মেয়ে-ফোটা ফুল,
তোমার চারিপাশে যতক্ষণ খুশি
গুণগুণ করবে অলিকুল;
তারপর সুযোগ বুঝে
যাবে উড়ে অনেক দূরে
তোমার নাগালের বাইরে-
তাতে তুমি কথা কইবার কে?
পিয়াসী পথিক,
তোমার রূপের মোহে পড়ে
আসবে তোমার পাশে
নেবে তোমায় ছিঁড়ে-
তুমি ‘উহু’ বলবার কে?
তারপর যতক্ষণ খুশি তোমায় শুঁকবে,
যখন ইচ্ছা ফেলে দেবে আস্তাকুঁড়ে,
সেখানে থাকবে পড়ে!
অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া মাসুদা মনকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করিল। সবই অদৃষ্ট, ভাবিল। কেননা, মেয়েরা অদৃষ্টের অধীনা। পুরুষের বেলায় তাহা নয়। অদৃষ্ট তাহাদের অধীন। যখন যেদিক খুশি চাকা ঘুরাইলেই হইল। মেয়েদের পক্ষে তাহা কল্পনাও অতীত।
মাসুদা ভাবিল, মন হইতে সকল গ্লানী দূর করিতে হইবে। কোনো ক্ষোভ, কোনো ব্যথা অন্তরে ঠাঁই দিবে না। সব ভুলিবে। অতীতকে মনের কোন্ হইতে দূরে তাড়াইবে। কোনো স্মৃতিই আর স্মরণ-পথে উদিত হইতে দিবে না।
কী ফলিবে তাহাতে? ভাবিল সে-
‘কিছু বাঁধা পড়িল না শুধু এ বাসনা-
বাঁধনে।
কেহ, নাহি দিল ধরা শুধু এ সুদূর-
সাধনে।
দিন শেষে দেখি ছাই হল সব
হুতাশে
আমি কেবলি স্বপন করছি বপন
বাতাসে।’
আর স্বপ্ন নয়, কল্পনা নয়। বাস্তবে যাহা দুয়ারে সমুপস্থিত, তাহাকেই বরণ করিয়া লইতে হইবে। কষ্ট হইবে হয়ত। তবুও চেষ্টা করিতে হইবে। যাহা পাওয়া যায়, তাহাতে সন্তুষ্ট থাকার প্রয়াস পাইতে হইবে। নতুবা মনোকষ্ট বৃদ্ধি পাইবে। তাহাতে কী লাভ হইবে? মাসুদা এমনি অনেক ভাবিল, কিন্তু অবুঝ মন বারে বারে অস্থির হইয়া পড়ে। প্রবোধে ভুলিতে চায় না।

তিন.
সালীমপুর। মাসুদার পিত্রালয়। প্রথমযাত্রা স্বামীগৃহে কয়েকদিন থাকিবার পর সে এখানে আসিয়াছে। সংবাদ পাইয়া প্রতিবেশী সই আয়েষা তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল।
আয়েষা যখন আসিল, মাসুদা তখন নির্জন প্রকোষ্ঠে বসিয়া নিবিষ্ট-মনে একখানা উপন্যাস পড়িতেছিল।
আয়েষা সকৌতুকে হাসিয়া বলিল-কিগো, খুব যেভাবে বিভোর দেখি? এই কদিনেই এতো? খুব মজিয়ে নিয়েছিস্ তাহলে!
মাসুদা বই হইতে চোখ ফিরাইল। তারপর মৃদু হাস্যে বলিল-হ্যাঁ,, বুঝেইতো নিয়েছিস! আয়, কাছে বস্।
আয়েষা বসিল। তারপর স্মিতকণ্ঠে বলিল-তাইতো ভাবি-
‘রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা
বসিয়া নিরলে থাক যে একেল
না শুনে কাহারও কথা।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে
না চলে নয়ন-তারা
বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে
যেমতিযোগিনী পারা ॥

এক দুই করি ময়ূর ময়ূরী
কণ্ঠ করে নিরিখনে
চন্ডীদাস কয় নব পরিচয়
কালিয়া বঁধূর সনে।’
হাসিয়া মাসুদা কহিল-হ্যাঁ,-
‘রূপ লাগি’ আঁখি ঝুঁরে
গুণে মনভোর।
প্রতি অঙ্গলাগি’ কাঁদে
প্রতিঅঙ্গ মোর ॥
হিয়ার পরশ লাগি’
হিয়া মোর কাঁদে।
পরান পুতলি মোর
থির নাহি বান্ধে ॥’
উভয়ে এমনি রহস্যালাপ করিল, আবৃত্তি করিল, কৌতুকপূর্ণ বক্র হাসি হাসিল। মাসুদার মনে কোনো ব্যথা, ক্ষোভ, গ্লানী আছে বলিয়া মনে হইল না। সহজ ভাবেই সে হাসি-ঠাট্টা-তামাশায় যোগ দিলো।
আয়েষা বলিল-তারপর, আছিস্ তো ভালো?
: দেখতেই তো পাচ্ছিস্।
: দেখে তো বেশ ভালোই মনে হয়। তোর চেহারা খানা তো বেশ খুলেছে!
: তাই নাকি? … … … সহাস্যে বলিল।
: তাইতো মনে হচ্ছে। শুনেছি, স্বামীর ছোঁয়া লাগলেই নাকি রমণী আরও রমণীয় হয়ে ওঠে। কথাটা মিথ্যে নয় তাহলে!
: ওটা তোর দৃষ্টিভ্রম। বরং আমার চেহারা অনেকটা খারাপ হয়ে গেছে। দেখছিস না, শুকিয়ে গেছি কতো খানি, এই কদিনেই।
কথাটা মিথ্যা নয়। দুশ্চিন্তা, দুঃখ-ক্ষোভ-যে জন্যই হউক মাসুদা এই কদিনেই অনেকটা শুকিয়ে গেলেও, তার চোখ-মুখ কেমন মুকানো-চুপসানো মনে হয়। আয়েষা এই পরিবর্তনকে উলটাইয়া দেখিতেছে অথবা বলিতেছে।
তাপার আয়েষা সকৌতুকে হাসিয়া প্রশ্ন করিল-নতুন জীবনের নতুন আনন্দ, নতুন অভিজ্ঞতার কথা শুনাবিনে দু’একটা। আমরা না হয় শুনেই একটু আমোদ পেলাম। ক্ষতি কী তাতে? বল-
‘সে আমি কহিল, ‘প্রিয়ে, মুখ তুলে চাও।’
দূষিয়া তাহারে রুষিয়া কহিনু, ‘যাও।’
সখী, ওলো সখী, সত্য করিয়া বলি-
দাঁড়াল সমুখে, কহিনু তাহারে, ‘সরো!’
দরিল দু হাত, কহিনু, ‘আহা কী কর!’
সখী, ওলো সখী, মিছে না কহিব তোরে-
তবু ছাড়িলনা মোরে।

অধরে কপোল পরশ করিল তবু-
কাঁপিয়া কহিনু, ‘এমন দেখিনি কভু!’
সখী, ওলো সখী, একি তার বিবেচনা-
তবু মুখ ফিরালোনা।’

আবৃত্তি অন্তে মাসুদার মুখ-পানে চাহিয়া আয়েষা মৃদু-মধুর কৌতুক হাসি হাসিতে লাগিল। মাসুদাও সুস্মিতা না হইয়া পারিল না।
আয়েষা কহিল-ফাঁকি দেবো কেনো? শোন্-প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়ি গিয়ে চৌদ্দহাত ঘোমটা টেনে কলা বউ সেজে থাকতে হবে। কারো সংগে কথা কওয়া চলবে না, স্বামীর সংগেতো নয়ই। নচেৎ সবাই বেহায়া বলবে। খেতে হবে কম-নইলে রাক্ষসী বলবে। কেউ দেখতে এলে, দৌড়ে পালাবে ঘরের কোণে। সবাই না ঘুমিয়ে গেলে ঘুমাতে পারবে না, হও না তুমি ঘুমে কাতর। কাক-পক্ষি জাগবার আগেই তোমাকে ঘুম থেকে জাগতে হবে, হোক না তোমার শরীর খারাপ। এইতো বল্লাম কতো। আর কী শুনতে চাস্?
আয়েষা কহিল-খুব শুনলাম যা হোক। এখন বল্ লোকটি কেমন হলো? মনে ধরেছে তো?
মাসুদা কহিল-সেইটে বলতে পারবো না। এখনো তেমন পরিচিতা হয়ে উঠতে পারিনি যে, তোকে সঠিক কিছু বলব। তবে বিশেষ রস-রঙতো নেইই, নেহাৎ সেকেলে ধরণের। মনে হয়, কাজ-কর্ম, খাওয়া-শোয়া ইত্যাদি হলেই তার চলতে পারে। বউয়ের সাথে রংগ-তামাসা, প্রেম-প্রীতির অভিনয় করে জীবনে বৈচিত্র্য আনবার মতো খুশ-দিল্ তার নেই! যাকগে; ও সব কথা এখন থাক। চল বেড়িয়ে আসি তোদের বাড়ি থেকে। … … … অতঃপর উভয়ে স্থানান্তরে চলিয়া গেল।

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *