অযোগ্যদের নেতৃত্ব ; আমাদের বিপর্যয়

সেই আদিকাল থেকেই নেতৃত্ব নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলে আসছে। সে প্রতিযোগিতা কখনো অহিংস আবার কখনো সহিংসতার রূপ লাভ করেছিল। সমাজবদ্ধ মানুষের এই সামজ পরিচালনার জন্য সব সময়ই কিছু মানুষকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নির্ধারন করা হয়। আদিম সমাজেও মানুষের একজন নেতা থাকত যে তাদের নেতৃত্ব প্রদান করত। তবে তখন নেতা নির্বাচন পদ্ধতি ছিল অন্য রকম। গোত্র প্রথা ছিল বিধায় গোত্রের সবচেয়ে বায়োজ্যেষ্ট  এবং সবচেয়ে বিচক্ষণ ব্যাক্তিকেই গোত্রপতি নির্বাচন করা হতো। সেই থেকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রের উৎপত্তি হলো। কোন রাষ্ট্র রাজতান্ত্রিক, কোনটা আবার গণতান্ত্রিক। প্রত্যেক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যও নেতৃত্ব দানকারী গোষ্ঠীর প্রয়োজন হয়। কোন কোন রাষ্ট্রের নেতা সে রাষ্ট্রের জনগন নির্বাচন করে আবার কোন রাষ্ট্রের নেতা বংশানুক্রমিক ভাবে নির্বাচিত হয়। শুধু রাষ্ট্র নয় পরিবার থেকে শুরু করে আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। সঠিক নেতৃত্বের ফলে যে কোন দেশ যে কোন সমাজ খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এগিয়ে যায়। আবার ভুল নেতৃত্ব সমাজকে ধ্বংশের অতল গহ্বরে নিয়ে যায়। এই নেতৃত্ব নিয়েই যুগে যুগে অনেক রক্তের ইতিহাস রচিত হয়েছে। এমন কি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রচারিত দ্বীন ইসলাম কে অস্বীকার করে তাঁকে বিতাড়িত করার পেছনে এই নেতৃত্বের লোভ কাজ করেছে। মক্কার কুরাইশ নেতারা তাদের নেতৃত্ব চলে যাবার ভয়ে রাসুলে পাকের অনুসরন থেকে বিরত থাকে এবং মানুষদেরও বিরত রাখে। আবার মুনাফিক শ্রেণির উদ্ভবও হয় অনেকটাই এই কারণে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াসরীবে যাওয়ায় মুনাফিক নেতা উবাই ইবনে ছুলুলের ইয়াসরীবের নেতা হয়ে ওঠা হয় নি। মদিনার মানুষ রাসুলে আরাবীকে তাদের নেতা বলে স্বীকার করে। এজন্যই উবাই ইবনে ছুলুলের এত হিংসা এত বিদ্বেষ ছিল রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি।

ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে আমরা দেখতে পাই সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বলিষ্ট নেতৃত্বে ইসলাম অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর তাঁর খলিফাগন সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ইসলামের সুমহান পতাকা তখন বিশ্বের দিকে দিকে উড়তে থাকে। ইসলামের বিজয় কেতন নামানোর মতো শক্তি ও সাহস তখন কারো ছিল না। এ সব কিছুর মূলে ছিল মুসলমানদের একতা ও যোগ্য নেতাদের সঠিক নেতৃত্ব। সে সময়কার নেতাদের মনে নেতৃত্বের প্রতি মোহ ছিল না। ছিল না তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার লোভ। সে কারণে সাধারন মানুষ নেতাদের অনুসরণ করেছেন প্রকৃত ভাবেই। তাদের মনে ছিল ইসলামকে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দেয়া। জনগনের নগন্য সেবক মনে করতেন নিজেদের এবং সে লক্ষ্যেই কাজ করে যেতেন। মুসলমানদের অধঃপতন তো তখন থেকেই শুরু হলো যখন তাদের মনে নেতৃত্বের অন্ধ মোহ প্রবেশ করল। বিলাসীতায় মত্ত হয়ে জনগনের সেবক না হয়ে জনগনের প্রভু বনে গেলেন। সে সময় থেকেই জনগন এবং নেতৃশ্রেনির মানুষের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হলো। অযোগ্য ও অদূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়। সম্পদ আর নেতৃত্বের মোহই মুসলমানদের জন্য কাল হয়ে দাড়াল। আপন ভাইয়ের রক্তের নেশায় মুসলমানরা বূধ হয়ে আছে। যা থেকে উত্তরনের পথ বের করা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।

নেতা আর নেতৃত্ব বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যে, অযোগ্য লোকেরাই এখন নেতৃত্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে আছে। তাদের প্রতাপে যোগ্য লোকেরা আজ নির্বিকায়। সম্পদ আর ক্ষমতার দাপটে তারাই আজ সর্বনিয়ন্তা। রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন-

عن عبدالله بن عمرو رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد ولكن يقبض العلم بقبض العلماء حتي اذا لم يبق عالما اتخذ الناس رؤوسا جهالا فسئلوا فافتوا بغير علم فضلوا واضلو 

অর্থাৎ, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের নিকট থেকে ইলম টেনে উঠিয়ে নেবেন না। বরং আলিমদের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে। যখন কোন আলিম অবশিষ্ট থাকবেন না তখন মানুষ মূর্খদের নেতার আসনে বসাবে। অতঃপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে এবং তারা ফতোয়া দিবে কোন জ্ঞান ছাড়াই। অতঃপর তারা পথভ্রষ্ট হবে এবং তোমাদেরও পথভ্রষ্ট করবে। (বুখারী ও মুসলিম)

এ হাদিসের বাস্তব প্রতিফলন আজকে আমাদের সমাজে দেখতে পাই। রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটা স্তরে আজ মূর্খ, অযোগ্যদের জয়জয়কার। এ মূর্খদের জন্যই আমাদের এত অধঃপতন। যোগ্য নেতৃত্ব পেলে আজ মুসলমানরা এ অবস্থায় পতিত হতো না। বর্তমানে যে কোন ছোট্ট সংগঠনের পদ পাওয়ার জন্য কিছু লোকের চাটুকারিতার যে নগন্য রূপ আমাদের চোখে পড়ে তা সত্যিই লজ্জার বিষয়। তুমি নেতা হবে, ভাল কথা কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অন্যতম যে গুন থাকতে হয় সেটা হলো ব্যাক্তিত্ব। একজন ব্যাক্তিত্বহীন লোক কীভাবে শত সহস্র মানুষকে নেতৃত্ব প্রদান করবে। ব্যাক্তিত্বহীন ব্যাক্তি অমেরুদণ্ডী প্রাণীর ন্যায়। অমেরুদণ্ডী প্রানী যেভাবে সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না ঠিক তেমনি ব্যাক্তিত্বহীন ব্যাক্তি কখনোই তার স্বকীয়তা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। সে তার নিজেকে অন্যের মধ্যে শপে দিয়ে নিজের ফায়দা লুঠতে ব্যাস্ত। বিনয় অবশ্যই উত্তম গুন। এটা মানুষের মহত্ত প্রচার করে। অতিরিক্ত বিনয়ের ভাব দেখাতে গিয়ে যদি নিজের স্বকীয়তা বা নিজস্বতা না থাকে তাহলে সে বিনয় না দেখানোই উত্তম বলে আমি মনে করি। নিজের ব্যাক্তিত্ব ঠিক রাখতে গিয়ে যদি অপরের কাছে অহংকারী হিসেবে সাব্যস্ত হও তাহলে তাও গর্বের। তাই বলে ঔদ্ধতা প্রদর্শন করা যাবে না। এটা নিঃসন্দেহে ঘৃণিত। আল্লাহ তা’আলা ঔদ্ধত ও অহংকারীকে ভালবাসেন না।  অযোগ্যরা যে হারে নেতৃত্বে আসছে তা আমাদের জন্য অসনি সংকেত। আমরা ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে। চাটুকার প্রকৃতির ব্যাক্তিদের থেকে যদি নেতৃত্ব হেফাজত না করা হয় তাহলে আমাদের ধ্বংশ অনিবার্য। এই চাটুকার নেতৃত্ব পেলে সে তার জায়গায় আরেক চাটুকার কে বসাবে এটা সহজেই অনুমেয়। বৃহৎ মুসলিম উম্মাহ থেকে শুরু করে আমাদের ছোট্ট কোন সংগঠনের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে একজন দক্ষ ও যোগ্য ব্যাক্তিকে নির্বাচন করা, যার হাত ধরে সে সংগঠন এগিয়ে যাবে স্বাভাবিক গতিতে। অযোগ্য এবং চাটুকারদের থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *