ইসলামী শরীয়তে দোয়া কবুলের রাত শবে বরাত

** পবিত্র শা’বান মাস ফজিলত পূর্ণ মাস সমূহের অন্যতম একটি মাস । এ মাসের মধ্য রজনী হলো পবিত্র শবে বরাত । এ সম্পর্কে কোরআনে পাকে সরাসরি বর্ণনা না থাকলেও অনেক মোফাসসিরীনে কেরাম নিম্নোক্ত আয়াত শরীফ দ্ধারা শবে বরাতের দলিল ছাবিত করেছেন । যেমন, সুরা দুখানে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ . فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ .(سورة الدخان 3 – 4)
অনুবাদঃ নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কোরআন শরীফ নাযিল করেছি একটি বরকতময় রজনীতে ; নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সতর্ককারী । এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয় । (সুরা দুখান ৩-৪)
এ আয়াত শরীফের তাফসীরে মুফাসসিরীনে কিরামগণ দু’টি মত ব্যক্ত করেছেন । প্রায় সব তাফসীরের কিতাবেই তা বর্ণিত হয়েছে । আমি প্রসিদ্ধ কয়েকটি তাফসীরের কথাই উল্লখ করলাম ।
** আল্লামা ইমাম আবু জা’ফর মুহম্মদ ইবনে জরীর আত তাবারী রঃ. (ইন্তেকাল ৩১০ হিঃ) বলেন,
واختُلِف في تلك الليلة ايُّ ليلة من ليال السنة هي، فقال بعضهم- هي ليلة القدر ….. وقال آخرون بل هي ليلة النصف من شعبان. (تفسير الطبري ج ٢١ ص ٥-٦)
অনুবাদঃ লাইলাতুম মোবারাকা নিয়ে উলামায়ে কেরাম এখতেলাফ করেছেন । কেউ বলেছেন কদরের রাত্রি (ইমাম তাবারী এখানে কিছু দলিল দিয়ে বলেছেন এ মতের স্বপক্ষে রয়ছেন হযরত কাতাদাহ ও ইবনে যায়েদ রঃ) । এছাড়া অন্যদের মতে লাইলাতুম মোবারাকা হলো শা’বান মাসের মধ্য রজনী (যেমন এ মতের পক্ষে হলেন হযরত ইকরামা (রঃ) সহ অনেকে ।(তাফসীরে তাবারী ২১/৫,৬)
** আল ইমাম আল হাফিজ আব্দুর রহমান ইবনু মুহম্মদ ইবনু আবি হাতিম আর রাযী রঃ. (ইন্তেকাল ৩২৭ হিঃ) বলেন,
عَنْ عِكْرَمَةَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ قَالَ : فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ يُبْرَمُ أَمْرُ السَّنَةِ، وَيُنْسَخُ الْأَحْيَاءُ مِنَ الْأَمْوَاتِ، وَيُكْتَبُ الحاج فلا يزاد فيهم لا يُنْقَصُ مِنْهُمْ أَحَدٌ. (تفسير القرآن العظيم مسندا عن الرسول الله صلى الله عليه وسلم والصحابة و التابعين . رقم ١٨٥٣١)
অনুবাদঃ হযরত ইকরামা (রঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহ তা’লার বানী ‘এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’। এ আয়াত সম্পর্কে হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন, এ রাত হলো শা’বান মাসের মধ্য রজনী । সারা বৎসরের প্রতিটি বিষয়ের ফয়সালা করা হয় আর যারা এই বছর মৃত্যুবরণ করবে তাদেরকে মৃতব্যক্তিদের তালিকায় ওঠানো হয় । আর যারা হজ্জ পালন করবে তাদের বিষয়টিও লিপিবদ্ধ করা হয় । এতে একজনও কম-বেশ হয়না ।(তাফসীরে ইবনে আবি হাতিম ১৮৫৩১, তাছাড়া প্রায় সব তাফসীরেই এটি বর্ণিত আছে)
** মুহিইয়্যুস সুন্নাহ, আবি মুহম্মদ আল হুসাইন ইবনে মাসউদ আল বাগবী র. (ইন্তেকাল ৫১৬ হিঃ) বলেন,
وَرَوَى أَبُو الضُّحَى عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عنهما : أَنَّ اللَّهَ يَقْضِي الْأَقْضِيَةَ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، وَيُسَلِّمُهَا إِلَى أَرْبَابِهَا فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ.(تفسير البغوي معالم التنزيل ٤ / ١٧٤)
অনুবাদঃ আবুদ দ্বোহা সূত্রে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’লা প্রতিটি বিষয়ের ফয়সালা মধ্য শা’বানের রাতে (শবে বরাতে) করে থাকেন এবং তা শবে কদরে পরিসমাপ্তি (ফাইনাল) হয় ।(তাফসীরে বগবী ৪/১৭৪)
** ইমাম ফখরুদ্দীন আলরাযী রঃ. (ইন্তেকাল ৬০৪ হিঃ)
اختلفوا في هذه الليلة المباركة، فقال الاكثرون انها ليلة القدر، وقال عكرمة وطائفة أخرون انها ليلة البراءة، وهي ليلة النصف من شعبان- (تفسير الكبير ٢٧ / ٢٣٧)
অর্থাৎ, লাইলাতুম মুবারাকাহ নিয়ে উলামায়ে কেরাম মতবিরুধ করেছেন । অধিকাংশের মতে, লাইলাতুম মুবারাকাহ হলো-শবে কদর ।হযর ত ইকরামাহ (রঃ) সহ একদল মুফাসসিরীন বলেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বলতে শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে । আর শবে বরাত হলো শা’বান চাঁদের মধ্য রজনী । (তাফসীরে কবীর ২৭/২৩৭)
** ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আবু বকর আল কুরতুবী রঃ. (ইন্তেকাল ৬৭১ হিঃ) বলেন,
وَاللَّيْلَةُ الْمُبَارَكَةُ لَيْلَةُ الْقَدْرِ. وَيُقَالُ : لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، وَلَهَا أَرْبَعَةُ أَسْمَاءٍ. اللَّيْلَةُ الْمُبَارَكَةُ، وَلَيْلَةُ الْبَرَاءَةِ، وَلَيْلَةُ الصَّكِّ، وَلَيْلَةُ الْقَدْرِ.
ثُمَّ قِيلَ : أُنْزِلَ الْقُرْآنُ كُلُّهُ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ. ثُمَّ أُنْزِلَ نَجْمًا نَجْمًا فِي سَائِرِ الْأَيَّامِ عَلَى حَسْبِ اتِّفَاقِ الْأَسْبَابِ. وَقِيلَ : كَانَ يَنْزِلُ فِي كُلِّ لَيْلَةِ الْقَدْرِ مَا يَنْزِلُ فِي سَائِرِ السَّنَةِ. وَقِيلَ : كَانَ ابْتِدَاءُ الْإِنْزَالِ فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ. (الجامع لأحكام القرآن ج ١٩ ص ٩٩-١٠٠)
অনুবাদঃ আর লাইলাতুম মুবারাকাহ হলো ‘লাইলাতুল কদর’ ।আর এটাকে মধ্য শা’বানের রাত বলা হয়ে থাকে ।আর তার চারটি নাম রয়েছে ।যেমনঃ লাইলাতুম মোবারাকাহ, লাইলাতুল বরাত, লাইলাতুস সাক্ক, ও লাইলাতুল কদর ।অতঃপর কেউ কেউ বলেছেন, পবীত্র কুরআন এ রাতেই দুনিয়ার আকাশে নাজিল হয়েছে ।অতঃপর প্রয়োজনানুপাতে দীর্ঘ্য সময়ে (দয়াল নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট) অবতীর্ণ হয়েছে ।আবার কেউ বলেছেন, (রমাদ্বান মাসের) ক্বদরের রাত্রে সারা বৎসরে যা নাজিল হয়েছে তা (আবার একসাথে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে) নাজিল হ’ত । আবার কেউ বলে থাকেন, শবে ক্বদরে কুরআন শরীফ নাজিল হওয়া শুরু হয়েছে । (আল জামেউ লি আহকামিল কুরআন – কুরতুবী ১৯ / ৯৯-১০০)
** ইমাম জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর আস সুয়ূতী রঃ. (ইন্তেকাল ৯১১ হিঃ) বলেন,
(إنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَة مُبَارَكَة) هِيَ لَيْلَة الْقَدْر أَوْ لَيْلَة النِّصْف مِنْ شَعْبَان نَزَلَ فِيهَا مِنْ أُمّ الْكِتَاب مِنْ السَّمَاء السَّابِعَة إلَى سَمَاء الدُّنْيَا. (جلالين شريف دار إبن كثير ص ٤٩٦)
অনুবাদঃ মোবারক রাত অর্থ হচ্ছে, শবে ক্বদর অথবা মধ্য শা’বানের রাত (শবে বরাত)। যে রাতে কুরআন শরীফ সপ্তম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হয়। (জালালাইন শরীফ ৪৯৬)
** কাজীউল কুজাত আবি সাঊদ মুহম্মদ ইবনে মুহম্মদ আল ইমাদী র. (ইন্তেকাল ৯৫১ হিঃ) বলেন,
وقيلَ يبدأُ في استنساخِ ذلك من اللوحِ في ليلةِ البراءةِ ويقعُ الفراغُ في ليلةِ القدرِ فتدفعُ نسخةُ الأرزاقِ إلى ميكائيلَ ونسخةُ الحروبِ إلى جبريلَ وكذا الزلازلُ والصواعقُ، والخسفُ، ونسخةُ الأعمالِ إلى إسماعيلَ صاحبِ سماءِ الدُّنيا وهُو مَلكٌ عظيمٌ ونسخةُ المصائبِ إلى مَلكِ الموتِ عليهم السَّلامُ. (تفسير الكبير ج ٢٧ ص ٢٤١، تفسير أبي سعود ج ٨ ص ٥٨)
অনুবাদঃ কেউ কেউ বলেছেন, শবে বরাতে পবীত্র কুরআন মজীদ লওহে মাহফুজ থেকে লিখিত ভাবে অবতরণ আরম্ভ হয় এবং শবে ক্বদরে গিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে ।অতঃপর রিযিকের বিষয়ে লিখিত তাখতী মীকাঈল (আঃ) কে দেয়া হয় । যুদ্ধ-বিবাদ বিষয় সম্বলিত তাখতী জিবরাঈল (আঃ)’র উপর ন্যাস্ত করা হয়, অনুরূপ ভূমিকম্প; বিজলীর গর্জন; ও ভূমি ধসে পড়ার বিষয়গুলোর দায়ীত্বও তাকে প্রদান করা হয় । এবং সকল আমলের বিষয় দুনিয়ার আসমানের বিশিষ্ট ফেরেশতা ঈসমাঈল (ঈসরাঈল) (আঃ)’কে প্রদান করা হয় আর তিনি একজন মহান ফেরেশতা ।বিপদ ও মুসিবতের বিষয়গুলো আযরাঈল (আঃ) কে দেয়া হয় । (আফসীরে কবীর ২৭ / ২৪১, তাফসীরে আবি সাঊদ ৮ / ৫৮)
** খাতেমাতুল মুফাসসিরীন, মাওলার রূম, আল্লামা শায়খ ঈসমাঈ হাক্কী রঃ. (ইন্তেকাল ১১৩৭ হিঃ) বলেন,
وقال بعض المفسرين المراد من الليلة المباركة ليلة النصف من شعبان ولها أربعة اسماء الاول الليلة المباركة والثاني ليلة الرحمة والثالث ليلة البراءة والرابع ليلة الصك. (روح البيان ٨ / ٤٠٢)
অনুবাদঃ কিছু সংখ্যক মুফাসসিরীন বলেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শা’বান মাসের মধ্য রজনী । আর তার চারটি নাম রয়েছে । যথাঃ লাইলাতুম মোবারাকাহ, লাইলাতুর রাহমাহ, লাইলাতুল বরাত, এবং লাইলাতুছ ছাক্ক । (রূহুল বয়ান ৮ / ৪০২)
** খাতেমাতুল মুহাক্কিকীন, মুফতীয়ে বাগদাদ, আল্লামা আবুল ফজল শিহাবুদ্দীন আস সাইয়্যিদ মাহমুদ আল আলুসী আল বাগদাদী রঃ. (ইন্তেকাল ১২৭০ হিঃ) বলেন,
وقال عكرمة. وجماعة : هي ليلة النصف من شعبان. وتسمى ليلة الرحمة والليلة المباركة وليلة الصك وليلة البراءة. (تفسير روح المعاني ٢٥ / ١١٠)
অনুবাদঃ আর হযরত ইকরামাহ (রঃ) এবং উনার মতের সপক্ষে এক জামাত মুফাসসিরীন বলেন, (লাইলাতুম মোবারাকাহ) হলো শা’বানের মধ্য রজনী । এ রাতটিকে লাইলাতুর রহমত,লাইলাতুম মোবারাকাহ,লাইলাতুছছাক্ক ও লাইলাতুল বরাত নামে নামকরন করা হয় । (তাফসীরে রূহুল মাআ’নী ২৫ / ১১০)
** ইকরামাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি (ইন্তেকাল ১০৭ হিজরী) কে ছিলেন, যিনি শবে বরাতে কুরআন শরীফ নাজিল হয়েছে বলে অভিমত দিলেন ? আর হ্যাঁ, উনার সম্পর্কেই বলছি । আল্লামা ইবনু কছির (রঃ) বলেন,
عكرمة مَوْلَى ابْنِ عَبَّاسٍ أَحَدُ التَّابِعِينَ، وَالْمُفَسِّرِينَ الْمُكْثِرِينَ والعلماء الربانيين، والرحالين الجوالين . وهو أبو عبد الله، وقد روى عن خلقٍ كثير من الصحابة، وكان أحد أوعية العلم، وقد أفتى في حياة مولاه ابن عباس، قال عكرمة : طلبت العلم أربعين سنة، وقد طاف عكرمة البلاد، ودخل إفريقية واليمن والشام والعراق وخراسان، وبث علمه هنالك، وأخذ الصلات وجوائز الأمراء وقد روى ابن أبي شيبة عنه قال : كان ابن عباس يجعل في رجليَّ الكبل يعلمني القرآن والسنن . (البداية والنهاية ط إحياء التراث. ج ٩ ص ٢٧٢)
অনুবাদঃ ইকরামাহ, তিনি হলেন রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র আযাদ কৃত দাশ (খাদিম), বিশিষ্ট তাবেঈ, মুকসীরীন রাবীগণের মধ্যে বিশিষ্ট মুফাসসীর, আলিমে রব্বানী, পর্যটক ও পরিভ্রাজক । আর তিনি হলেন আবু আব্দুল্লাহ (ইকরামা র. এর উপনাম), তিনি বহু সংখ্যক সাহাবী রিদ্বওয়ানুল্লাহি আলাইহিম গণের নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন । তিনি ইলমে দ্বীনের এক সমৃদ্ধ পাত্র । তাঁর মওলা হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র জীবদ্দশায় (তাঁর নির্দেশক্রমে) তিনি ফতওয়া প্রদান করতেন । হযরত ইকরামাহ (রঃ) বলেন, ‘আমি চল্লিশ বছর ইলম তলব করেছি’ । তিনি দেশে দেশে পরিভ্রমন করেছেন । আফ্রিকা, ইয়ামান, শাম, ইরাক, ও খোরাসানে গমন করেছেন । সেসকল স্থানে তিনি ইলম শিক্ষা দিয়েছেন । এজন্যে সেখানকার নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাঁকে হাদিয়া-তোহফা উপহার দিয়েছেন । {ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, (আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন) উনাদের দাদা উস্তাদ} ইমাম আবু বকর ইবনু আবি শাইবাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন, হযরত ইকরামাহ (রঃ) বলেছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) আমার পায়ে বেড়ী পরিয়ে কুরআন-সুন্নাহ শিক্ষা দিতেন ।
** ইবনে কছির (রঃ) আরোও লিখেছেন,
وقال الشعبي : ما بقي أحدٌ أعلم بكتاب الله من عكرمة . وروى الإمام أحمد عن عبد الصمد عن سلام بن مسكين ، سمعت قتادة يقول : أعلمهم بالتفسير عكرمة . وقال سعيد بن جبير نحوه . (البداية والنهاية ط إحياء التراث. ج ٩ ص ٢٧٢)
অনুবাদঃ ইমাম শা’বী (রঃ) বলেন, কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে হযরত ইকরামাহ (রাঃ)’র চেয়ে অধিক জ্ঞানী কারও অস্তিত্ব নেই । হযরত ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রঃ) আব্দুস সামাদ সূত্রে সালাম ইবনে মিসকিন থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হযরত কাতাদাহ (রঃ)’কে বলতে শুনেছি,তাফসীর সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী হলেন,হযরত ইকরামাহ (রাঃ)। এছাড়া সাঈদ ইবনু জুবায়েরও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন ।
** তিনি আরও লিখেছেন,
وقال عكرمة : قال لي ابن عباس : انطلق فأفتِ الناس فمن سألك عما يعنيه فأفته ، ومن سألك عما لا يعنيه فلا تفته ، فإنك تطرح عني ثلثي مؤنة الناس . (البداية والنهاية ط إحياء التراث. ج ٩ ص ٢٧٣)
অনুবাদঃ হযরত ইকরামাহ (রঃ) বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আমাকে বলেছেন, ‘যাও ! লোকদেরকে ফতওয়া দাও ! যে তোমাকে তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তাকে ফতওয়া দাও । আর যে তোমাকে তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস না করে অন্য বিষয়ে ফতওয়া চাইবে তাকে ফতওয়া দিওনা । (আমি আশা করি,) তুমি আমার দুই-তৃতীয়াংশ বোঝা কমাতে পারবে ।
** এছাড়া ইমাম বুখারী (র.) হযরত ইকরামাহ (র.) সম্পর্কে বলেন,
قَالَ أَبُو عَبْد اللَّه لَيْسَ أحد من أصحابنا إلا احتج بعكرمة.(التاريخ الكبير للبخاري ٧ / ٤٩)
অনুবাদঃ আবু আব্দুল্লাহ (ইমাম বুখারী) বলেন, আমাদের আসহাব বৃন্দ যারা আছেন তাদের সকলের নিকটই ইকরামাহ দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্য । (তারিখুল কবীর ৭ / ৪৯)
এছাড়াও হযরত ইকরামাহ (রঃ) অনেক ছাহাবীর ( দুই শতের উপরে ) সাক্ষাৎ লাভ করেছেন । তিনি জলিলুল কদর তাবেয়ী তাঁর সম্পর্কে লিখতে গেলে আলাদা পরিসরের দরকার, এখানে আমি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম । তাও আবার আবুল ফেদা ঈসমাঈল ইবনু কছির ও ইমাম বুখারী (রঃ) এর ভাষায় । যাতে ভ্রান্তবাদী লা-মাযহাবীরা আওয়াজ করতে পারেনা ।
** উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, অকাট্য দলিল না হলেও ধারনা মূলক ভাবে শবে বরাত কোরআন শরীফ দ্ধারা প্রমাণীত ।
** এছাড়া এটাও প্রমাণীত হলো, শবে বরাত নামে একটি রাত আছে ।
** যদি শবে বরাত না থাকত তাহলে ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’ নিয়ে কোন এখতেলাফ থাকতনা । আর এখতেলাফ হলেও ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’র অর্থ কেউই শবে বরাত বলতেন না; অন্য কোন রাতের কথাই বলতেন ।
** আরেকটি কথা এখানে বলতে হয়, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’ দিয়ে শবে কদর বোঝানো হয়েছে এ উক্তিটি জমহুর মোফাসসিরীনে কেরামের এ কথা সত্য । তাই বলে যারা শবে বরাত বুঝিয়েছেন উনাদের বক্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়ার যোগ্যতা কারোও নেই । সুতরাং কথা-বার্তা সুন্দর করেই বলতে হবে ।
** ছহিহ হাদীস শরীফের ভিত্তিতে শবে বরাতঃ
শবে বরাতের ব্যপারে বর্ণিত হাদীস শরীফের কোন অভাব নেই । শবে বরাত বিষয়ক যেসকল হাদিস শরীফ বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে কোনটি নির্ভেজাল ছহিহ । কোনটি হাসান আবার কোনটি জয়ীফ তবে তাও আমলযোগ্য । যারা বলে থাকেন, শবে বরাতের বিষয়ে বর্ণিত হাদিস শরীফ গুলো জাল কিংবা আমলযোগ্য নয় তারা সুস্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত রয়েছেন । উনারা মুসলমানদের ঈমান আমল নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । সুতরাং মুমিন-মুসলমানদের ঈমান-আমল হেফাজত কল্পে নিম্নে কিছু হাদীস শরীফ তুলে ধরলাম । পাশা-পাশী সনদের সামান্য বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছি শুধু শবে বরাত বিরুধী; মাযহাব বিরুধীদের আত্মস্বীকৃত ইমাম; লা-মাযহাবীদের গুরু নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেবের বক্তব্যের মাধ্যমে । কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় আর কারও বক্তব্য উপস্থাপন করিনি ।
** প্রথম ছহিহ হাদিস শরীফঃ
أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُعَافَى الْعَابِدُ بِصَيْدَا، وَابْنُ قُتَيْبَةَ وَغَيْرُهُ، قَالُوا : حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ خَالِدٍ الْأَزْرَقُ، قَالَ : حَدَّثَنَا أَبُو خُلَيْدٍ عُتْبَةُ بْنُ حَمَّادٍ، عَنِ الْأَوْزَاعِيِّ، وَابْنِ ثَوْبَانَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ مَكْحُولٍ، عَنْ مَالِكِ بْنِ يُخَامِرَ عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : (يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.)
অর্থাৎ, হযরত মুআজ ইবনে জাবাল (রাঃ) হযরত নবিয়ে করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, হুযুর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান, শা’বানের মধ্য রজনী তথা শবে বরাতের রাতে আল্লাহ পাক রব্বুল ইজ্জত তাঁর মাখলুকাতের উপর রহমতের দৃষ্টি দান করে সকলকেই ক্ষমা করে দেন । তবে মুশরিক এবং হিংসুক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন না ।
দলিলঃ-(ছহিহ ইবনে হিব্বান-১২তম জিলদ ৪৮১ পৃষ্ঠা, হাদিস শরীফ নং-৫৬৬৫, মু’জামুল কবির তাবারানী-২০তম জিলদ ১০৮ পৃষ্ঠা, হাদিস শরীফ নং ২১৫, বায়হাকি শুআ’বুল ঈমান-৫ম জিলদ ২৭২ পৃষ্ঠা, হাদিস শরীফ নং-৬৬২৮, ছহিহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব হাদিস শরীফ নং ১০২৬, মাজমাউয যাওয়াইদ- ৮/৬৫, হুলিইয়্যাতুল আউলিয়া-৫/১৯১, শরহে মাওয়াহিবুল লাদু্নিইয়্যাহ-৭/৪১২)
** হাদিস শরীফ খানা যে সম্পূর্ণ ছহিহ এ ব্যপারে নাসিরুদ্দীন আলবানির ভাষ্যঃ
নাসিরুদ্দীন আলবানী তার “সিলসিলাতু আহাদীসিছ ছাহিহাহ” নামক কিতাবের ৩য় জিলদ ১৩৫নং পৃষ্ঠায় বলেছেন,
(يطلع الله تبارك وتعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه، إلا لمشرك أو مشاحن)
حديث صحيح، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعض. وهم معاذ بن جبل، وأبو ثعلبة الخشني، و عبد الله بن عمرو، وابي موسي الأشعري، وابي هريرة، وأبي بكر الصديق، وعوف بن مالك، وعائشة.
অর্থাৎ, يطلع الله تبارك وتعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان হাদিস খানা ছহিহ । যা ছাহাবায়ে কেরামের একটি জামাত উত্তম উত্তম সনদের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন । এখানে একটি হাদিস শরীফ আরেকটি হাদিস শরীফের সনদকে মজবুতের উপর মজবুত করে । যে সকল ছাহাবায়ে কেরাম রিদ্বওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন এ হাদিস শরীফ খানা বর্ণনা করেছেন উনাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, হযরত মুআ’য বিন জাবাল, হযরত আবু ছা’লাবা আল-খুশানী, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আমর, হযরত আবু মুসা আল-আশআ’রী, হযরত আবু হুরায়রা, হযরত আবু বাকর ছিদ্দিক, হযরত আউফ বিন মালিক, হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহুম আজমাঈন । (সিলসিলাতু আহাদীসিছ ছাহিহাহ ০৩ / ১৩৫)
** দ্বিতীয় ছহিহ হাদিসঃ
حَدَّثَنَا حَسَنٌ ، حَدَّثَنَا ابْنُ لَهِيعَةَ ، حَدَّثَنَا حُيَيُّ بْنُ عَبْدِ اللهِ ، عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْحُبُلِيِّ ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : يَطَّلِعُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى خَلْقِهِ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِعِبَادِهِ إِلَّا لِاثْنَيْنِ : مُشَاحِنٍ، وَقَاتِلِ نَفْسٍ .
অনুবাদঃ বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) হতে বর্নিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, শা’বানের মধ্য রজনীতে আল্লাহ তা’লা স্বীয় সৃষ্টি জগতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দান করেন । সকলকে ক্ষমা করে দেন তবে দুই ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না । তারা হলো-‘হিংসুক আর অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যাকারী ব্যক্তি । (মুসনাদে আহমদ হাদিস নং ৬৬৪২)
মুহাদ্দিসীনে কেরাম উক্ত হাদিস শরীফকে ছহিহ বলেছেন । তবে এ হাদিস শরীফের সনদে ইবনে লাহিআ’হ নামে একজন রাবী রয়েছেন যিনি অধিকাংশ মুহাদ্দিসের নিকট দূর্বল । কিন্তু তার পরেও উক্ত হাদিস শরীফ ছহিহ । কেননা হাদিস শরীফ খানার সনদে ইবনে লাহিআ’হ এর মুতাবে’ হিসাবে রিশদীন ইবনে সা’দ নামে একজন রাবী রয়েছেন যিনি সকলের নিকট গ্রহনযোগ্য ।
** হাদিস শরীফ খানা যে সম্পূর্ণ ছহিহ এ ব্যপারে নাসিরুদ্দীন আলবানির ভাষ্যঃ
قلت : وهذا إسناد لا بأس به في المتابعات والشواهد ، قال الهيثمي : وابن لهيعة لين الحديث وبقية رجاله وثقوا. وقال الحافظ المنذري : وإسناده لين . قلت : لكن تابعه رشدين بن سعد بن حيي به . أخرجه ابن حيويه في حديثه . فالحديث حسن . (سلسلة الأحاديث الصحيحة ج ٣ ص ٣٣٦)
অনুবাদঃ আমি বলি, মোতাবে’ এবং শাওয়াহেদ বিদ্যমান থাকায় উক্ত হাদিস শরীফ খানার সনদে কোন সমস্য বিদ্যমান নেই । ইমাম হায়সামী (রঃ) বলেন, সনদে ইবনে লাহিআ’হ হাদিস বর্ননায় দূর্বল আর বাকি সবাই সিক্বাহ । আর হাফিজ আল মুনজিরী বলেন, সনদে দূর্বলতা আছে । এ ক্ষেত্রে আমি (আলবানী) বলি, (ইবনে লাহিআ’হ এর জন্য দূর্বলতা থাকলেও) এখানে তার তাবে হিসাবে রিশদীন ইবনে সা’দ রয়েছেন । ইবনে হাইয়্যাওয়াইহ তার বর্ণিত হাদিসে তা উল্লেখ করেছেন । সুতরাং হাদিসটি হাসান (ছহিহ) । (সিলসিলাতুল আহাদীসিছ ছহিহাহ ৩ / ৩৩৬)
** তৃতীয় ছহিহ হাদিসঃ
وأَخْبَرَنَا أَبُو الْحُسَيْنِ بْنُ الْفَضْلِ الْقَطَّانُ ، بِبَغْدَادَ ، أخبرنا أَبُو سَهْلِ بْنِ زِيَادٍ الْقَطَّانُ ، حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ الْحَسَنِ الْحَرْبِيُّ ، حَدَّثَنَا عَفَّانُ ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَاحِدِ بْنُ زِيَادٍ ، عَنِ الْحَجَّاجِ ، عَنْ مَكْحُولٍ ، عَنْ كَثِيرِ بْنِ مُرَّةَ الْحَضْرَمِيِّ : عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قال : فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ يَغْفِرُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لِأَهْلِ الْأَرْضِ إِلَّا الْمُشْرِكَ وَالْمُشَاحِنَ .
অনুবাদঃ প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হযরত কাছির ইবনে মুররাহ আলহাদ্বরামী(রঃ)মুরসাল সূত্রে দয়াল নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, শা’বানের মধ্য রজনীতে আল্লাহ পাক পৃথিবীর সকল বাসিন্দাকে ক্ষমা করে দেন কিন্ত মুশরিক কিংবা হিংসুক ব্যক্তিদেরকে ক্ষমা করেন না।
(মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক – ৪ / ৩১৬, হাদিস নং ৭৯২৩, শুআ’বুল ঈমান বায়হাকি ৩ / ৩৮১, হাদিস নং ৩৮৩১, ছহিহ আল জামে’ আলবানী-হাদিস নং ৪২৬৮)
এখানেও নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেব হাদিস শরীফ খানা ছহিহ বলেছেন । দেখুন তার লিখিত ছহিহ আল জামেউস সগীর
** সনদের দিক থেকে গ্রহণ যোগ্য আরেকটি হাদিস শরীফঃ
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ مَنِيعٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، قَالَ: أَخْبَرَنَا الحَجَّاجُ بْنُ أَرْطَاةَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ عُرْوَةَ، عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: فَقَدْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً فَخَرَجْتُ، فَإِذَا هُوَ بِالبَقِيعِ، فَقَالَ: أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ، فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ. (سنن الترمذي ت الأرنؤوط رقم ٧٤٩، ت بشار رقم ٧٣٩)
অনুবাদঃ আম্মাজান হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রসূলে খোদা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হারিয়ে ফেললাম (বিছানায় পেলাম না)। আমি (তাঁর সন্ধানে) বের হলাম । আমি দেখলাম তিনি জান্নাতুল বাকীতে আছেন । তিনি বলেনঃ তুমি কি ভয় করছ আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার প্রতি কোন অবিচার করবেন ? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি মনে করেছিলাম, আপনি আপনার অন্য কোন বিবির নিকটে গিয়েছেন । তিনি বললেনঃ আল্লাহ তাআ’লা মধ্য শা’বানে (১৫ তারিখের রাতে) দুনিয়ার কাছের আকাশে অবতীর্ণ হন । তারপর কালব গোত্রের বকরী পালের লোমের চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে তিনি মাফ করে দেন ।(তিরমিযী শরীফ হাদিস নাম্বার ৭৩৯ / ৭৪৯, এছাড়া আরো অনেক কিতাবে এ হাদিস আছে ।
উক্ত হাদিস শরীফ বর্ণনা করে ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেন,
وَفِي البَابِ عَنْ أَبِي بَكرٍ الصِّدِّيقِ. حَدِيثُ عَائِشَةَ، لاَ نَعْرِفُهُ إِلاَّ مِنْ هَذَا الوَجْهِ مِنْ حَدِيثِ الحَجَّاجِ، وَسَمِعْتُ مُحَمَّدًا يُضَعِّفُ هَذَا الحَدِيثَ. وقَالَ يَحْيَى بْنُ أَبِي كَثِيرٍ لَمْ يَسْمَعْ مِنْ عُرْوَةَ، وَالحَجَّاجُ بْنُ أَرْطَاةَ لَمْ يَسْمَعْ مِنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ.
অনুবাদঃ এই অনুচ্ছেদে আবূ বাকর সিদীক (রাঃ) হতেও হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা বলেন, হাজ্জাজের বরাতে এই সূত্রটি ব্যতীত অন্য কোন সূত্রে আইশা (রাঃ)-এর হাদীসটি প্রসঙ্গে আমরা কিছুই অবগত নই। আমি মুহাম্মাদ আল-বুখারীকে উল্লেখিত হাদীসকে দুর্বল বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, রাবী ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীর উরওয়া (রহঃ) হতে কোন হাদীস শুনেননি। মুহাম্মাদ আল-বুখারী আরও বলেন, এমনিভাবে হাজ্জাজও ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীরের নিকট হতে কিছুই শুনেননি।
এখানেও অতিরিক্ত কথা না বলে আলবানী সাহেবের সেই উক্তিটিই পেশ করি যেখানে তিনি বলেছেন,
وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب والصحة تثبت بأقل منها
عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث ، فما نقله
الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في “إصلاح المساجد” (ص ١٠٧) عن أهل التعديل
والتجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح ، فليس مما ينبغي
الاعتماد عليه ، ولئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول فإنما أوتي من قبل التسرع وعدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديك . والله تعالى هو الموفق .
অর্থাৎ, শবে বরাত সম্পর্কীয় হাদীসের ক্ষেত্রে সার কথা হলো, শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো সমষ্টিগত ভাবে নিঃসন্দেহে ‘সহীহ’ । হাদীস অত্যধিক দুর্বল না হলে আরো কমসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদীস ছহিহ হিসেবে গণ্য হয় । (হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত) এই হাদীসের মানও তা-ই । অতএব শায়খ কাসেমী রাহিমাহুল্লাহ কতিপয় হাদীস বিশারদের উদ্ধৃতিতে তার রচিত কিতাব ইসলাহুল মাসাজিদের ১০৭ নং পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন (শবে বরাতের ফজিলত বর্ণনায় কোনো ছহিহ হাদীস নেই) তার এই কথার ওপর আস্থা রাখা মোটেও উচিত হবে না । তার পরেও কেউ যদি এ ধরনের কথার উপর ভিত্তি করে (শবে বরাত নেই কিংবা এ সম্পর্কে বর্ণিত সব হাদিস ভিত্তিহীন বলে) মত প্রকাশ করে তাহলে বুঝতে হবে সে তার একচোখা স্বভাব এবং হাদীসের বিভিন্ন সূত্র সম্পর্কে অক্ষমতা কিংবা অজ্ঞতার কারণেই এমনটি বলেছে । আল্লাহ তা’আলাই প্রকৃত তাওফীক দাতা । (সিলসিলাতুস সহীহা ৩/১৩৮-১৩৯)
এখানে মজার বিষয় হলো-লা-মাযহাবী, সালাফী, মতিউর রহমান নজদী ও টাই মলভীরা আম্মাজান হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস শরীফটিকে জাল-জয়ীফ বলে একেবারেই উড়িয়ে দেয় । কিন্তু তাদের সকলের গুরু এই নাসির উদ্দীন আলবানী সাহেব আম্মাজান হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস শরীফটি সম্পর্কে উপরুক্ত কথাগুলো বললেন ।
** শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীস শরীফ বর্ণনাকারী ছাহাবায়ে কেরামঃ
০১.সাইয়্যদুনা হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রদিয়াল্লাহু আনহু।
০২.সাইয়্যদুনা হযরত আলী রদিয়াল্লাহু আনহু।
০৩.আম্মাজান হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রদিয়াল্লাহু আনহা।
০৪.হযরত আবু হুরাইয়রা রদিয়াল্লাহু আনহু।
০৫.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদিয়াল্লাহু আনহু।
০৬.হযরত মুআয বিন জাবাল রদিয়াল্লাহু আনহু।
০৭.হযরত আবু মুসা আশআরি রদিয়াল্লাহু আনহু।
০৮.হযরত আবু ছা’লাবা রদিয়াল্লাহু আনহু।
০৯.হযরত আউফ বিন মালিক রদিয়াল্লাহু আনহু।
১০.হযরত কাসির বিন মুররাহ রদিয়াল্লাহু আনহু।
১১.হযরত উসমান ইবনে আবুল আস রদিয়াল্লাহু আনহু সহ প্রমূখ ছাহাবায়ে কেরাম।
** যারা বলে থাকেন শবে বরাত সম্পর্কে কোন ছহিহ হাদিস নেই উনাদের জবাব উপরে বর্ণিত আলোচনাতে বিস্তারিত বিদ্যমান আছে । কিন্ত তার পরেও উনাদেরকে বলতে চাই, উনারা কি উসূলে হাদীস ছাড়াই হাদীস শরীফ পড়ে ?
পাঠক! উসূল হলো- একই বিষয়ে একাধিক জয়ীফ হাদীস পাওয়া গেলে এটা আর জয়ীফ থাকেনা ছহীহ’র (হাসান) দরজা লাভ করে । আর আমলের ক্ষেত্রে জয়ীফ হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
** জয়ীফ হাদিস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনে কেরামের বক্তব্যঃ
০১. ইমাম নববী (রঃ) এর বক্তব্যঃ
قال الامام نووي رح، قد اتفق العلماء علي جواز الاعمال بالحديث الضعيف في فضائل الاعمال.
অর্থাৎ, “ইমাম নববী(রঃ)(তার লিখিত কিতাব শরহুল মুসলিমে)বলেছেন, ফজিলতপূর্ণ আমলের জন্য জয়ীফ সনদ যুক্ত হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহন করা বৈধ এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন”।(শরহুল আরবাঈন ১/২০)
০২. ইমাম জালালুদ্দী সুয়ূতী (রঃ) এর বক্তব্যঃ
قال الامام جلال الدين السيوطي، انهم اجمعوا علي جواز العمل بالحديث الضعيف في فضائل الاعمال.
অর্থাৎ, “ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রঃ) বলেন, ফজিলতপূর্ণ আমলের জন্য জয়ীফ সনদ যুক্ত হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহন করা বৈধ এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামগণের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে”।(হাশিয়া ইবনে মাজাহ باب ما جاء في التفليس )
০৩. ইমাম শকানী (রঃ) এর বক্তব্যঃ
قال الامام شوكاني، في كتابه ب نيل الاوطار- لا سيما في فضائل الاعمال.
অর্থাৎ, “ইমাম শওকানী তার লিখিত নাইলুল আওতারে বলেছেন, বিশেষ করে (জয়ীফ সনদ যুক্ত হাদিস) ফজিলতপূর্ণ আমলের জন্য দলিল হিসেবে যথেষ্ট”।
সুতরাং নির্দিধায় বলা যায়, শবে বরাত সম্পর্কিত জয়ীফ হাদিস শরীফ গুলো পরিত্যাজ্য নয়; বরং আমলযোগ্য ।
** মক্কাবাসীদের আমলঃ
সৌদির দাম্মাম কিংবা অন্য কোথাও বসে যারা শবে বরাত বিরুধী বক্তব্য দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি পয়দা করছেন তাদের জন্য সৌদিয়ানদের আমল খুব বড় দলিল (আবার মতের বিপক্ষে হলে সাথে সাথে মিথ্যা ও বানোওয়াট ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে) । তাদের জন্য এবং বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের সাধারন মুসলমানদের আমল হেফাজত কল্পে সামান্য একটা নযীর নিম্নে পেশ করলাম ।
তাবেয়ী যোগের প্রখ্যাত আলেম ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনুল আব্বাস আল ফাকেহী আল মাক্কী (রঃ) এর লিখিত একটি কিতাবের নাম – “আখবারু মাক্কাহ লি ক্বাদিমিদ দাহরি ওয়া হাদিসিহি” । উক্ত কিতাবের ৩য় জিলদের ৮৪ নং পৃষ্ঠার একটি বাবের নাম হলো – ذكر عمل أهل مكة ليلة النصف من شعبان واجتهادهم فيها لفضلها ‘মক্কার অধিবাসীদের শবানের মধ্য রজনীর আমল ও এর ফজিলত অর্জনের লক্ষে তাদের প্রচেস্টা’। এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে তিনি প্রথমেই বলেছেন,
وأهل مكة فيما مضى إلى اليوم إذا كان ليلةُ النصف من شعبان ، خرج عامة الرجال والنساء إلى المسجد ، فصلوا ، وطافوا ، وأحيوا ليلتَهم حتى الصباح بالقراءة في المسجد الحرام ، حتى يختموا القرآن كله ، ويصلوا ، ومن صلى منهم تلك الليلة مائة ركعة يقرأ في كل ركعة بـ الحمد ، و قل هو الله أحد عشر مرات ، وأخذوا من ماء زمزم تلك الليلة ، فشربوه ، واغتسلوا به ، وخبؤوه عندهم للمرضى ، يبتغون بذلك البركة في هذه الليلة ، ويُروى فيه أحاديث كثيرة. (أخبار مكة في قديم الدهر و حديثه ج ٣ ص ٨٤)
অনুবাদঃ শবে বরাত আসলে অতীত কাল থেকেই মক্কার নারী-পুরুষ মসজিদে হারামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন । তারা নামায আদায় করতেন এবং কাবা শরীফ তাওয়াফ করতেন । তারা সারা রাত্রি সকাল পর্যন্ত জাগ্রত থেকে কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের মাধ্যমে কাটিয়ে দিতেন, এমনকি সম্পুর্ণ কুরআন শরীফ খতম হয়ে যেত । তারা নামায আদায় করতেন আবার অনেকে ১০০ রাকাত নামায আদায় করতেন যাতে প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহার সাথে ১০ বার করে সূরা এখলাস পড়তেন । এ রাতে তারা (সওয়াব মনে করে) যমযমের পানি পান করতেন এমনকি এই পবিত্র পানি দিয়ে তারা এ রাতে গোসলও করতেন । এবং পিড়ীতদের খবরা-খবর নিতেন । এ রাতে এসব কাজ গুলো তারা বরকত হাসিলের নিয়তেই করে থাকতেন ।আর এসব বিষয়ে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে ।
** হালওয়া-রুটি পাকানোঃ
লা-মাযহাবীদের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেওবন্দী ভাইগণ এদিনে অর্থাৎ শবে বরাতের আগে বা পরে শবে বরাত উপলক্ষে হালওয়া-রুটি কিংবা খানা খাওয়ানো অর্থাৎ শিরণী বিতরনের মাধ্যমে মুর্দেগানদের ঈসালে সওয়াব করা (ঐচ্ছিক) নিয়ে কথা-বার্তা বলে থাকেন । এ বিষয়ে আমি খুব একটা দলিল দেয়া জরুরী মনে করিনা শুধু থানবী সাহেবের একটি উক্তিই পেশ করলাম ।
اگر کچہ صدقہ خیرات یا کہانا وغیرہ بہی پکاکر بخش دیا جاوے کوئی مضائقہ نہیں ۔ (سال بهر كے مسنون اعمال . ص ١٧)
অনুবাদঃ (শবে বরাত উপলক্ষে) ছদকাহ খয়রাত অথবা খাবার দাবার কিংবা অন্য কোন কিছু পাকিয়ে (মুর্দেগানের ঈসালে সওয়াব হিসাবে) বখশানোতে কোন অসুবিধা নেই।(যাওয়ালুস সিনাহ আন আ’মালিস সানাহ বা সাল বহর কে মসনুন আ’মাল, পৃষ্ঠা ১৭)।
** শবে বরাতের করণীয় / বর্জনীয়ঃ
এ রাতে আমাদের অনেক গুলো করণীয় ও বর্জনীয় আছে । নিম্নে সংক্ষেপে উল্লেখ করলাম ।
০১. নেক আমলের মাধ্যমে বেশী বেশী দোয়া করা ।
০২. নিকটবর্তী কবর যিয়ারত করা ।
০৩. ফরজ নামাযের পাশা-পাশি নফল নামায, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির আযকার ইত্যাদির মাধ্যমে রাত কাটানো ।
০৪. সদকাহ খয়রাত কিংবা অন্যকে খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে অথবা শরীয়ত সম্মত অন্য যে কোন পন্থায় মুর্দেগানদের ঈসালে সওয়াব করাতে কোন অসুবিধা নেই বরং তা আমাদের কর্তব্য ।
০৫. মীলাদ মাহফীল করাতে কোন অসুবিধা নেই বরং তা করা দরকারও বটে ।
০৬. অন্যের অসুবিধা হয় এমন ভাবে উচ্চ আওয়াজে কোন কিছু না করা ।
০৭. এ রাতকে বাত্তির রাত না বলা ।
০৮. রাস্তায় রাস্তায় কিংবা কবরে অযথা বাতি না জালানো ।
০৯. আতশ কিংবা ফটকাবাজী না করা ।
১০. মসজিদ কিংবা বাড়ী ঘরে আলোকসজ্জা না করা ।
১১. মাজারে মাজারে চক্কর না দিয়ে ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে জাগ্রত থাকা ।
মহান আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে কবুল করে নেন । আমিন !!

Comments

comments

About

Check Also

শবেবরাতের ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ হাদীস: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

মহিমান্বিত মাহে রাজাব শেষ হবার পথে। সামনে আসছে মাহে শাবান। শাবানের মধ্যবর্তী রাত হচ্ছে একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *