মুসলিম ঐতিহ্য আগ্রাফোর্টে একদিন

মেঘমুক্ত নীল আকাশ। ধীর গতিতে এগোচ্ছে আমাদের বাস। বিকেলের মিষ্টি রোদ বাসের জানালা ভেদ করে আলতো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে গায়ে। বাহিরের অপূর্ব দৃশ্য দেখে বার বার হারিয়ে যাচ্ছিলাম নন্দন মুগ্ধতায়। বাসে ভারতীয় পর্যটক সহ কয়েকজন বাংলাদেশি ও চাইনিজ পর্যটকও রয়েছেন। বাস থেকে নামে আমাদের ট্যুারিস্ট গার্ড টিকেট কেটে নিয়ে এলেন। প্রতি টিকেটের মূল্য ত্রিশ রুপি। বিদেশি পর্যটকদের জন্য টিকেটমূল্য ষাট রুপি। টিকেট নিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। চেকিংপোস্ট পেরিয়ে ভেতর ঢুকলাম। চারপাশে ছোটবড় দালান আর দুর্গ। সবগুলো লাল বেলে পাথরে নির্মিত। দুর্গের দেয়ালগুলো অনেক উঁচু আর পুরু। একটা সময় দুর্গের এ দেয়ালের ওপর থেকে সৈন্যরা প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতো। বাইরে থেকে বোঝার তেমন উপায় নেই, এর প্রবেশপথ কোন দিকে। গার্ড আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। লাল বেলে পাথরে নির্মিত সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা ওপর ওঠে এলাম। ভেতর ঢুকতেই নজরে পড়লো, বিশাল এলাকা জুড়ে মোঘল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। চারপাশে সারি সারি ফুলের বাগান আর লাল আস্তরণে পুরোনো সব দুর্গ। পুরোনো হলেও আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে আরো নান্দনিকতায় ভরে উঠেছে দুর্গগুলো। বর্তমান দুর্গটির অধিকাংশ মোঘল আমলে নির্মিত হলেও এগারো শতকে এখানটায় ছোটখাটো একটি দুর্গ ছিলো। ১৫২৬ সালে সম্রাট আকবর দিল্লি দখল করে সপরিবারে এখানেই বসবাস করতে থাকলেন। তার হাতে যখন দুর্গটি আসে তখন এর ধ্বংসাবশেষ কেবল বাকি ছিলো। তিনি দুর্গটি নতুনভাবে সংস্কার করেন এবং লাল বেলে পাথরে সজ্জিত করেন। এর পাশেই তিনি একটি সিঁড়িযুক্ত কূপ খনন করেন, যা এখনো বিস্ময় ছড়ায় দর্শকের মধ্যে। প্রায় চার হাজার কর্মীর আট বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৫৭৩ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। পরবর্তিতে আকবর পৌত্র সম্রাট শাহজাহানের দ্বারা দুর্গটি আধুনিক রূপ লাভ করে। সম্রাট শাহজাহানের সাদা মার্বেল ও মর্মর পাথরের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিলো। তাই দুর্গের প্রতিটি মহলের মেঝে তিনি সাদা মর্মর পাথরে আস্তরণ করেন। তথ্যগুলো কথায় কথায় জানালেন আমাদের ট্যুারিস্ট গার্ড।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম। ওপরের নান্দনিক দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম মুহূর্তেই। যমুনা নদীর পানি ছুঁয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে গা জুড়িয়ে গেলো। নদীর ওপারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আগ্রা অধিপতি শাহজাহান ও তার সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের অনন্যা সুন্দর সমাধিস্থল তাজমহল। পাশেই সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত একটি ছোট কক্ষ। সম্রাট শাহজাহান এখানে বসে তাজমহল দেখতেন এবং ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া নিতেন। তাজমহলের দৃশ্য পেছন নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে সেলফি তুলে নিলাম। দেশি বিদেশি সবাই সেলফি তুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুরো ফোর্টের নিচে রয়েছে বিশাল সুড়ঙ্গ। যমুনার ঠাণ্ডা পানি এর নিচ দিয়ে বয়ে যেতো। এ কারণেই পুরো দুর্গ থাকতো সবসময় শীতল। কালের আবর্তে যমুনা এখন মৃতপ্রায়। শেষ বয়সে সম্রাট শাহজাহান নিজ ছেলে আওরঙ্গজেব কর্তৃক বন্দি হয়ে থাকেন এ দুর্গের নিচেই। এখানে বসেও তিনি তাজমহল দেখতেন এবং প্রিয় স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করতেন। একসময় এখানেই তার মৃত্যু হয়। গার্ড আমাদের নিয়ে গেলেন শীষ মহলে। প্রতিটি দেয়াল দামী আয়না দিয়ে ঘেরা। হাজারো আয়নার প্রতিচ্ছবিতে যেনো ধাঁধায় পড়ে গেলাম। এটি আসলে রাজ গোসলখানা। অন্যান্য কক্ষের মতোই এর ভেতরের কারুকার্য বিস্ময়কর। পাশে একটি শুভ্র সফেদ সুন্দর মসজিদ। সম্রাট শাহজানের হাতেই এটি নির্মিত হয়। মুতির মতো দ্যুতি ছড়ায় বলে এর নাম দেয়া হয় মুতি মসজিদ। সম্রাটগণ এখানেই নামাজ আদায় করতেন বলে জানা যায়। অন্যপাশ দিয়ে নিচে নেমে এলাম। চারপাশে উঁচু উঁচু দুর্গের মধ্যখানে একটুখানি খোলা জায়গা। গার্ড জানালেন, এখানে একসময় আঙ্গুরের বাগান ছিলো। বিভিন্ন জাতের সুমিষ্ট আঙ্গুর ফলন করা ছিলো সম্রাট শাহজাহানের শখের বিষয়। ছোট্র একটা দরজার সাহায্যে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বিশাল প্রান্তর। ওপরে ইট সুরকির তৈরি সুন্দর কারুকার্য খচিত ছাদ। দেয়াল ঘেঁসে একটু ওপরে খানিকটা খোলা জায়গা। গার্ড জানালেন, এর ওপরে সম্রাটদের সিংহাসন ছিলো। এ সিংহাসনে বসে তারা বিচারকার্য চালাতেন। প্রজারা বসতো সামনের ছাদবিশিষ্ট খোলা জায়গাটায়। সিংহাসনের ঠিক পেছনে ছোট্ট একটা কক্ষ। গার্ড জানালেন, এখানেই সংরক্ষিত ছিলো ঐতিহাসিক মণি কুহিনুর খচিত তাজ। যা ইংরেজরা উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পরে আর মিলেনি সেটি। সুন্দর এ দুর্গ দেখতে প্রতি বৎসর দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসেন হাজারো দর্শক। ১৯৮১ সালে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে এটি মর্যাদা লাভ করে। ভারত সরকারের উল্লেখযোগ্য আয় অর্জিত হয় এই অনন্য স্থাপত্য থেকে।
মুসলিম সম্রাটদের এ ঐতিহাসিক স্থাপত্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নামলো। মাগরিবের আজানে মুখরিত হয়ে ওঠলো আগ্রার আকাশ। নামাজ পড়ে বাসে চড়ে রওনা হলাম নিজ গন্তব্যে।

Comments

comments

About

Check Also

জ্ঞানের দুয়ার হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এমন এক ব্যক্তি যার জন্ম হয় পবিত্র কা’বা শরীফের ভেতরে, সম্পূর্ণ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *