আনন্দ-সংকটে সুনামগঞ্জ ভ্রমণ

২ সপ্তাহ আগে এক জায়গায় বসা অবস্থায় সিদ্ধান্ত হয় আমরা ২দিনের ট্যুরে সুনামগঞ্জ যাব। মামুন ভাই, মাহবুব খাঁন, ফয়ছল ইসলাম, তুহিন আহমদ, নজরুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ খাঁন ও আমিসহ আমরা ৭জন। ১৪ নভেম্বর বিকাল চারটায় গোয়ালাবাজার থেকে রওয়ানা হই আমরা। মোটরসাইকেলযোগে শুরু হয় আমাদের যাত্রা। পড়ন্ত বিকেল পেরিয়ে আমরা সুনামগঞ্জ শহরে পৌছলাম সন্ধ্যা ৭টার দিকে। মাঝপথে চা পানের বিরতি ছিল আধঘন্টা। শহরে পৌঁছেই আমরা উঠলাম পূর্বপরিচিত হোটেল ওমর-এ। ডবল বেডের দুটো রুম বুক করলাম সেখানে। তারপর খানিক বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পরলাম সিটি ট্যুরে। রাতের বেলা সিটি ট্যুর (শহর ঘুরে দেখা) জমে ভালো। আমরা লঞ্চঘাট, সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর প্রাঙ্গণসহ বেশ কিছু জায়গা ঘুরে দেখলাম।
ঘড়ির কাঁটা যখন ১০টা, আমরা চলে গেলাম বিখ্যাত পানসী রেস্টুরেন্টে। রাতের খাবার সেখানেই খেয়ে নিলাম। খাবার শেষে কিছু সময় গল্প-গোজব ও আড্ডার পর সবাই যার যার বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
ঘুম থেকে উঠলাম ভোর ৫টায়। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ৬টায় সকালের নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা শেষ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। কারণ ভ্রমণে খুব সকাল সকাল বেরুতে হয়। আমাদের গাড়িগুলো ছুটে চলল তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। কেননা বারেকটিলা, নীলাদ্রি ও শিমুল বাগান ঐ উপজেলাতেই অবস্থিত। যাদুকাটা নদী পার হয়ে সকাল ৮.৩০ মিনিটের দিকে আমরা পৌছলাম বারেকটিলায়। যাদুকাটার নীল পানি, লাউড়ের গড়ে বিশাল বালুর মাঠ নজর কাড়ার মতো। সেখান থেকে চলে গেলাম টেকেরঘাটের শহীদ সিরাজ লেক বা নীলাদ্রি লেকে। নিলাদ্রীর নীল-সবুজ পানি, উঁচু উঁচু পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য খুবই সুন্দর। তাছাড়া সেখানে রয়েছে ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে চুনাপাথর উত্তোলন ও পরিবহনের নানা যন্ত্রাংশের ধ্বংসাবশেষ। নীলাদ্রি থেকে আমরা চলে গেলাম শিমুল বাগান।
দুপুর ২.৪০ মিনিটের দিকে আমরা পৌছলাম শিমুল বাগানে। সারিসারি তিন হাজার শিমুলগাছের বিশাল বাগান ফটোগ্রাফির জন্য বেস্ট জায়গা। সেই সাথে সেখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম ঘোড়া। ঘোড়া দৌঁড়ানো যায়, ছবিও তোলা যায়। সেখানে ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়ে আমরা চললাম সুনামগঞ্জ শহরের দিকে। সেখান থেকে আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। আমাদের ৩টা মোটরসাইকেল একটা অন্যটার থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। গুগল ম্যাপ ফলো করে চলছিলাম আমরা। কিছু পথ অতিক্রম করার পর বিষম্ভরপুর উপজেলার আনন্দ বাজার এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে আমাদের ২য় বাইক বারবার হর্ণ দিচ্ছিল। অধিক হর্ণ আসছে দেখে আমরা বুঝতে পারলাম পিছনে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে যার জন্য মোটরবাইকটি ঘনঘন সংকেত পাঠাচ্ছে।


সাথে সাথে ইউটার্ন নিয়ে একটু দূরে গিয়ে দেখি আমাদের ৩য় মোটরসাইকেলে একটা ছোট বাচ্চা চাপা পড়েছে। বাচ্চাটির ডান পা ভেঙ্গে গেছে। জানতে পারলাম; ছোট ছোট দুটো মেয়ে রাস্তার পাশে খেলছিল। একটা মেয়ে গাড়ি দেখে দৌঁড় দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যায়। দ্বিতীয় মেয়েটি প্রথমে দৌঁড় দিয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে যায়। এতে আমাদের গাড়ি তার গতিতে চলতে থাকে, কিন্তু আমাদের গাড়ি রানিং অবস্থায় সে আবার দৌঁড় দেয় রাস্তা পার হওয়ার জন্য। এতে করে তার এক্সিডেন্ট হয়। আমাদের বাইকারের সামান্যতম ত্রুটি ছিল না এক্ষেত্রে। সে বাচ্চাটিকে সেইফ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মেয়েটি হটাৎ দৌড় দেওয়ায় বাইক তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তাকে রেফার করা হয় সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে। সেখান থেকে রেফার করা হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমরা তাড়াতাড়ি করে রাত ৮টার মধ্যে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট এসে তাকে ওসমানীর ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করি। ডাক্তার রাতে প্লাস্টার এবং সেলাই দিলেন। দুইটা এক্স-রে পরীক্ষা করালেন। পরীক্ষায় দেখা গেল হাড্ডি মোটামোটি জোড়া লেগেছে। বাকিটুকু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সারারাত কাটল হাসপাতালে। কখনো ঔষধ আনতে, কখনো খাবার আনতে, কখনোবা তার খেয়াল রাখতে। বাচ্চাটির বয়স ৪ বছর। তার বাবা-মা অক্ষরজ্ঞানহীন। তারা কিছুই বুঝে না। তাই পুরো চিকিৎসাটুকু আমরা উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করতে হয়েছে।
পরদিন দুপর ২টায় হাসপাতাল থেকে রিলিজ পায় সে। আমরা তার বাবা-মাসহ তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। তাদের পৌঁছে দিয়ে আমরা সুনামগঞ্জ থেকে ফিরেছি রাত ১টায়। সমস্যা আর ভোগান্তি যাই হোক; মনের ভেতর একটাই শান্তি ছিল, আমরা বিপদে তাকে ফেলে আসিনি। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটির সাথে ছিলাম। ক্ষুদ্র এ অনুভূতিই আমাদের তৃপ্তি। আমাদের সুখ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *