জীবনের প্রথম ভারত সফর

(পূর্বে প্রকাশের পর)
আজমীর থেকে ফেরার পথে
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) এর জিয়ারতে পবিত্র আজমীর শরীফে ২দিন কাটানোর পর ৩অক্টোবর দুপুর ১১টায় আমরা হায়দ্রাবাদ এসে পৌঁছলাম। ভোর ৫টা বাজতেই ক্যাব ড্রাইভার রাকেশ ফোন দিল। স্যার! মে গেটকা বাহার ওয়েট কররা, আপ চালি আইয়ে অর্থাৎ সে বলছে: আমি দরগার গেটের বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি, আপনি চলে আসুন। আগের দিন রাতে তাকে বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। আমরা ৫টা ১৫ মিনিটে রুম ছাড়লাম। রাকেশের গাড়ি শা শা গতিতে ছুটে চলল জয়পুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। মাঝ পথে আমরা সকালের নাস্তা সারলাম। সকাল ৭.৩০ মিনিটে জয়পুর পৌছলাম। ১১টার ফ্লাইট- তাই সিকিউরিটি চেকিংয়ের আগে ২ঘন্টা এয়ারপোর্টে বিশ্রাম করে কাটিয়ে দিলাম।
ইন্ডিয়ার এয়ারপোর্টগুলোতে সিকিউরিটি চেকিং খুব কড়াভাবে হয়ে থাকে। এককথায় ওরা শুধু পারেনি ওটি (অপারেশন থিয়েটার) বসিয়ে শরীরের ভেতরটা কেটেকুটে চেক করতে- নইলে সেটাও করত। টিকেট করার সময় আম্মার জন্য হুইলচেয়ার ইস্যু করে রেখেছিলাম। তাই ভালো সেবা পেয়েছি। হুইলচেয়ার যাত্রীদের বিমানে উঠার আগপর্যন্ত যাবতীয় কাজ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ নিজেরা করে দেয়।
এখানে একটু বলে রাখি, কেউ ফ্লাইটে আজমীর শরীফ যেতে চাইলে জয়পুর হয়ে না গিয়ে কৃষ্ণগড় হয়ে যাবেন। সব থেকে ভালো হবে। আজমীর যাওয়ার জন্য রাজাস্থান প্রদেশে দুটি এয়ারপোর্ট আছে- (১) কৃষ্ণগড় এয়ারপোর্ট (২) জয়পুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। তবে জয়পুর থেকে কৃষ্ণগড় এয়ারপোর্ট আজমীরের খুব কাছে। দূরত্ব ৩১ কিলোমিটার। অথচ জয়পুর থেকে আজমীরের দূরত্ব ১৩৫ কিলোমিটার। আমরা আজমীর যাওয়ার সময় এই ছোট্ট ভুলটা করেছিলাম। যার জন্য ১০৫ কিলোমিটার পথ অতিরিক্ত গাড়িতে করে যাওয়া আসা করতে হয়েছে।
আজমীর শরীফে আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া ৩টি ঘটনা আমি কখনই ভুলতে পারবোনা। (১). আমরা সেখানে যাওয়ার পর খুব বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলাম রুম বুকিং নিয়ে। কেননা দরগার আশপাশে রুম পাওয়া দুষ্কর। আর বেশি দূরে হলে ভীড় ঠেলে আম্মাকে নিয়ে আসা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ সমস্যার সমাধান যেন আচমকাই হয়ে গেল (২). ইন্ডিয়াতে কেবল ওউঋঈ ব্যাংকের এটিএম ছাড়া অন্য কোন এটিএমে আমার ভিসাকার্ড সাপোর্ট করতনা সেটাও আবার নালাগান্দলায়। আজমীরে আইডিএফসি’র কোন বুথ নেই। এদিকে আমার ক্যাশ টাকাও প্রায় শেষের পথে। আজমীর ছেড়ে আসার আগেরদিন পুরো আজমীর ঘুরেও ওউঋঈ এর কোন বুথ পাইনি। অথচ পরদিন আমাকে ক্যাব ড্রাইভারের ভাড়া দিতে হবে ১৭০০ রুপি। সারাদিন ঘুরাঘুরি শেষে যখন সন্ধ্যায় রুমে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বসলাম তখন মানিব্যাগ খুলে দেখি এক কোণে বাংলাদেশী একটা ৫০০ টাকার নোট আছে। আর আমার কাছে ছিল ১২৫০ রুপির মতো। ৫০০ টাকা এক্সচেঞ্জ করে নেওয়ায় টোটাল ১৭০০ রুপি হয়ে গেল। (৩) আজমীর যাওয়ার সময় আম্মার হাড়ের ব্যাথা অনেকটা কম ছিল। কিন্তু আসার পথে কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় তিনি মনে মনে ইচ্ছা করছিলেন যদি বিমানে আমাদের পাশের সীটটা খালি থাকত তাহলে তিনি একটু আরাম করতে পারতেন, ব্যাথা কিছু কম হত। অবাক করার বিষয়; বিমানে উঠার পর দেখি সত্যি সত্যিই আমাদের পাশের সীটটি খালি। কোন পেসেঞ্জার এই সীট বুক করেননি। আজমীর আসলেই অনেক সুন্দর জায়গা। তাড়গড় পাহাড়ের পাদদেশে এ যেন এক শান্তির রাজ্য।

মুসলিম অধ্যুষিত চারমিনারে এক বিকেলে
আম্মার চিকিৎসা শুরু হয় ৬ অক্টোবর থেকে। টানা ১২দিন চলছিল রেডিয়েশন বা রেডিওথেরাপি। এরমধ্যে ২দিন ছিল সরকারি ছুটি। ছুটির দিনে চিকিৎসা বন্ধ থাকায় আমরা একদিন গিয়েছিলাম হায়াদ্রাবাদে মুসলিম অধ্যুষিত বিশাল বাণিজ্যিক এলাকা চারমিনারে। সেখানে মুসলমানদের বসবাস বেশি। তৈরি পোশাক কেনার জন্য চারমিনার বিখ্যাত।
১৬ অক্টোবর বিকাল ৩টায় আমরা রেস্ট হাউস থেকে বের হলাম চারমিনারের উদ্দেশ্যে। আধঘন্টা আগে অনলাইনে একটা ট্যাক্সি বুক করে রেখেছিলাম। যথাসময়ে ট্যাক্সি এসে এপার্টমেন্টের বাহিরে হাজির হল। আমরাও তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নালাগান্দলা থেকে নিঙ্গাম্পালী বাজার, সেখান থেকে মিয়াপুর, মিয়াপুর থেকে চারমিনার। প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো সময় লেগে যায় গন্তব্যে পৌঁছতে। বিকাল ৪.১৫ মিনিটে চারমিনারে পা রাখলাম আমরা।
কি আর বলব; ভারতে মুসলিম অধ্যুষিত এরিয়ায় ঘুরতে কিযে আনন্দ লাগে তা বলে বুঝাতে পারবো না। নিজ ধর্মের মানুষগুলো যখন চোখের সামনে দেখলাম, তাদের মুখের কথা শুনলাম, তাদের মাঝে নিজ ধর্মের অনুকরণ দেখলাম তখন মনে অনেক শান্তি পেলাম। ভাবলাম আমি যেন আমার চিরআপন কিছু মানুষ খুঁজে পেলাম। যেন আমরা সবাই এক পরিবারই। ভালো মানের সুন্দর সুন্দর কাপড় পাওয়া যায় সেখানে। মহিলাদের পোশাক তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায়। দুই আড়াই ঘন্টা সময় কাটানোর পর সেখান থেকে ফিরলাম আমরা। আসার পথে হাইটেক সিটি হয়ে নিঙ্গাম্পালী বাজারে আসলাম। সেখান থেকে সোজা রেস্ট হাউসে।

হায়দ্রাবাদে চিকিৎসার দিন শেষ হল : দেশে ফেরার অপেক্ষা
দশম রেডিওথেরাপি শেষ হওয়ার পর ১৮ অক্টোবর রেডিও অনকোলজির ডাক্তার উৎ. ঝঁহরঃধ গঁষঃরহর এর সাথে দেখা করলাম, থেরাপির ডিসচার্জ নিলাম। তারপর মেডিকেল অনকোলজিষ্ট উৎ. ঘধরফঁ ঘড়ৎসধহ ইবঃযঁহর এর সাথেও দেখা করে ফাইনাল কনসাল্টেশন সম্পন্ন করলাম। ডা. নাইডু’র পরামর্শ হলো-(১) তিনি যে মেডিসিন দিয়েছেন খধহাঃরহরন ক্যাপসুল ইহা নিয়মিত চলবে। থাইরয়েড ক্যান্সারের সাথে ফাইট করার মতো একমাত্র শক্তি এটাই। (২) বাংলাদেশে প্রতি ছয়মাস অন্তর অন্তর একটা ওংড়ঃড়ঢ়ব ঃযবৎধঢ়ু নিতে হবে। তবে এর জন্য থাইরয়েডের পরিমাণ নূন্যতম ৪০ থাকা লাগবে। (৩) দেশে ফিরে একজন মেডিকেল অনকোলজিষ্ট ডাক্তারের অধীনে উনাদের দেয়া চিকিৎসাটুকু চালিয়ে যেতে হবে।
মনে মনে ধারনা ছিল সবকিছু এরকমই হবে-তাই সকালে হাসপাতালে গিয়ে আমার এবং আম্মার আরটি-পিসিআর টেস্টের (করোনা টেস্ট) সিম্পল দিয়ে এসেছিলাম। পরিকল্পনা ছিল রিপোর্টটা যদি সন্ধ্যার মধ্যে পেয়ে যাই তাহলে সন্ধ্যায়-ই টিকেট কনফার্ম করে নিব। যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনি হল। সন্ধ্যা ৬টায় রিপোর্ট আসার পর ৭টার মধ্যে টিকেট বুকিং দিয়ে দিলাম। ১৯ অক্টোবর সকাল ৯টায় হায়দ্রাবাদ রাজিব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওয়ানা দিবে আমাদের উড়োযান। ঢাকায় পৌঁছতে বিকাল ৫টা বেজে যাবে। মাঝপথে কলকাতায় ৩ঘন্টার বিরতি আছে।
পরিচিত অনেককে বলেছিলাম আসতে আরো ৫-৬ দিন লাগবে, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় আমাদের সবকিছু এগিয়ে গেল। দেশের জন্য মন টানছে। তাছাড়া এখন পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী সাল­াল­াহু আলাহি ওয়া সাল­াম-এর মাস চলছে। প্রতিবছর এমন দিনে তালামীযে ইসলামিয়া’র র‌্যালিসহ স্থানীয় সকল আয়োজনে শরীক থাকার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু এবার দূরে থাকায় ভীষণ খারাপ লাগছে। আল­াহ যেন আমাদের সুস্থভাবে নিরাপদে বাড়ি ফিরার তাওফিক দেন- এ আরজি করছি বারংবার।

শেষ রাতের গল্প
১৮ অক্টোবর আমাদের চিকিৎসার কাজ শেষ হয়। তারপর ডাক্তারদের পরামর্শ মতোই চলে আসি আমরা। এ বিষয়ে আমি আসার আগেরদিন রাতে ফেসবুকে একটা লেখা পোস্ট করেছিলাম। সে লেখায় ডিটেলসে উলে­খ ছিল কোন পর্যায়ে এবং কিভাবে গিয়ে চিকিৎসা শেষ হয়েছে। আমি ঐ লেখা পোস্ট করেছিলাম রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। তাই লেখাটিতে রাত ১১টার আগপর্যন্ত সমস্ত কিছুর কথা লিখা ছিল। এরপরের ঘটনাগুলো লেখা ছিলনা এবং তারপর থেকে এ বিষয়ে আর কোন লেখা পোস্ট করা হয়নি তাই সংকটময় সে-রাতের না বলা কিছু কথা এখন বলছি।
১৮ অক্টোবর রাত ১১টায় ফেসবুকে শেষ লেখাটি পোস্ট করার পর আমি মোবাইল চার্জে রেখে চিকিৎসার কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছিলাম। কারণ ভোর ৫টায় আমাদের দেশে ফেরার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। কিছু সময় পর আনুমানিক ১১.৩৫ মিনিটের দিকে আম্মার শরীর অস্বাভাবিক হওয়া শুরু করে। সকাল থেকে একটু একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন। দুপুরে ডাক্তারদের সাথে শেষ কনসাল্টের সময়ও ডাক্তারকে সমস্যার কথা জানিয়েছিলাম। ডাক্তার বললেন; ওসব মেডিসিনের সাইড এফেক্টের জন্য হচ্ছে। চিন্তার কারণ নেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। আমি সেগুলো ফার্মেসী থেকে কিনে খাওয়ালাম। বিকেলে কিছুটা ভালো ছিলেন কিন্তু রাত থেকে আবার সমস্যা বাড়তে থাকে রাত ১১.৩৫ থেকে ১২.১০ মিনিট পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি প্রাথমিক পরিচর্যার মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি করার। কিন্তু কাজ হয়নি।
শেষে উপায়ান্তর না ভেবে তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স কল করে উনাকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করে দিলাম। কারণ এত রাতে আম্মার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকেও হাসপাতালে পাওয়া যাবে না। তাই তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমার কাছে এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। একমাত্র ইমার্জেন্সি ছাড়া এত রাতে কোথাও ডাক্তার পাওয়া সম্ভব নয়। ভর্তি করার পর আমার থেকে পুরো ডিটেলস জেনে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা উনার শরীরে প্রথমে স্যালাইন পুশ করেন। তারপর স্যালাইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ইনজেকশন প্রদান করা হয়। অন্যদিকে সকালে কলকাতার ফ্লাইট ধরার জন্য আমাদের হাতে মাত্র ৬ ঘন্টা সময় বাকি। এর ভিতরে উনাকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। খুব চাপ যাচ্ছিল তখন নিজের উপর। চিকিৎসকদের ফ্লাইটের বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম আর রিকুয়েস্ট করলাম যতদ্রুত সম্ভব উনাকে স্বাভাবিক করে তুলার জন্য। উনারাও সবরকম চেষ্টা চালালেন। সাড়ে তিনঘন্টা পর রাত ৪.২০ মিনিটের দিকে উনি কিছুটা ভালো ফিল পেলেন। ডাক্তারও সাথে সাথে রিলিজ দিয়ে দিলেন। হাসপাতাল থেকে রুমে এসেই তড়িঘড়ি করে লাগেজ গুছিয়ে রওয়ানা হলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর উনার শারীরিক অবস্থার ফের অবনতি হতে থাকে। টিকেট কাটার সময় উইলচেয়ার ইস্যু করে রেখেছিলাম তাই কষ্ট কিছুটা কম হয়েছে। সকাল ৯টার ফ্লাইট ছিল। কলকাতা গিয়ে পৌছলাম ১১টায়। কলকাতা থেকে ঢাকার ফ্লাইট ছিল বিকাল ৩টায়। কলকাতায়ও একই অবস্থা ছিল। অস্বস্তি, ক্লান্তি আর দূর্বলতা। বিকাল ৪টার দিকে ঢাকায় নামার পর অনেকটা আরাম বোধ করেছেন তিনি। ঢাকার অৎৎরাধষ ওসসরমৎধঃরড়হ শেষ করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। যেতে যেতে বারবার মনে পড়ছিল গতরাতের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কথা। অচেনা অদেখা দেশে কাটানো দিনগুলোর কথা। ফেলা আসা অনেক স্মৃতির ছবি।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *