সমুদ্রের টানে সৈকতে ঝিনুক কুড়াতে কে না চায়! নীল সাগরের বেলাভূমিতে আঁছড়ে পড়া তরঙ্গমালার আবেদন মানুষকে দূর থেকে নিজের বুকে টেনে আনে। এক সময় হাজার হাজার পর্যটক ক্ষণিকের জন্যে হলেও মন-প্রাণ উজাড় করে সমুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের একাকার করে দেয়। এটা সমুদ্রের অদৃশ্য ভালোলাগা আর মানুষের ভালোবাসার অদৃশ্য টান। মূলত সমুদ্র মানুষকে নিসঙ্গ জীবনে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। এটাই মানুষ আর সমুদ্রের ভালোবাসার সংক্ষিপ্ত রূপ।
তাই সমুদ্রের ভালোবাসা কাছ থেকে উপলদ্ধি করার সুবাধে সারা দিনের স্বাভাবিক ব্যস্ততা ছেড়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রাত ৯-টায় মাইক্রোতে চড়লাম। আমরা সফরসঙ্গী ১০জন। রাতভর গাড়ী ছুটে চলে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। ফজরের নামাজ ‘সী বিচ’ কেন্দ্রীয় মসজিদে আদায় করি। চার দিকে সমুদ্রের গর্জন বাতাসে অন্য রকম ঝংকার তুলে যাচ্ছে। নামাজের পর অধীর আগ্রহ নিয়ে ছুটে গেলাম বহু দিনের কাক্সিক্ষত সমুদ্র সৈকতে। সেখান থেকে ফিরে একটি হোটেল ভাড়া করে চলে গেলাম সমুদ্রের ডাকে সাড়া দিতে। প্রায় ২ ঘণ্টা নীল সাগরের বুকে আঁচড়ে পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। সকাল ১-টায় সবাই হিমছড়ি ও ইনানী বীচের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। দুপুরে ফিরে এসে বিশ্রাম নেই। বাদ মাগরিব বার্মিজ মার্কেট থেকে হোটেলে ফিরে যাই। পর দিন ফজরের পরপর রওয়ানা হই টেকনাফের উদ্দেশ্যে।
বার্মার সীমান্ত ছূয়ে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের জলপথ বিভাজন অনেক দীর্ঘ। সাগরের বুকে জেগে উঠা একটি মনোরম দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এটাকে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়। সেন্টমার্টিন সফর যেমনি ভয়ের, তেমনি আনন্দেরও। সকাল ৯-টায় টেকনাফ থেকে আমরা জাহাজে উঠি। নাফ নদীর কূল ঘেষে জাহাজ ছুটে চলে নীল সাগরের বুক চিরে। লঞ্চ ঘাঁট থেকে আমাদের সাথে উড়ে আসে শত শত অতিথি পাখি। যাত্রীরা পাউরুটির টুকরো ছুড়ে দিচ্ছে আর পাখিগুলো উড়ন্ত অবস্থায় মুখে নিয়ে তা গিলছে। পকেট ভর্তি টাকা আর ভ্রাম্যমান দোকান থাকা সত্ত্বেও অনেকেই এসব সরল সুন্দর ও মনোহরি পাখির উদ্দেশে টিস্যু নিক্ষেপ করছে। যা একেবারেই বেমানান, ধোকাবাজী আর অমানবিকতা। আমরা এক সময় কূল কিনারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। চারদিকে নীলাকাশ আর সাগরের মিলন দেখতে অপূর্ব। মাঝে মধ্যে পানির ঘূর্ণি আর উত্তাল তরঙ্গমালা সাগরে ভরা যৌবনের নকশা এঁকে দিচ্ছে। প্রায় তিন ঘণ্টার ব্যবধানে দূর সাগরে একটি ভাসমান সবুজ দ্বীপ আবিষ্কার হয়। বাতাস পানির মোকাবেলা করে একসময় আমরা স্বপ্নের সেন্টমার্টিনে পৌঁছে যাই।
নারিকেল বৃক্ষের এই শ্যামল দ্বীপটি আমাদের কাছে ভালোবাসার একটি অভয়ারণ্য মনে হয়েছে। জুমার নামাজ আদায় করে ঘুরতে বের হই। লেখক হুমায়ূন আহমেদও এখানে ‘চাঁদনী বিলাস’ নামে একটি চন্দ্রীমা উপভোগ কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। অন্য স্পটে আমরা ঝিনুক পাথর অবলোকন করি। পিচঢালা সামান্য কিছু রাস্তা ছাড়া সবই বালুতে ভরপুর। মাটি ছুঁয়ে একটু বাতাস এলেই হলো। এখানে শুটকি আর ডাবের বাজার দেখে যে কেউ অবাক হবে। কম দামে ভেজাল মুক্ত জিনিস এতো দূরে এসেও কেউ মিস করবে না। স্বপ্নের মতো কিছু আশা অসম্পূর্ণ রেখেই বন্দরে চলে আসতে হলো। বিকেল তিনটায় জাহাজ ছেড়ে দিবে, সব দেখা আর দেখা হলো না। সেন্টমার্টিনকে বিদায় জানিয়ে আসার পথে এই জীবনটাকে খুব অসহায় মনে হয়েছে। এভাবে একদিন এই পৃথিবীকেও না চাইতে ছেড়ে যেতে হবে। আগোছালো এ জীবনে আছে কি আমাদের সেই প্রস্তুতি? জাহাজ সমুদ্রে ভাসার আধ ঘণ্টা পর ডুবন্ত বালুর চরে জাহাজ আটকে যায়। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা পার হয়ে সন্ধ্যার সময় জোয়ার এলে আমরা সেখান থেকে ছুটতে সক্ষম হই। আকাশভরা তারকা আর একাকী চাঁদের বিকিরণ দেখে রাত আটটায় আমাদের জাহাজ টেকনাফ বন্দরে এসে ভিড়ে। সমুদ্রের বুকে আল্লাহর বিচিত্র সৃষ্টি পরিদর্শন আর কিছু খণ্ড খণ্ড বিপদ কাটিয়ে জীবনযুদ্ধের এক বুক স্মৃতি নিয়ে আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।
Check Also
হাওরের দেশে
‘বাংলা তোমার ধুলো আমার অঙ্গে নেবো মেখে বিশ্ব দেখার স্বাদ মেটাবো তোমায় দেখে দেখে।’ বাংলাদেশ! …