সুস্পষ্ট দলীল থাকার পর শবে বরাত অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই !

১৪ই শা’বান দিবাগত রাতটি হচ্ছে পবিত্র শবে বরাত বা বরাতের রাত্র। কিন্তু অনেকে বলে থাকে কোরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এর কোথাও শবে বরাত বলে কোনো শব্দ নেই। শবে বরাত বিরোধীদের এরূপ জিহালতপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে বলতে হয় যে, শবে বরাত শব্দ দু’টি যেরূপ কোরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এর কোথাও নেই তদ্রূপ নামায, রোযা, খোদা, ফেরেশতা, পীর ইত্যাদি শব্দ কোরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এর কোথাও নেই। এখন শবে বরাত বিরোধী লোকেরা কি নামায, রোযা ইত্যাদি শব্দ কোরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এ না থাকার কারনে ছেড়ে দিবে ? খোদা, ফেরেশতা ইত্যাদি শব্দ কোরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এ না থাকার কারনে মহান আল্লাহ পাক ও ফেরেশতাদেরকে অস্বীকার করবে ? যা আছে তা হলো, রব, মালাইকা, সালাত, সওম ইত্যাদি এবং শবে বরাত শব্দটি কোরআন এবং হাদীস শরীফে এসেছে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শ’বান। এছাড়া এ রাতের অন্যন্য নাম হচ্ছে ‘লাইলাতুর রাহমাহ’ ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এবং ‘লাইলাতুল সাক’।
মূলত শবে বরাত, নামায, রোযা, খোদা, ফেরেশতা, পীর ইত্যাদি ফার্সী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত। ফার্সী শব অর্থ রাত্রি এবং বরাত অর্থ ভাগ্য বা মুক্তি। সুতরাং শবে বরাত মানে হল ভাগ্য রজনী বা মুক্তির রাত।

কোরআন শরীফ থেকে লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান তথা শবে বরাত এর দলীলঃ

কোরআন শরীফের সূরা দুখান (পারা ২৫, সূরা ৪৪, আয়াত- ৩-৪) উল্লেখিত আয়াত,
‎إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةٍ مُّبَٰرَكَةٍ এবং فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

অর্থাৎঃ ‘আমি এ কোরআন বারাকাতপূর্ণ রাতে নাযিল করেছি।’ ‘এরাতেই সকল প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’

এ দু আয়াতের তাফসীর নিয়ে মুফাসসিরীনে কিরামের মধ্যে ইখতিলাফ (মতবিরোধ) বিদ্যমান রয়েছে। 
মতবিরোধপূর্ণ এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ে কোন কোন লিখক এবং বক্তা শবে বরাতের যেকোনো ফযীলত অস্বীকার করেন। এমনকি তাঁরা এতটুকু পর্যন্ত বলেন যে, শবে বরাত বলতে কিছু নেই। এসব ব্রাক্ষণ্যবাদী ও পারসিয়ান কালচার থেকে আমদানিকৃত। আমরা বিভিন্ন যুগে প্রণীত তাফসীরের প্রামাণ্য কিতাবাদীর উদ্বৃতি আলোচনা করে দেখবো যে, মুফাসসিরীনে কিরাম কোন বিষয় মতবিরোধ করেছেন। তাঁরা কি শবে বরাতের ফযীলত অস্বীকার করেছেন ? এ আয়াতের তাফসীরে তাঁরা কী বলেছেন যে, শবে বরাত বলতে কিছু নেই ? তাছাড়া শ্বে বরাত কি ব্রাক্ষণ্যবাদী এবং পারসিয়ান কালচার থেকে আমদানিকৃত ? 
৩১০ হিজরী থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রায় ১৮জন মুফাসিরিনে কিরামের রচিত তাফসীরের কিতাবাদী থেকে কয়েকজনের উদ্বৃতি তুলে ধরবো লিখা সংক্ষেপের জন্য, এবং বাকি মুফাসসিরীনে কিরামদের নাম উল্লেখ করবো।

ইমাম তাবারী (ওফাত ৩১০ হিজরী) 
ইমাম তাবারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থে এ বিষয়ে বলেন: এটি বছরের কোন কোন রাত তা নিয়ে মুফাসসিরীনের মধ্যে ইখতিলাফ বিদ্যমান। অনেকে বলেছেন, সেটি শবেকদর। অন্যেরা বলেছেন, সেটি শবেবরাত। যারা শবেকদরের পক্ষে তাদের মতটিই বিশুদ্ধ।
(তাফসীরে তাবারী ১১:২২)

ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (ওফাত ৬০৪ হিজরী) 
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ বিষয়ে বলেন: পঞ্চম মাসআলা : বারাকাতপূর্ণ রাত কোনটি তা নিয়ে মুফাসসিরীনে কিরামের মধ্যে ইখতিলাফ বিদ্যমান রয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন, সেটি শবেকদর। আর হযরত ইকরিমাসহ কতিপয় বলেছেন, সেটি শবেবরাত। তা হলাে মধ্য শাবানের রাত।
(তাফসীরে কাবীর ৯:২১৪)

মাওলানা মুহাম্মদ আমীনুল ইসলাম (জ. ১৯৩২ খৃষ্টাব্দ)
বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন, রেডিও বাংলাদেশ এর নিয়মিত তাফসীরকার, বহুগ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা মুহাম্মদ আমীনুল ইসলাম স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে (৩০ খণ্ডে সমাপ্ত) এ বিষয়ে বলেন, মােবারক রজনী কোনটি ? এ সম্পর্কে অধিকাংশ তাফসীরকার বলেছেন, এটি হলো শবে কদর। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), তাফসীরকারক কাতাদা (রাঃ), ইবনে জোবায়ের (রাঃ), ইবনে মুজাহেদ (রাঃ), ইবনে জায়েদ (রাঃ) এবং হাসান বসরী (রহঃ) প্রমুখ তাফসীরকারগণ এ মত পোষণ করতেন। আর তাফসীরকার একরামা (র.) এবং আরাে অন্যান্য তাফসীরকারগণ বলেছেন, এটি হলাে শবেবরাত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর আরেকটি বিবরণ দ্বারা জানা যায় যে, তকদীরের সিদ্ধান্ত শবেবরাতে গৃহীত হয়, তবে সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের নিকট লাইলাতুল কদরে তা কার্যকর করার আগত অর্পণ করা হয়। আর যারা মনে করেন, লাইলাতুল মােবারাকা দ্বারা লাইলাতুল বরাআতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, তারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। (তাফসীরে নুরুল কোরআন ২৫:২২৯-২৩১)

এছাড়া বাকি মুফাসসিরীনে কিরামদের নাম হলোঃ ইমাম বাগাওয়ী (রহঃ) (ওফাত ৫১৬ হিজরী), ইমাম জমাখশারী (রহঃ) (ওফাত ৫৩৮ হিজরী), ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (ওফাত ৬১৭ হিজরী), ইমাম নাসাফী (রহঃ) (ওফাত ৭১০ হিজরী), ইমাম খাযিন (রহঃ) (ওফাত ৭২৫ হিজরী), ইমাম বাইদওয়ী (রহঃ) (ওফাত ৭৯১ হিজরী), ইমাম আৰু হাইয়ান আন্দালুসী (রহঃ) (ওফাত ৭৯১ হিজরী), ইমাম ইবনু কাছীর (রহঃ) (ওফাত ৭৭৪ হিজরী), ইমাম নিশাপুরী (রহঃ) (ওফাত ৭২৮ হিজরী), ইমাম ইসমাঈল হাক্কী (রহঃ) (ওফাত ১১৩৭ হিজরী), ইমাম আলুসী (রহঃ) (ওফাত ১২৭০ হিজরী), কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী (রহঃ) (ওফাত ১২২৫ হিজরী), শায়খ আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) (ওফাত ১৩৬২ হিজরী), মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহঃ) (ওফাত ১৩৯৬ হিজরী), মাওলানা মুহাম্মদ তাহের প্রমুখ।

একজন মুফাসসিরও শবে বরাতের ফযীলতকে অস্বীকার করেননিঃ
উপরের আলােচনায় এটা পরিষ্কার যে, মুফাসসিরগণের মতপার্থক্যের মূল কথা হলাে- কোরআন শরীফ নাযিল শবেকদরে হয়েছে নাকি শবেবরাতে ? তাঁরা শবে বরাত আছে কি নেই তা নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বরং অধিকাংশ তাফসীরগ্রন্থ পাঠে আমরা দেখি যে, শবে বরাতের ফযীলতে বর্ণিত হাদীস সমূহ আলােচিত হয়েছে। শবে বরাত বলতে কোন কিছু নেই, শবে বরাতের কোনই ফযীলত নেই এমন দাবী কোন একজন মুফাসসিরও করেননি। তা ছাড়া কোন একজন মুফাসসিরও এমন কথা বলেননি যে, শবে বরাত ব্রাহ্মণ্যবাদী বা পারসিয়ান কালচার থেকে আমদানীকৃত।
এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের মুফাসসিরীনের মধ্যে ইন্ডিয়ার কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী, শায়খ
থানবী, মাওলানা মুহাম্মাদ তাহের, পাকিস্তানের মুফতী মুহাম্মাদ শফী, বাংলাদেশের মাওলানা মুহাম্মদ আমীনুল ইসলাম এর তাফসীরগ্রন্থে তারাও এ কথা বলেন নি যে, আমাদের এ উপমহাদেশে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদী কালচার থেকে শবেবরাত আমদানী করা হয়েছে।

বর্তমান সময়ে যারা তাদের বক্তব্য এবং লেখনীতে তাফসীরের কিতাবাদীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চান যে, শবেবরাত বলতে কিছু নেই কিংবা শবেবরাতের কোনই ফযীলত নেই এটা হয়তাে কিতাবের মূল পাঠ না বুঝার কারণে করেন, অথবা সালাফী নামধারী মাযহাব অমান্যকারীদের ভ্রান্ত পথ ও মতকে প্রতিষ্ঠার জন্যই করেন।

হাদীস শরীফ থেকে লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান তথা শবে বরাত এর দলীলঃ

শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসের ইমামগণ স্ব স্ব কিতাৰে বিস্তারিত সনদসহ সেসব হাদীস উল্লেখ করেছেন। বর্তমান সময়ে অনেকে বলেন যে, এসব হাদীসের সনদ দাঈফ (দুর্বল), তাই এগুলাের উপর আমল করা যায় না।
আমরা প্রথমে শবেবরাতের ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহ উদ্ধত করবাে। সাথে সাথে যেসব কিতাবে এ হাদীস আছে নাম উল্লেখ করতঃ প্রতিটি হাদীসের সনদ পর্যালােচনা করে দেখবাে যে, সনদের দিক থেকে হাদীসটি কোন পর্যায়ের। এতে যারা বলেন শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত সবকটি হাদীস দাঈফ (দুর্বল) এবং মাউদু (জাল) তাদের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হবে।

প্রথম হাদীসঃ হযরত মুআয বিন জাবাল (রাঃ) নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন যে, মধ্য শাবানের রাতে (শবে বরাতে) আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের নজরে তাকান। এবং মুশরিক ও অন্যের প্রতি হিংসা পােষণকারী ছাড়া কুলমাখলুককে ক্ষমা করে দেন।

দলীলঃ ইমাম ইবনু হিব্বান- সহীহ ইবনু হিব্বান (অখন্ড) পৃষ্ঠা ১৫১৪, শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী- সিলসিলাতুল আহাদিসস সাহীহাহ ৩:১৩৫, এছাড়া আরো ২৩টি কিতাবে এ হাদীস এসেছে।

প্রথম হাদীসের সনদ পর্যালোচনা-
সালাফীগণের কাছে ইলমে হাদীসের জারাহ ও তা’দীল (হাদীস বর্ণনাকারীগণের দোষ গুণ বর্ণনা) বিষয়ে ইমাম হিসেবে স্বীকৃত শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (ওফাত ১৪২০ হিজরী) স্বীয় কতাবে এ হাদীস উল্লেখ করে (হাদীস নং ১১৪৪) বলেন- 
হাদীসটি সহীহ। সাহাবীগণের একটি জামাত থেকে এ হাদীসটি বিভিন্ন সনদসূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যার একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করেছে।
শায়খ আলবানী এ হাদীসের সনদের উপর দীর্ঘ আলােচনা শেষে বলেছেন- সারকথা হলাে – বিভিন্ন সনদসূত্রে বর্ণিত হাদীসটি নিঃসন্দেহে সাহীহ। 
দলীলঃ সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহাহ ৩:১৩৬, ১৩৮।

ড . সায়্যিদ মাহমূদ এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে বলেন-
ইবনে হিব্বান এ হাদীসকে সাহীহ বলেছেন। হাফিয মুনযিরী, ইমাম হাইছামী এবং আল্লামা ইবনুল ওয়াযির হাদীসটিকে সাহীহ কিংবা হাসান বলেছেন। ইমাম বাইহাকী বলেন , এ হাদীসের ভিত্তি রয়েছে। আল্লামা ইবনু হাজার হাইতামী যাওয়াজির ‘ নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই সনদ গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই।
দলীলঃ লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান, পৃষ্ঠা ৭২।

নোটঃ বিভিন্ন যুগে নানা দেশের ইমাম ও আলিমগণের কিতাবে শবে বরাতের ফযীলত প্রসঙ্গে উল্লিখিত সাহাবী মু’আয বিন জাবাল (রাঃ) বর্ণিত এই হাদীস সনদের দিক থেকে সাহীহ। মূলতঃ আর কোনাে হাদীস না থাকলেও শবেবরাতের ফযীলত প্রমাণের জন্য এই একটি সাহীহ হাদীসই যথেষ্ট।

দ্বিতীয় হাদীসঃ 
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, মধ্য শাবানের রাতে (শবে বরাতে) আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি রাহমাতের নজরে তাকান। অতঃপর হিংসুক এবং আত্মহত্যাকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

দলীলঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল – আল মুসনাদ ২ : ১৭৬, শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী- সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহাহ ৩:১৩৬, এছাড়া আরো ৯টি কিতাবে এ হাদীস এসেছে।

দ্বিতীয় হাদীসের সনদ পর্যালোচনা-
ড . সায়্যিদ মাহমূদ এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে বলেন-
এ সনদটি কমপক্ষে হাসান লিগাইরিহি। এ হাদীসের সনদে কোনাে সমস্যা নেই বরং ইহা হাসান স্তরের অন্তর্ভুক্ত। যদিও আবদুল্লাহ ইবনে লাহিআহ সম্পর্কে অনেক কথাবার্তা রয়েছে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল ও ইমাম ইমাম লাইছ বিন সা’দ এবং অন্যান্যরা তাকে ছিকাহ বা নির্ভরযােগ্য বলেছেন। আর ইমাম আবু যুরআ, ইমাম আবু হাতিম, ইমাম ইবনে মুঈন এবং ইমাম নাসায়ী ও ইমাম দারা কুতনী তাঁকে দাঈফ বা দুর্বল বলেছেন।
বিস্তারিত দেখুন – আল কামিল লিইবনে ‘ আদী ৪:১৫২, আল মাজহীন ২:১১-১২, তাবাকাতুল হুফফায ১:১৮, আততাকরীব ১:৫২৬, ফাইদুল কাদীর ৩:৩৩৩।
দলীলঃ লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭।

শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে দীর্ঘ পর্যালােচনার পর বলেন-
আমার মতে এ হাদীসের সনদ গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই। কেননা এর অনেক সহযােগী ও সাক্ষ্য রয়েছে, সুতরাং হাদীসটি হাসান।
দলীলঃ সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহাহ ৩:১৩৬।

নোটঃ শবে বরাতের ফযীলতে বর্ণিত এ হাদীসের সনদ পর্যালােচনার পর এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, হাদীসটি হাসান। আর হাসান হাদীস মূলতঃ সাহীহ হাদীসের পর্যায়ভূক্ত, যদিও এর স্থান সাহীহ থেকে নিম্নপর্যায়ের।

তৃতীয় হাদীসঃ 
হযরত আবু ছা’লাবা আল খুশানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত) এলে আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি রাহমাতের নজরে তাকান। অতঃপর সাধারণভাবে মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেন। আর অন্যের প্রতি হিংসা পােষণকারীকে তার হিংসার অবস্থায় রেখে দেন (অর্থাৎ ক্ষমা করেন না)।
দলীলঃ ইমাম বাইহাকী- শু’আবুল ঈমান ৩:১৮১-১৮২, শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী- সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহাহ ৩:১৩৬, এছাড়া আরো ১৮টি কিতাবে এ হাদীস এসেছে।

তৃতীয় হাদীসের সনদ পর্যালোচনা-
ড . সায়্যিদ মাহমূদ এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে বলেন-
এই হাদীসের সনদ হাসান। যারা এই হাদীসকে হাসান বলেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, হাফিয় আবদুল্লাহ আলগুমারী। শায়খ আলবানী স্বীয় জামীউস সাগীরের তাখরীজের মধ্যে এবং আততারগীব ওয়াত তারহীবের টীকায় বলেছেন, হাদীসটি ‘সাহীহ লিগাইরিহী’
দলীলঃ লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান, পৃষ্ঠা ৭৫।

চতুর্থ হাদীসঃ 
হযরত উসমান বিন আবুল আস (রাঃ) নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন যে, মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত) এলে একজন ঘােষক (আল্লাহর পক্ষ থেকে) ঘোষণা করেন, কে আছে ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করবাে। কে আছে কোন কিছু প্রার্থনাকারী, আমি তাকে তার প্রার্থিত জিনিস প্রদান করবাে। (সে রাতে) আল্লাহর কাছে মুশরিক অথবা যিনাকারী ব্যতীত যে যা কিছু চায় তাই তিনি দেন।

দলীলঃ ইমাম ইবনে হাজার মক্কী আল ইদাহ ওয়াল বয়ান, পৃষ্ঠা ৭, ইমাম বাইহাকী- শু’আবুল ঈমান ৩:৩৮৩, এছাড়া আরো ১০টি কিতাবে এ হাদীস এসেছে।

চতুর্থ হাদীসের সনদ পর্যালোচনা-
ড . সায়্যিদ মাহমূদ এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে বলেন-
হাদীসটি সহীহ। ইমাম খারাইতি মাসাবিল আখলাক (১:৪৯৬) কিতাবে আবদুল্লাহ বিন আহমাদ বিন ইবরাহীম দারুকী সূত্রে উত্তম ও শক্তিশালী সনদে (সনদে জায়্যিদ) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
দলীলঃ লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান, পৃষ্ঠা ৭৩।

পঞ্চম হাদীসঃ 
হযরত আলী বিন আবু তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, যখন শাবানের মধ্য রাত (শবে বরাত) আসে, তোমরা রাতে (নফল ইবাদতের জন্য) জেগে থেকো, আর দিনের বেলা রােযা রেখাে। কেননা সেদিন সুর্যাস্তের ক্ষণ থেকে আল্লাহ পাক দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে ঘােষণা করতে থাকেন, কে আছো আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবাে। কে আছাে আমার কাছে রিযিক প্রার্থী আমি তাকে রিযিক প্রদান করবাে। কে আছাে বিপদগ্রস্থ আমি তাকে পরিত্রাণ দেবাে। এভাবে (ঘােষণা) ফজর পর্যন্ত চলতে থাকে।

দলীলঃ ইমাম ইবনে মাজাহ- আসসুনান (ইবনে মাজাহ শরীফ) বাব ১৯১ হাদীস নং ১৪৫১, পৃষ্ঠা ২০২। ইমাম আলী মুত্তাকী – কানযুল উম্মাল ১২:৩১৪, ইমাম আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবী- মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ, পৃষ্ঠা ১৯৯, এছাড়া আরো ১০টি কিতাবে এ হাদীস এসেছে।

পঞ্চম হাদীসের সনদ পর্যালােচনা-
সায়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত এ হাদীসটি সনদের দিক থেকে দাঈফ বা দুর্বল।

নোটঃ সনদের দিক থেকে কোনাে হাদীস দাঈফ বা দুর্বল হলেই মাতরূক বা পরিত্যাজ্য হয় না। কেননা মুহাদ্দিসীন ও ফকীহগণ এ কথার উপর একমত যে, ফাযাইলে আমালের ক্ষেত্রে দাঈফ বা দুর্বল হাদীস কিছু শর্তসাপেক্ষে গ্রহণযােগ্য। এছাড়া শবেবরাতের ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত সাহীহ ও হাসান হাদীসের সহযােগী হিসেবে এ হাদীস গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই।

ষষ্ঠ হাদীসঃ 
হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন যে, মধ্য শাবানের রাতে (শবে বরাতে) আল্লাহ পাক মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সৃষ্টিকুলের সবাইকে মাফ করে দেন।

দলীলঃ ইমাম ইবনে মাজাহ- আসসুনান (ইবনে মাজাহ শরীফ) বাৰ : ১৯১ , হাদীস: ১৪৫৩ পৃষ্ঠা ২০২, শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহীহ ইবনে মাজাহ ১:৪১৪-৪১৫, সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহা ৩:১৩৬, এছাড়া আরো ১২টি কিতাবে এ হাদীস এসেছে।

ষষ্ঠ হাদীসের সনদ পর্যালোচনা-
এ হাদীসের সনদে একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন ইবনে লাহিআ। এই বর্ণনাকারীর কারণে অনেকে এ সনদকে দাঈফ বা দুর্বল বলেছেন। ইতােপূর্বে দ্বিতীয় হাদীসের সনদ পর্যালােচনায় আমরা ইবনে লাহিআ সম্পর্কে আলােচনা করে এসেছি। ইমাম আহমাদ, ইমাম লাইছ বিন সাআদ, ইমাম ইবনে হাজার তাঁকে ছিকাহ বা নির্ভরযােগ্য বলেছেন। শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বর্ণিত এ হাদীসকে হাসান বলেছেন।
দলীলঃ সাহীহ ইবনে মাজাহ ১:৪১৫।

সপ্তম হাদীসঃ 
উম্মুল মুমিনীন হযরত আইশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা (রাতে) আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুঁজে না পেয়ে তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। যখন তিনি জান্নাতুল বাকীতে মাথা মুবারক আকাশের দিকে উত্তোলিত করা অবস্থায় ছিলেন। (অর্থাৎ মুৰ্দেগানের জন্য দোয়া করেছিলেন) তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি আশংকা করাে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তােমার সাথে অবিচার করবেন ? আমি আরয করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি ভাবছিলাম আপনি অন্য কোন পত্নীর গৃহে হয়তাে বা তাশরীফ নিয়েছেন। নবীজি ইরশাদ করলেন, শাবানের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহপাক দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর বনু কালব গােত্রের বকরীর শরীরের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দেন।

দলীলঃ ইমাম তিরমিযী- জামীউত তিরমিযী, বাব ৩৯, হাদীস ৭৪৪, ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ২০৭। ইমাম ইবনে মাজাহ- আসসুনান (ইবনে মাজাহ শরীফ) বাব:১৯১, হাদীস: ১৪৫২, পৃষ্ঠা ২০২, এছাড়া আরো ১৫টি কিতাবে এ হাদীস এসেছে।

সপ্তম হাদীসের সনদ পর্যালোচনা-
উম্মুল মুমিনীন হযরত আইশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এ হাদীস বিভিন্ন কিতাবে কিছু শাব্দিক তারতম্যসহ উল্লেখ আছে। হযরত আইশা (রাঃ) থেকে এ হাদীস পাঁচটি ভিন্ন সনদসূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সনদগুলাের ৩টি সনদ দাঈফ বা দুর্বল আর দুটি সনদ গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই।

সুতরাং শবে বরাত কোরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এর উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত।

শবেবরাত সম্পর্কে লা-মাযহাবী, আহলে হাদীস, সালাফিদের ইমাম ‘হাফিয ইবনে তাইমিয়্যা হাম্বালী’ (ওফাত: ৭৯৫ হিজরী) ও ‘শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী’ (ওফাত: ১৪২০ হিজরী) এর অভিমতঃ

‘হাফিয ইবনে তাইমিয়্যা হাম্বালী’ (ওফাত: ৭৯৫ হিজরী) এর অভিমতঃ
হাফিয ইবনে তাইমিয়্যা সকল প্রকার বিদআত ও নিন্দনীয় কাজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারনে খ্যাত হয়ে আছেন। পরবর্তী যুগের মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ইবনে তাইমিয়্যা কঠোরতা করতে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন পর্যন্ত করেছেন। এমনকি তিনি অনেক মাসআলায় ইজমায়ে উম্মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি যদিও হাম্বালী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন মাসআলায় কঠোর অবস্থানের কারনে গাইরে মুকাল্লিদগণও (মাযহাব অমান্যকারী) তাঁকে ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এমনকি তাঁকে যুগের মুজাদ্দিদ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সেই হাফিয ইবনে তাইমিয়্যা শবে বরাত সম্পর্কে বলেন-

শবে বরাত বিষয় কথা হল, এ রাতের ফযিলত সম্পর্কে অনেক হাদীস এবং আছার (সাহাবী ও তাবেঈগণের অভিমত) বর্ণিত রয়েছে। সলফে সালিহীন থেকে উদ্ধৃত রয়েছে যে, তাঁরা এ রাতে নফল নামায পড়তেন। এ রাতের নফল নামায একা একা পড়তে হবে। সলফে সালিহীন সে রকমই করতেন। আর এটাই (পরবর্তীদের জন্য) হুজ্জাত বা গ্রহণযোগ্য দলীল। সুতরাং এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। 
(মাজমুআ’য়ে ফাতাওয়া, ২৩ : ১৩২)

এ বিষয় তিনি অন্যত্র বলেছেন-
এ অধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে- শবে বরাত। শবে বরাতের ফযিলত বিষয় অনেক মারফু হাদীস এবং আছার (সাহাবী ও তাবেঈগণের অভিমত) বর্ণিত রয়েছে। যেগুলো প্রমাণ করে যে, এটা একটি মর্যাদাবান রাত। সলফে সালিহীন এ রাতকে নফল নামাযের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতেন। আর শা’বান মাসের রোযার ফযিলত বিষয়ে সহীহ হাদীস রয়েছে। মদীনা শরীফের বাসিন্দা পূর্ববর্তী কোনো কোনো আলিম এবং পরবর্তী যুগের কেউ কেউ এ রাতের ফযিলতকে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এ বিষয় বর্ণিত হাদীসের (সনদ ব্যাপারে) সমালোচনা করেছেন। যেমন একটি হাদীস- ‘এ রাতে আল্লাহ পাক বনু কালব গোত্রের সকল বকরীর সমুদয় পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দেন।’ তাঁরা বলেন, এ হাদীসের সনদ এবং এ বিষয়ের অন্যান্য হাদীসের সনদে কোনো পার্থক্য নেই।

কিন্তু বিপুল সংখ্যক আহলে ইলম বরং আমাদের (হাম্বালীগণের) অধিকাংশ এবং অন্যান্যরা (অন্য মাযহাবের উলামা) এ রাতের ফযিলত স্বীকার করেন। আর এর উপর ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল এর অভিমত প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। কেননা এ বিষয় বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সলফে সালিহীনের অভিমতও এর পক্ষে রয়েছে। এ রাতের কোনো কোনো ফযিলতের কথা ‘মুসনাদ’ এবং ‘সুনান’ (হাদীসের কিতাবের দু’টি প্রকার) সমূহে উল্লেখ রয়েছে। যদিওবা এ বিষয়ে কিছু মনগড়া কথাও প্রচলিত রয়েছে।
(ইকাতিদাউ সিরাতুম মুসতাকিম, পৃষ্ঠা ৩০১)

‘শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী’ (ওফাত: ১৪২০ হিজরী) এর অভিমতঃ
নিকত অতীতকালে সালাফি নামদারী মাযহাব অমান্যকারী আলিমগণের মধ্যে একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হচ্ছেন শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী। আলবেনীয় বংশদ্ভূত সিরীয় এ আলিম মধ্যে যৌবনে সিরিয়া থেকে সৌদি আরব পাড়ি জমান। কালক্রমে তিনি সৌদি আরবে একজন খ্যাতিমান আলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তাঁর লিখিত ও সম্পাদিত কিতাবাদীর সংখ্যা প্রায় দুই’শ। সালাফীগণের কাছে তিনি হাদীস বর্ণনাকারীগণের সবলতা ও দুর্বলতা বাছ-বিছারে একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত।

আমরা পূর্বে উল্লেখ করে এসেছি যে, শায়খ আলবানীর খড়গ থেকে ইমাম বুখারী (রহঃ) পর্যন্ত রক্ষা পাননি। কেননা শায়খ আলবানী ইমাম বুখারীর ‘আদাবুল মুফরাদ’ নামক বিখ্যাত হাদীসের কিতাবকে সাহীহ আদাবুল মুফরাদ এবং দাঈফ আদাবুল মুফরাদ নামে দ্বিখণ্ডিত করে পৃথক দু’টি কিতাব করেছেন। অনুরুপ তিনি হাদীসের বিখ্যাত কিতাবগুলোকে সাহীহ ও দাঈফ নামে দ্বিখণ্ডিত করেছেন। যেমন, সাহীহ আবু দাউদ, দাঈফ আবু দাউদ, সাহীহ তিরমিযি, দাঈফ তিরমিযি, সাহীহ নাসাঈ, দাঈফ নাসাঈ, সাহীহ ইবনু মাজাহ, দাঈফ ইবনু মাজাহ, সাহীহ আততারগীব ওয়াত তারহীব, দাঈফ আততারগীব ওয়াত তারহীব এবং সাহীহ জামীউস সাগীর, দাঈফ জামীউস সাগীর।

‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহা ওয়া শাইয়ূম মিন ফিকহিহা’ নামে শায়খ আলবানী সংকলিত (এগারো খন্ডে সমাপ্ত) একটি হাদীসের কিতাব রয়েছে। এ কিতাবখানি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের ‘মাকতাবুল মাআরিফ’ থেকে ১৪১৫ হিজরি সালে প্রকাশিত হয়েছে। এ কিতাবের ৩য় খন্ডের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় শায়খ আলবানী একটি শিরোনাম করেছেন ‘শবেবরাত বিষয়ে যা সাহীহ।

এই শিরোনামের অধীনে হাদীস পেশ করেছেন-
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা শাবানের মধ্যবর্তী রাতে (শবেবরাতে) তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি (রাহমাতের দৃষ্টিতে তাকান) তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি হিংসা পোষণকারী ছাড়া বাকী সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
এই হাদীস উল্লেখের পর শায়খ আলবানী বলেন-
হাদীসটি সাহীহ। সাহাবগণের একটি জামাআত থেকে বিভিন্ন সনদসূত্রে এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা হলেন, মু’আয বিন জাবাল, আবু ছা’লাবা আল খুশানী, আব্দুল্লাহ বিন আমর, আবু মূসা আশ’আরী, আবু হুরাইরা, আবু বাকর সিদ্দিক, আউফ বিন মালিক এবং আইশা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)।
(সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহা ৩:১৩৫)

এরপর শায়খ আলবানী প্রত্যেক হাদীসের সনদসূত্র কিতাবাদীর রেফারেন্সসহ বিস্তারিত আলোচনা করে বলেন-
সারকথা হলো- এ হাদীসটি এই সমষ্টিক সনদসূত্রে নিঃসন্দেহ সাহীহ।
(সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহা ৩: ১৩৮)

পাঠকের খিদমতে আরয, আমরা এতক্ষণে সালাফী কিংবা আহলে হাদীস নামধারী মাযহাব অমান্যকারীদের দুইজন প্রখ্যাত ইমামের অভিমত পাঠ করলাম। সবাই শবেবরাতের ফযীলতকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এর পরও কোন আলীম কিংবা শায়খ উপাধিধারী ব্যক্তি শবেবরাতের ফযীলতকে অস্বীকার করেন, তবে তার জন্য হিদায়াতের দোয়া ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে ?

শবেবরাতের রাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে অনেক অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রচলিত রয়েছে। তাই আমাদের করণীয় কী ?

আতশবাজি কিংবা এ ধরণের কোন কাজ ইসলাম সমর্থন করে না। শবেবরাত বা অন্য কোন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে এ গুলো করা কোন ক্রমেই বৈধ নয়। স্থানিয় সংস্কৃতি গ্রহন বর্জনে ইসলামে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সর্বাবস্থায় সে নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। নিজেদের মনগড়া কিছু করতে গেলেই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা থাকে।

সহীহ হাদীস এবং সাহাবী তাবিঈগণের কাজ দ্বারা শবেবরাতের ফযীলত প্রমাণিত। কিন্তু দেশীয় সংস্কৃতির প্রভাবে শবেবরাত কেন্দ্রিক বহু অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রচলিত রয়েছে। এগুলোকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। তবে এই অনৈসলামিক কার্যাদি থেকে বেঁচে থাকার অজুহাতে শবেবরাতের ফযীলত অস্বীকারের সুযোগ নেই। হাতের আঙ্গুলে পঁচন রোগ দেখা দিলে আঙ্গুল কাটতে হবে; কেউ মাথা কাটার পরামর্শ দিলে তা মানার সুযোগ নেই।

এ রাতে করণীয়:
ইমাম ইবনু রাজাব হাম্বালী ( ওফাত: ৭৯৫ হিজরী) বলেন-فينبغي للمؤمن ان يتفرغ في تلك الليلة لذكر الله تعالي وادعاءه بغفران الذنوب وستر العيوب وتفريج الكروب وان يقدم على التوبة فان الله يتوب فيها من يتوب.
একজন মুমিনের উচিত এ রাতে যেনো আল্লাহর যিকির করে। এ ছাড়া গোনাহ সমূহ ক্ষমা করা, ক্রটি সমূহ ঢেকে রাখা, এবং মুসিবত সমূহ দূর করার জন্য তাঁর দরবারে দোয়া করে। এ রাতের প্রথম কাজ হলো তাওবা করে নেয়া। কেননা এ রাতে যারা তাওবা করে আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন।
(সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ, পৃষ্ঠা ১৯৬)

ইমাম ইবনু রাজাব হাম্বালী ( ওফাত: ৭৯৫ হিজরী) বলেন- وليلة النصف من شعبان كان التابعون من أهل الشام كخالد بن معدان ومكحول ولقمان بن عامر يعظمونها ويجتهدون فيها في العبدات
শামের অধিবাসি তাবিঈগণ যথা খালিদ বিন মা’দান, মাকহুল, লুকমান বিন আমির প্রমূখ শবেবরাতকে খুবই তাযীম করতেন এবং সারা রাত নফল ইবাদতে মশগুল থাকতেন। 
(সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ,পৃ:১৯০)

কথা হলো, এই যে তাবিঈগণ শবেবরাতে সারা রাত ইবাদত করতেন তা জেগে থেকে করতেন নাকি ঘুমিয়ে করতেন ? বাকী থাকলো সমবেত ভাবে মসজিদে অবস্থান প্রসঙ্গ ।

ইমাম ইবনু রাজাব হাম্বালী বলেন- كان خالد بن معدان ولقمان بن عامر وغيرهما يلبسون فيها أحسن ثيابهم ويتبخرون ويكتحلون ويقومون في المساجد ليلتهم تلك
খালিদ বিন মা’দান, লুকমান বিন আমির এবং অন্যান্য তাবিঈগণ শবেবরাতে সুন্দর জামা কাপড় পরতেন, সুগন্ধি জ্বালাতেন এবং চোখে সুরমা লাগিয়ে সারা রাত মসজিদে অবস্থান করতেন। (সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ, পৃ:১৯০)

ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উস্তাদ ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়িয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ( ওফাত: ২৩৮ হিজরী ) বলেন- في قيامها في المساجد جماعة ليس ببدعة
শবেবরাতে সম্মিলিত ভাবে মসজিদে অবস্থান করা বিদআত নয়।
(সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ, পৃ: ১৯০)

এবার আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা তাবিঈগণের দেখানো পথ অনুসরণ করবো নাকি বর্তমান যুগের কোন মোল্লা মৌলভীর পথ ?

নোটঃ মনে রাখতে হবে, এরাতে মসজিদে সমবেত হওয়া যেনাে কোনক্রমেই বাধ্যতামূলক মনে করা না হয়। আর যারা এরাতে নফল বন্দেগীর জন্য স্বেচ্ছায় মসজিদে আসেনা তাদের যেনাে গালমন্দ করা না হয়।

“শবে বরাতে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় কাজসমুহ”

শবে বরাতে আমাদের করণীয়ঃ
১) ইবাদাত বন্দেগীর জন্যে শবে বরাতের রাতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব। জাগ্রত থাকার অর্থ হলো কুর’আন তিলাওয়াত করা বা শুনা, হাদীস শরীফ পড়া বা শুনা। তাসবীহ-তাহলীল করা, দুরূদ শরীফ পড়া।
২) কবর যিয়ারত করা এবং মৃত আত্মীয়- স্বজন ও মুসলমানদের জন্যে মাগফিরাত কামনা করা। হাদীস শরিফে আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম শবে বরাতের রাতে মুমিন নারী-পুরুষের কবর যিয়ারতের জন্যে কবরস্থানে যেতেন।
৩) আল্লাহর দরবারে দু’আ করা। হাদীস শরীফে এসেছে শবে বরাতের রাতে মহান আল্লাহ মুশরিক এবং হিংসুক ব্যাতিত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
৪) নফল নামায পড়া। এ রাতে বেশি বেশি নফল নামায পরা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এ রাতে দীর্ঘ সিজদাহসহ নামায আদায় করতেন।
৫) ১৫ শাবান দিনে রোযা রাখা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম ইরশাদ করেন শাবানের রাতে তোমরা নামায পর আর দিনে রোযা রাখ।

শবে বরাতে বর্জনীয় কাজসমুহঃ
১) ঘর-বাড়ি, দোকান, মসজিদ, রাস্তা-ঘাট আলোকসজ্জা করা।
২) বিনা প্রয়োজনে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালানো।
৩) আতশবাজি করা।
৪) পতকা ফোতানো।
৫) মাযার, কবরস্তানে মেলা বসানো।

তথ্যসূত্রঃ মাওলানা আব্দুল আওয়াল হেলাল সাহেবের রচিত ‘কুরআন হাদীসের আলোকে শবে বরাত’ এবং মাওলানা নজমুল হুদা খান সাহেবের রচিত ‘শবে বরাত’ কিতাব থেকে সংগৃহীত।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *