দেশ বাঁচাতে ধর্মশিক্ষা বাঁচান!

স্বাধীনতার পরে এই প্রথম এসএসসি পর্যাযে় ধর্মশিক্ষাকে বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া হযে়ছে। যে বিষয়গুলো বোর্ড পরীক্ষায় রাখা হযে়ছে, সেগুলোর নাকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বা প্রযে়াজন আছে; ধর্মের কি তা আছে! এটি অস্বীকার করার কেউ নেই, পানির ক্ষেত্রে সমুদ্র যেমন, নৈতিকতার ক্ষেত্রে তেমন হচ্ছে ধর্ম। নৈতিকতার অভাব নিযে় প্রকৃতপক্ষে কি কোনো দেশ আদৌ উন্নত হতে পারে? আসলে কি অবকাঠামোগত উন্নতিই দেশের উন্নতির একমাত্র সূচক? অবকাঠামোগত উন্নতিতে যদি পূর্ণাঙ্গ সুনীতির প্রযে়াগ হতো, তাহলে আরো অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হযে় যেত। তাই যদি হয়, তাহলে কোন যুক্তিতে ধর্মশিক্ষা গুরুত্বহীন করা হচ্ছে? পারমাণবিক বোমায় হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বস্তুগত যে মারাত্মক ক্ষতি হযে়ছিল, ধর্মশিক্ষাকে বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দিযে় গুরুত্বহীন করার মাধ্যমে জাতীয়ভাবে আমাদের নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক দিযে় তার চেযে়ও ভয়াবহ ক্ষতি হবে। একটি মসজিদ গুঁডি়যে় দিলে, একটি মাদরাসা বাতিল করলে যেভাবে টনক নডে় ওঠে, ধর্মশিক্ষাকে পঙ্গু করার মাধ্যমে তিন-চার কোটি শিক্ষার্থীর ঈমান যে, হুমকির মুখে পড়ল, তাতে সেরকম টনক নড়ছে না। ব্যাপারটি এরকম যে, এক লোকের বিষফোঁড়া হযে়ছে, তাই নিযে় দাপাদাপি হচ্ছে; কিন্তু ওই লোকেরই ব্লাড ক্যান্সার হযে়ছে, তা নিযে় মাথাব্যথা নেই। কারণ, ক্যান্সার সাদা চোখে দেখা যায় না। এটি অবশ্যই অদূরদর্শী-মাথামোটা লোকেদের অবস্থা। আমরা যেভাবে রুটিনওয়ার্কের বৃত্তের মধ্যে আটকে আছি, মনে হচ্ছে যেন ইমারজেন্সির অগ্রাধিকারবোধ অনেকেরই নেই।
আমরা যদি চাই, আমাদের প্রজন্ম চীনের মতো কোটির অঙ্কে নাস্তিক না হোক, ওরা আমাদের বার্ধক্যে বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসন না দিক, আমাদের জানাজায় সন্তান হিসেবে শরিক হোক, জারজ সন্তানে দেশ ভরে না উঠুক, কওমে লুতের মতো সমকামিতার ভাইরাস দেশময় ছডি়যে় না যাক, দুর্নীতিতে দেশ আজীবন চ্যাম্পিয়ান না হোক, ঘরে ঘরে সন্তানের হাতে মাতা-পিতা আর স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষক খুনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক, দেশ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত থাকুক, তাহলে সব সম্প্রদাযে়র জন্য ধর্মশিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রাখতেই হবে। এক কথায়, দেশ বাঁচাতে হলে ধর্মশিক্ষা বাঁচাতেই হবে। আর সেটি অবশ্য বোর্ড পরীক্ষায় বহাল রেখেই কেবল সম্ভব; বরং ভাবতে হবে, কীভাবে আরো সুসংহত, ব্যাপকভিত্তিক ও সর্বময় করা যায়। অর্থাৎ ওংষধসরুধঃরড়হ ড়ভ শহড়ষিবফমব-এর বিপ্লব ঘটাতে হবে। এ জন্যই বলা হচ্ছে- সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষার কথা, প্রি-প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত সাধারণভাবে ইসলামের ন্যূনতম ফরজ জ্ঞান যাতে অর্জন করে আর স্নাতক/সম্মান ও স্নাতকোত্তরে বিষয় ভিত্তিক ইসলামী জ্ঞান প্রযে়াজনমতো যাতে হাসিল হয়। একজন চিকিৎসককে যেমন জানতে হবে, ইসলামে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মৌল আদর্শটা কী, তেমনি একজন আইনবিদকেও জানতে হবে, ইসলামের দ-বিধি, বিচারব্যবস্থা ও আইন প্রণয়নে ইসলামের হিকমত ও আদর্শ। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী; এক কথায় সব পেশা ও বৃত্তির সবাইকেই জানতে হবে নিজ নিজ সেক্টরের ইসলামী বিধান। আর এক দল স্কলার আলেমকে সব বিষযে়র বিশেষজ্ঞ হতে হবে যেটি উন্নত মানের মাদরাসা থেকে তৈরি হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রেও শেকড় কর্তনের পাঁয়তারা চলছে। জেনারেল শিক্ষায় ধর্মের বারোটা সুন্দর করে বাজাতে পারলে মাদরাসাটা হজম করার চেষ্টায় কসুর থাকবে না।
যিনি ‘ইনশাআল্লাহ’র ভাষণে স্বাধীনতা এনেছেন, গর্ব করে বলেছেন, ‘আমি বাঙালি ও মুসলমান’, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার ময়দান বরাদ্দ দিযে়ছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন, ওআইসির সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন, ‘এ দেশের বুনিয়াদি শিক্ষা হবে মক্তব শিক্ষা’; সব মিলিযে় বাংলাদেশে একটি আধ্যাত্মিক আবহাওয়া ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিবেশ বাঁচিযে় রেখেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী পিতার পদাঙ্ক অনুসারে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ, আরবি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দাওরা হাদিসের মাস্টার্স সমমানের সনদ প্রদান ও মিলাদুন্নবী সা:-কে জাতীয় দিবস হিসেবে গেজেটভুক্ত করার মতো বিশেষ কিছু অবদান রেখেছেন। কিন্তু মাদকের লাইসেন্স শিথিলকরণ ও সিনেমা হলগুলোকে প্রণোদনা দিযে় পুনর্জীবনদানের মতো ইসলাম ও সমাজবিধ্বংসী নিত্যনতুন পদক্ষেপের ফলে তাহাজ্জুদ-খ্যাত প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারকে সরল বিশ্বাসী লোকেরা যে ধর্মবান্ধব মনে করত, তাতেও সন্দেহের চিড় ধরেছে। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থায় তারা যে, ইউটার্ন নিযে়ছেন, তাতে সেই সন্দেহই কেবল ঘনীভূত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর সব সম্প্রদাযে়র প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই সুনাম ভূলুণ্ঠিত করার জন্য বিদেশী শকুনি চোখের বদ অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কারা নিযে়াজিত রযে়ছেন, প্রধানমন্ত্রীর তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খতিযে় দেখা প্রযে়াজন।
বিতর্কিত কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের জাবরকাটা শ্লোগান এই ধর্মপ্রাণ জাতিকে আতঙ্কিত করেছে বর্তমান সরকার দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬ তে যখন ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালে এই সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার ফলে ২০১০ থেকে সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাস; বিশেষ করে বাংলা সাবজেক্ট চরমভাবে অশুচির শিকার হয়। নিজেকে নাস্তিক বলে যিনি গর্বিত বোধ করতেন, তার রচিত ‘বই’ নামে একটি ‘সাম্প্রদাযি়ক উসকানির’ কবিতা এ সমযে় পাঠ্য হয়। পঞ্চম শ্রেণির কোমলমতি শিশুকে তখন শেখানো হতো-
‘যে বই তোমায় দেখায় ভয়/সেগুলো কোনো বই-ই নয় /সে বই তুমি পড়বে না। যে বই তোমায় অন্ধ করে/যে বই তোমায় বন্ধ করে/সে বই তুমি ধরবে না।’
পবিত্র শিক্ষাব্যবস্থাও যে রাজনৈতিক বিষবাষ্পের শিকার হয়, কচিকাঁচা শিশুদের তা বোঝারই কথা না। তাই ওরা সাদা মনে প্রশ্ন করত- কোন বইটি অন্ধ করে? কোন বই পড়া যাবে না? বেচারা স্যার-ম্যাডামদের তখন কিছুই বলার থাকে না। এ সমযে় সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়, মহানবী সা:, হজরত আবু বকর ও উমর রা:-এর জীবনী; বিপরীত দিকে অনুপ্রবেশ করানো হযে়ছে- ‘লাল গরুটা’ ও ‘লালু’ গল্প, যাতে শেখানো হয়- গরু মাযে়র মতো; তাই কোরবানি করা যাবে না এবং কালীপূজা ও পাঁঠাবলির কাহিনীও রযে়ছে এসব গল্পে। অষ্টম শ্রেণির কপালে জুটেছে রামায়ণের সংক্ষিপ্ত রূপ। সম্প্রতি সংসদে একজন সংসদ সদস্য এসব অভিযোগ উত্থাপনপূর্বক প্রত্যাহারও করেছেন। আসলে তার ত্রুটি ছিল- তিনি তার অভিযুক্ত সিলেবাসের সময়সীমাটা উল্লেখ করেননি। ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঠ্যজুডে় সাহিত্যের নামে এসব চলতে থাকে। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের দাবিতে সরকার সিলেবাসের আগাছা নিড়ায়। ওসব নিডি়যে় ফেললেও ওর চেযে় ভয়াবহ বিকল্প, নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত ‘জুযে়ালজি’ও ‘বাযে়ালজি’তে ঈমানবিধ্বংসী, ডারউইনের হাইপোথিসিস ‘বিবর্তনবাদ’ পুরোদমে পাঠ্য রযে়ছে।
শুধু এখানেই ক্ষান্ত নয়, ২০১০ সালে তারা একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। শিক্ষানীতির প্রাক-কথনে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, ‘এখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হযে়ছে।’ এ ছাড়া এই শিক্ষানীতিতে ৩০টি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হযে়ছে, যার ১৬ নং হচ্ছে- ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা।’ এই জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে ২০১২ সালে তারা প্রণয়ন করেন জাতীয় কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম। আর এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০২০ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রকাশ করা হয়। এই রূপরেখায় তিন কোটি শিক্ষার্থী তথা দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতির দিকটি হলো- প্রথম পাবলিক পরীক্ষা এসএসসির সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বোর্ড পরীক্ষা থেকে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে বাদ দেয়া হযে়ছে। যে পাঁচটি বিষযে়র বোর্ড পরীক্ষা হবে, তা হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান। এর ভেতরে ধর্মশিক্ষা নেই। আর যে পাঁচটি বিষযে়র বোর্ড পরীক্ষা হবে না, তা হলো- জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভালো থাকা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা, পৃষ্ঠা-৯৭)।
তাহলে ধর্মশিক্ষা আছে মাত্র স্কুলের ক্লাস ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন তথা অভ্যন্তরঢু পরীক্ষার জন্য। এতে কি ধর্মশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রইল? এভাবে ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্বহীন করা হলে বাস্তবে তা অপঠিতই রযে় যাবে। তাতে কি কাক্সিক্ষত নৈতিকতা অর্জন আদৌ সম্ভব হবে? বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ধর্মশিক্ষা কখনোই বোর্ড পরীক্ষার বাইরে ছিল না। সচেতন মানুষের প্রশ্ন, বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রাখলে যদি গুরুত্বহীন না-ই হয়, তাহলে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান কেন বোর্ড পরীক্ষায় রাখতে হবে? শুধু বোর্ড পরীক্ষার বাইরে ছুডে় ফেলেই ক্ষান্ত নয়, ধর্মশিক্ষার ক্লাস-সংখ্যা বা শিখন-ঘণ্টাও অন্যান্য বিষযে়র তুলনায় দারুণভাবে সঙ্কোচন করা হযে়ছে। যেমন- দশম শ্রেণির ধর্মশিক্ষার বাৎসরিক শিখন-ঘণ্টা বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের চেযে় ১০১টি করে কম, বাংলা ও গণিতের ক্লাস ধর্মশিক্ষার চেযে় ৬৭টি বেশি ও ভিনদেশী ভাষা ইংরেজির ক্লাসও ৯০টি বেশি। এমনকি, জীবন ও জীবিকার ক্লাস সংখ্যাও ধর্মশিক্ষার চেযে় ৪৫টি বেশি। উপরন্তু ধর্মশিক্ষাকে রাখা হযে়ছে ‘ভালো থাকা’-এর মতো কিছু আমদানিকৃত নবজাতক সাবজেক্টের সমান্তরালে। এ অবস্থায় ২০০ পৃষ্ঠার ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ক্লাস কার্যক্রম বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন দিযে় বোর্ড পরীক্ষায় না থাকার ক্ষতি পুষিযে় নেয়ার সুযোগটুকুও থাকল না। (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা, পৃষ্ঠা-৯১)
এ ছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন রূপরেখায় ধর্মের কোনো অস্তিত্ব নেই। আছে ‘মূল্যবোধ ও নৈতিকতা’ নামের শিখন ক্ষেত্রের কথা। এতে আদৌ কোনো ধর্মশিক্ষার বই আবশ্যিক ও বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত থাকবে কি না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ২০১২ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রমের ১১নং পৃষ্ঠার উল্লেখ অনুযায়ী, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ছয়টি শাখা রাখা হযে়ছে। বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, ইসলাম শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ও সঙ্গীত। এর মধ্যে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ও সঙ্গীত, এই চার শাখায় ধর্মশিক্ষার কোনো আংশিক বা ঐচ্ছিক পাঠও নেই। শুধু মানবিক শাখার ঐচ্ছিক ১৭টি গুচ্ছ বিষযে়র মধ্যে অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় ইসলাম শিক্ষা রযে়ছে, যা বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়। শুভঙ্করের ফাঁকির আরো সূক্ষ্ম কা- হলো- এইচএসসিতে খোদ ইসলাম শিক্ষা নামেই একটি শাখা রাখা হযে়ছে, যাতে তিনটি আবশ্যিক বিষযে়র একটি হচ্ছে আরবি। মূলত এই শাখাটি কেতাবে থাকা কাজীর গরুর মতো। এ শাখাটি প্রচলিত নেই, এর জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নিযে়াগ দেয়া হয় না; এ বিষয়টির কোনো পাইলটিং তো দূরে থাক, নতুন করে বিষয়টি ওপেন করার অনুমোদনও অঘোষিতভাবে বন্ধ। পারিপার্শ্বিক কারণে এ বিষয়টির চাহিদা প্রকাশেরও সুযোগ নেই। কারণ, প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক আরবি না শিখে একাদশে গিযে় হঠাৎ করে কঠিন আরবি ভাষা ও সাহিত্য পড়া সক্রেটিসের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই এটিকে কার্যকর করার জন্য অবশ্যই যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৯০ শতাংশ মুসলমান তথা শতভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষের এই বাংলাদেশে কোনো সম্প্রদাযে়র শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক এরকম ধর্মশিক্ষাকে অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় রাখা, বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রেখে সঙ্কুচিত ও গুরুত্বহীন করাকে কিছুতেই সমর্থন করে না। যার যার ধর্মশিক্ষা গুরুত্বের সাথে অর্জন করার ব্যবস্থা থাকা প্রত্যেক সম্প্রদাযে়র নাগরিক অধিকার বটে। প্রতিটি রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মশিক্ষার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা রাখে। ইসরাইলের মতো একটি বিতর্কিত-অস্বীকৃত রাষ্ট্র, যাকে সর্বাধুনিক মনে করা হয়, তারা যদি তাদের ধর্মশিক্ষা ‘তালমুদ’ ডিগ্রি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক রাখতে পারে, তাহলে উন্নত দেশ গড়ার জন্য কোন যুক্তিতে আমাদের ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্বহীন করতে হবে? ইতোমধ্যেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ‘ধর্ম আছে, ধর্ম আছে’ বলে এই ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়টি কৌশলে এডি়যে় যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা বরং অভিযোগ তুলছে- জনগণ ধর্মশিক্ষা বিষযে় মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ জুন এনসিটিবি প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার ও শিক্ষাক্রম রূপরেখা বিশেষজ্ঞ গ্রহণযোগ্য আলেমদের সমন্বযে় সংশোধনপূর্বক জনস্বার্থে নিম্নোক্ত দাবিমালা বাস্তবায়নের জন্য ‘ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশ’ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছে।


১. ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, গার্হস্থ অর্থনীতি, সঙ্গীত ও কারিগরিসহ সব শাখায় আবশ্যিক বিষযে়র অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২. দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বোর্ড পরীক্ষায় ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে বহাল রাখতে হবে।
৩. বিতর্কিত, প্রত্যাখ্যাত কুরআনবিরোধী বিবর্তনবাদসহ ইসলামবিরোধী সব পাঠ্য-রচনা সিলেবাস থেকে অপসারণ করতে হবে।
৪. আরব দেশগুলোর শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় এগিযে় থাকার জন্য আরবি ভাষাকে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক করতে হবে। উল্লেখ্য, ভারতের হিন্দু সম্প্রদাযে়র লোকেরাও এ উদ্দেশ্যে আরবি ভাষা শিখে এগিযে় রযে়ছেন। এ পর্যাযে় বোর্ড পরীক্ষায় কেন ধর্মশিক্ষা থাকতেই হবে, তার পক্ষে ১০টি যুক্তি ভেবে দেখুন-
১. আমাদের সংবিধান শুরু হযে়ছে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ তথা সর্বশক্তিমান আল্লাহর নাম দিযে়। ওই সংবিধানের ‘২- ক’ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্ম যেখানে ইসলাম, শিক্ষাব্যবস্থায় সেখানে ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি গুরুত্বহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। তদুপরি ইসলাম শিক্ষা বিষয়টিকে পাবলিক পরীক্ষা থেকে দূরে রেখে সংবিধানকে সমুন্নত রাখা অসম্ভব।
২. জাতীয় শিক্ষানীতির ১১ পৃষ্ঠার বয়ান অনুযায়ী ‘নৈতিকতার মূল উৎস হচ্ছে ধর্ম। সেই ধর্মকে পাবলিক পরীক্ষা থেকে দূরে রেখে কিছুতেই জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন এবং নৈতিক ও আদর্শিক চেতনাসম্পন্ন নাগরিক পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব, যার যার ধর্ম থেকে সর্বোচ্চ নৈতিকতা অর্জনের ব্যবস্থা করা জাতীয় শিক্ষানীতির অনিবার্য দাবি।
৩. বাংলা উইকিপিডিয়ায় ‘বিভিন্ন দেশে ধর্মের গুরুত্ব’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে ‘বিশ্বজুডে় ২০০৯ সালে করা ‘গ্যালাপ জরিপ’ থেকে কৃত গবেষণায় প্রশ্ন করা হযে়ছিল- ‘ধর্ম কি তোমার প্রতিদিনের জীবনে গুরুত্ব বহন করে?’ এর উত্তরের ওপর নির্ভর করে যে তালিকা তৈরি করা হয়, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে ১ শতাংশ অংশগ্রহণকারীও নেতিবাচক উত্তর দেননি। ৯৯ শতাংশ-এর উত্তর ছিল ‘হ্যাঁ, গুরুত্বপূর্ণ।’
৪. বিবিসি বাংলার তথ্য অনুসারে এ দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৯৫ শতাংশ স্কুল-কলেজে পডে়, যার সংখ্যা চার কোটির বেশি। আর গুরুত্বের সাথে ধর্ম পড়ানো না হলে কিছুতেই আমাদের এই বৃহৎ সংখ্যক কোমলমতি সন্তানরা প্রকৃত ইসলামী জীবন ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারবে না। অথচ ‘দ্বীনি জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ’ (বায়হাকি)।
৫. পাবলিক পরীক্ষা তথা বোর্ড পরীক্ষা বহির্র্ভূত কোনো বিষয়কে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক গুরুত্ব দেন না। অতীতের অভিজ্ঞতায় এমনটিই দেখা গেছে। এমতাবস্থায় বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রেখে শুধু ‘শিখনকালীন মূল্যায়ন’ দিযে় ইসলাম শিক্ষার সুফল পাওয়া যাবে না।
৬. ধর্ম নাকি আন-প্রোডাক্টিভ! কারো কারো কাছে এই অভিযোগও শোনা যায়। অথচ চরিত্র গঠনই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। আর চরিত্র গঠনে ধর্মশিক্ষার গুরুত্ব সবচেযে় বেশি।
৭. ৯০ শতাংশ মুসলমান তথা ১০০ শতাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশে জাতীয় ঐক্য গডে় দেশ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষত ও সমুন্নত রাখতে ধর্মশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
৮. মহান আল্লাহ স্বয়ং মহানবী সা.-কে বলেছেন, ‘অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ।’ অথচ মহানবী সা:-এর অনুসারীরা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নবীজীর সা: জীবনাদর্শের সাথে পরিচিত হতে না পারে, সেটি যেকোনো মুসলিমপ্রধান দেশের জন্য বিপজ্জনক।
৯. ইসলাম ও মহানবী সা.-এর জীবনাদর্শ রাষ্ট্রস্বীকৃত উৎস থেকে না শিখতে পারলে আমাদের সন্তানরা সহজেই মিসগাইডেড হযে় ভুল উৎস থেকে ইসলামের অপব্যাখ্যা শিখে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের সাথে জডি়যে় যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রযে়ছে। সাম্প্রতিক ইতিহাস তাই প্রমাণ করেছে।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *