খোদাভীতির উজ্জ্বল নমুনা

৩৪.
এক মহিলা চুক্তিতে চরকায় সুতা কেটে যা মজুরী পেতো তা দিয়ে জীবনযাপন করতো। একদিন রাত্রিতে বাতি জ্বালানোর জন্যে ঘরে তেল ছিল না। রাত্রির আবহাওয়াতে সুতা ছিড়ে যায় না, এজন্য চরকায় সাধারণত রাত্রি বেলাতেই সুতা কাটা হয়। কিন্তু তেল না থাকায় মহিলা চিন্তিত হয়ে পড়ল।
অবশেষে দেখতে পেলো রাস্তা দিয়ে বর যাত্রীর এক বিরাট বহর যাচ্ছে। প্রতিটি উটের পিঠেই মশাল ছিলো। ফলে রাস্তা আলোকিত হয়ে পড়ল। মহিলা চরকা নিয়ে রাস্তায় পাশে বসে গেল। বর যাত্রীর বাতির আলোতে অনেক রাত পর্যন্ত সুতা কাটল। তার সুতা কাটা শেষ হয়ে গেল, কিন্তু যাত্রীদের বহর তখনও শেষ হয়নি। এতো বর বর যাত্রী যে বিয়েতে যাচ্ছে সে বিয়েটা নিশ্চয় কোনো ধনী লোকের হবে। ধনী লোকের আয়ের মধ্যে হালাল টাকা কম থাকে। বরযাত্রীর বাতির তেল হালাল টাকার ছিল কি না? এই তেলের আলো ভোগ করা কি আমার জন্য জায়েজ হয়েছে? মহিলা চিন্তায় পড়ে গেল, এই বাতির আলোতে কাটা সুতা দ্বারা উপকৃত হওয়া তার জন্য জায়েজ হবে কি না? সারা দিন দ্বিধাদ্বন্ধের ভিতরে কাটিয়ে রাত্রি বেলায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের (রহ.) নিকট গিয়ে মাসআলা জিজ্ঞাসা করল। ইমাম সাহেব মহিলার এই তাকওয়া দেখে অবাক হলেন। ভাবলেন ফেকাহর মাসআলার উর্দ্ধে এই মহিলার তাকওয়া। তাসাওফের কোন ব্যক্তিত্বের প্রভাা এই মহিলার উপর নিশ্চয় পড়েছে।
সুতরাং তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পরিচয় কি? মহিলা বলল আমি বশরে হাফী (রহ.)’র বোন। বশরে হাফী ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ বুঝুর্গ। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হুজুর আপনি এতো বড় আলিম হওয়া সত্ত্বেও নিরক্ষর বগরে হাফীর কাছে যান কেন? তিনি জবাবে বললেন, আমি হলাম কিতাবের আলিম আর বশরে হাফী হলেন আল্লাহর আলিম। অর্থাৎ তিনি আরিফ বিল্লাহ কামিল বুঝুর্গ ছিলেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল দেখলেন যে বশরে হাফীর বোন হলে তার জন্য ফিকহার মাসআলা চাইতে তাসাওউফের মাসআলা অধিক উপযোগী হবে। তিনি মহিলাকে জবাব দিলেন, তোমার জন্য সেই সুতার দ্বারা ফায়দা হাছিল করা যায়েজ হবে না। কারণ হারাম হলো নিষেধের সর্বশেষ সীমারেখা। আর তাকওয়া হারামের সীমা রেখা থেকে বহুগুণ দূরে অবস্থান করতে শিক্ষা দেয়। যেমন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)’র গায়ে একবার রাস্তার পানির ছিটা পড়েছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফুরাত নদীতে গোসল করে আসলেন। তাঁর ছাত্ররা বলল হুজুর আপনি নিজেই ফিকাহর কিতাবে লিখেছেন এক দিরহাম নাপাকী মাফ। অথচ রাস্তার পানিতে নাপাকী না থাকা সত্ত্বেও আপনি নদীতে গিয়ে গোসল করে আসলেন কী কারণে? তিনি জবাব দিলেন, ‘হাজা ফাতওয়া ওয়া জালিকা তাকওয়া’ অর্থাৎ কিতাবে যা লিখেছি তা ফাতওয়া, আর এটা হলো তাকওয়া।
(আল এফাযাতুল ইয়াউমিয়্যাহ)

৩৫.
ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) একদিন নিম্ন বর্ণিত আয়াতটি পড়ে সারারাত কান্নাকাটি করে কাটিয়ে দেন। আয়াতখানার উচ্চারণ হলো-“ওয়ামতাজুল ইয়াওমা আইয়্যুহাল মুজরিমুন” অর্থাৎ হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহ পাপীদেরকে সম্বোধন করে বলবেন, হে পাপীগণ! আজ তোমরা আমার প্রিয় বান্দাদের থেকে দূরে সরে যাও। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) আল্লাহর ভয়ে নিজেকে সম্বোধন করে বলেন, হে আবু হানিফা! কিয়ামতের দিন যদি তোমাকেও আল্লাহ পাপীদের দলভুক্ত করে নেন, তখন তোমার কি উপায় হবে? এ বলে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। এরূপ ছিলো তাঁর তাকওয়া। (আত্ তায়ীদ)

৩৬.
আদী বিন আরতাত (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন। সপ্তম আকাশে ফিরিশতা সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে সিজদায় পড়ে আছেন। এরপরও তারা আল্লাহর ভয়ে কম্পমান। কিয়ামতের দিন ঐ সকল ফিরিশতা সিজদা হতে মাথা উঠিয়ে বলবেন ইয়া আল্লাহ! আমাদের দ্বারা আপনার ইবাদতের হক আদায় হয় নি। (তাম্বীহুল গাফেলীন)

৩৭.
একদিন হযরত শিবলী (রহ.) এক মজলিসে বসে ওয়াজ করতে ছিলেন। ওয়াজের মাঝে তিনি একবার খুব ভীতপ্রদভাবে “আল্লাহু” শব্দ উচ্চারণ করলেন। পাশেই বসা এক যুবক তা শুনতে পেয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল এবং সাথে সাথে মারা গেল। এতে যুবকের অভিভাবকগণ হযরত শিবলীর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ল। তারা বাদশার নিকট এই বলে বিচার প্রার্থনা করল যে, হযরত শিবলী (রহ.) তার ছেলেকে মেরে ফেলেছেন। বাদশা হযরত শিবলী (রহ.) কে প্রশ্ন করলেন হে শিবলী, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
হযরত শিবলী (রহ.) নির্ভিক চিত্ত্বে বললেন হে আমিরুল মোমিনীন একটি প্রাণ আগ্রহ প্রকাশ করল বা খোদার প্রেমে বিলীন হয়ে গেল এবং কান্নাকাটি করল, অতঃপর তার মাবুদ তাকে ডাকলেন যার ফলশ্র“তিতে সে সেই ডাকের সাড়া প্রদান করল। এতে আমার কিইবা করণীয় ছিল, আমার কি অপরাধ? বাদশা তাঁর উত্তর শুনে কেঁদে ফেললেন এবং সেই যুবকের অভিভাবককে বললেন, তুমি উনাকে ছেড়ে দাও, কেননা এতে শিবলীর কোনোই অপরাধ নেই। (কিতাবুল কালইয়বী)

Comments

comments

About

Check Also

কাদিয়ানীরা অমুসলিম কেন?

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ পৃথিবীতে হযরত আদম (আ.) কে প্রেরণের মাধ্যমে নবুওয়াতীর ধারাকে সূচনা করেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *