বড়পীর মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (র.) (১ম পর্ব)

‘শরীয়ত যদি আমার মুখে লাগাম না লাগিয়ে দিত, তবে আমি সুনিশ্চিতরূপে তোমাদের বলে দিতাম, তোমরা নিজ নিজ গৃহে কী খাও এবং তোমাদের ঘরে কী কী সঞ্চিত রয়েছে।’ কথাটি কোনো নবী-রাসূলের নয়; এটি বলেছেন প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর উম্মতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বড়পীর মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (র.)। নিজের সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা আমার সম্পর্কে কিছুই জান না, আমাকে দিনরাতে সত্তরবার বলা হয়-‘আমি তোমাকে মনোনীত করেছি।’ তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমাকে যা কিছু আদেশ করা হয়, তা-ই আমি আমার মুখ দিয়ে প্রকাশ করি। যা কিছু আমাকে দান করা হয়, তা-ই আমি মানুষকে দান করি। আমাকে অবিশ্বাস করলে তোমাদের দীন-দুনিয়া আখিরাত সবই বরবাদ হয়ে যাবে। আমি তোমাদের যাহের-বাতেন সবকিছু অবগত আছি, তোমাদের দর্পণে আমি সকলের বর্ণই দেখতে পাচ্ছি।’ (তাজকেরাতুল আওলিয়া, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা ২৯-৩০)
কোনো সাধারণের জন্য যেমন এ ধরণের কথা কল্পনা করাও ক্ষতিকর; তেমনি আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর মতো পরীক্ষিত ও নৈকট্যপ্রাপ্ত ওলীর মুখে এসব ঘোষণা তাঁর শোভা ও অধিকার; এমনকি দায়িত্বও বটে। মহানবী (স.) যেমনটি বলেছেন-আমি আদম-সন্তানের (শ্রেষ্ঠতম) নেতা; তবে এতে আমার ফখর নেই।
মানুষ কোন স্তরে পৌঁছলে এমন কথা বলতে পারেন এবং সে মর্যাদা অর্জনের জন্য কতোটা কঠিন ও গভীর সাধনা করতে হয়, জিলানী (র.)-এর জীবন-চরিত চর্চা করলে, হয়ত এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
এ প্রবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য যখন আমি তাঁর বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ অধ্যয়ন করেছিলাম, সত্যি বলতে কি, আমি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম; কিছুতেই আমার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল তাঁর জীবনের আগা-গোড়া সবটুকুই বেলায়েত-কারামত ও আল্লাহর রহমত-কুদরতের বিদর্শনে ভরপুর। বরাবরই আমার মনে হয়েছে … এর জ্বলন্ত প্রমাণ তিনি। কিন্তু এটিও পরম সত্য যে, পরম সাধনা ব্যতীত এরূপ বিশেষ রহমত প্রাপ্তির কোনো সুুযোগ নেই। নবীদেরও ছিল না; ওলীগণেরও নেই। কূপে পড়েই ইউসূফ (আ.) মিশরের বাদশাহ হয়েছেন, নমরূদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েই ইবরাহীম (আ.) হয়েছেন খলীলুল্লাহ।
আলোচ্য মহান ওলীর মতো বড় ব্যক্তিত্বের বিরল জীবনচরিত আলোচনা ও ব্যাখ্যা করতে যে কারোরই একটু হাত কাঁপবার কথা। আমার তো অন্তরই কাঁপছে। তদুপরি বরকতের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা করে সার্বিক ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক শুরু করছি-

এক নজরে বড়পীর
জন্ম : ৪৭০ হিজরীর পবিত্র রমযানে ইরানের জিলান নগরীতে।
নাম ও উপাধি : ‘আবদুল কাদের’ মূলনাম। জন্ম শহরের সূত্রে বলা হয় জিলানী। উপাধি- ১. মহিউদ্দীন ২. গাওসুল আজম ৩. মাহবুবে সুবহানী ৪. বড়পীর ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন উপাধিতে তিনি প্রসিদ্ধ।
পিতামাতা ও বংশসূত্র : পিতা হজরত আবু সালেহ মূসা (র.) এবং মাতা উম্মুল খায়ের ফাতেমা। পিতৃকুলের উৎস হজরত হাসান বিন আলী এবং মাতৃকুলের উৎস হজরত হুসাইন বিন আলী (র.)। অর্থাৎ দু’দিক দিয়েই তিনি মহানবী (স.)-এর বংশধর। তাঁর মাতার ষাট বছরে তাঁর জন্ম হয়।
বড়পীর মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (র.)
ইল্মে দীন শিক্ষা : অলৌকিকভাবেই তিনি পনের/আঠারো পারার হাফেজ ছিলেন। জিলানের মক্তবে ওস্তাদজীর নিকটে অতি শৈশবেই তাঁর পুর্নাঙ্গ হিফযুল কুরআন সমাপ্ত হয়। অতঃপর দশ/বার বছর বয়সে তাঁর পিতার ইন্তেকাল হলে বৃদ্ধা মাতার খেদমতে বাড়িতেই থাকেন। আঠারো বছর বয়সে বাগদাদের ‘নিজামিয়া’ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে তাফসীর-হাদীস সহ তেরটি বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করেন।
তরিকার বাইয়াত গ্রহণ : তিনি সে সময়ে বিখ্যাত পীর ও বড় আলেম শায়খ আবু সাঈদ মাখযূমী (র.)-এর নিকট তরিকার বাইয়াত গ্রহণ করেন। তার সিলসিলা হজরত আলী (রা.) এর মাধ্যমে হয়ে মহানবী (স.) পর্যন্ত পৌঁছে।
শিক্ষকতা : পীরের নির্দেশে বাগদাদে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় হজরত জিলানী (র.) শিক্ষকতা ও পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে তার হাতেই সে মাদ্রাসা বৃহত্তম ‘জামেয়া’-য় পরিণত হয়।
আমল-ইবাদত : অসাধারণ আমল-ইবাদত ছিল তাঁর।
ফতোয়া-মাজহাব : তিনি শাফেয়ী ও হাম্বলী মাজহাব অনুসারে ফতোয়া দিতেন আর আবুল হাসান মাতুরিদীর আকিদার অনুসারী ছিলেন।
বেলায়েত ও কারামত : বেলায়েতের সর্বোচ্চ মাকাম এবং আকাশের তারার মতো অসংখ্য কারামতের অধিকারী ছিলেন।
ওয়াজ-তালীম : তাঁর মসজিদে শুক্রবার, মাদরাসায় শনিবার এবং ঈদগাহে অন্য একদিন-এভাবে সিডিউল অনুসারে ওয়াজ করতেন। সকালে তালীম দিতেন। অনেকে বেহুশ হতো; এমনকি কেউ কেউ মারাও যেত।
ইসলাম গ্রহণ : তাঁর ওয়াজ শুনে পাঁচশ-এর অধিক ইহুদি, খ্রিস্টানসহ লক্ষাধিক অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
পুস্তক রচনা : তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে সুগভীর চেতনায় আরবী ও ফারসীতে কবিতা লিখেছেন। মাসায়েল ও তালীমের বিষয়ে গুণিয়্যাতুত্তালিবীন ও ফাতহুল হাইব ও আল-ফাতহুর-রব্বানী রচনা করেছেন। তাঁর ওয়াজ ও চিঠিপত্রেরও সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। মূলত : এসবের সংখ্যা-ই বেশি।
দেহাকৃতি, আচরণ ও পোশাক : শায়খ আবু সাঈদ (র.) বলেন, হজরত আবদুল কাদের জিলানী (র.) ছিলেন মধ্যমাকার ও স্বর্ণোজ্জ্বল দেহকান্তি বিশিষ্ট। প্রশস্ত বক্ষ, দীর্ঘ ও ঘন দাড়ি, যুগ্ম ভ্রুযুগল এবং উচ্চ ও মধুর কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছিলেন। পরিচ্ছন্নতা প্রিয়, বিনয়ী আচরণ ছিল। অত্যন্ত দামী পোশাক পছন্দ ছিল তাঁর।
খাদ্যাভ্যাস : তাঁর জন্য নিয়মিত চারটি আটার রুটি তৈরি করে আনা হতো। তিনি সামান্যই খেতেন; বাকিগুলো উপস্থিত সবাইকে দিতেন। তবে মধু, ঘি, দুধ ও দুগ্ধজাত বস্তুর প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল।
পারিবারিক জীবন : একান্ন বছর বয়সে তার দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। চল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁর স্ত্রী ছিলেন চারজন। সাতাশজন পুত্র ও বাইশজন কন্যা ছিল। তবে শায়খ সোহরাওয়ার্দীর মতে, পুত্র ছিল মাত্র দশজন। পুত্র, মেয়ে এবং জামাতাগণ সবাই দীনদার আলেম এবং তাঁর অনুসারী ছিলেন।
পরপারে যাত্রা : একানব্বই বছর বয়সে ৫৬১ হিজরীতে ৯/১০/১১/১৭ রবিউস সানী সোমবার তিনি ইন্তেকাল করেন। ইরাকের বাগদাদে তাঁর মাজার রয়েছে।
বড়পীরের আবির্ভাবের সময় মুসলিম বিশ্বের অবস্থা : সে সময় দুনিয়াদার স্বেচ্ছাচারী খলিফাদের অত্যাচার ও অবহেলায় বিশ্বময় মুসলিমদের ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। খারেজী, শিয়া, মুতাজিলা, জাবরিয়া, ইমামিয়া-র মতো ভ্রান্ত-বেদআতী মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর মধ্যে অলূত্য সম্প্রদায়ের আন্দোলনই ছিল ইসলামী শাসন ও মূলনীতি ধ্বংসের জন্য মুনাফেকি করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হত্যার ষড়যন্ত্র করা। মধ্যপ্রাচ্য, খোরাসান, কাবুল, কান্দাহার পর্যন্ত এ মতবাদের বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। গজনীর সিংহপুরুষ সুলতান মাহমুদ যদিও এ আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করেছেন, হাসান ইবনে সাবাহ্র অধীনে এরা পূনরায় জেঁকে বসে। মোট কথা এমতাবস্থায় বড়পীরের মতো মহান সংস্কারকের খুবই প্রয়োজন ও উপযোগিতা ছিল। (বড়পীর : জীবন ও কর্ম)
তাঁর পিতামাতার তাক্ওয়া ও আধ্যাত্মিকতা : বড়পীরের পিতামাতা অত্যন্ত মুত্তাকী হয়ে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক এবং বাস্তবতা। তাঁর পিতা আবু সালেহ্ ক্লান্ত পথে নদীতে ভাসমান সেব ফল খেয়ে তাঁর দায়মুক্ত হওয়ার জন্য বাগানের মালিক আব্দুল্লাহ সাউমেরী (র.)-এর নিকট দীর্ঘ বার বছর খেদমতে ছিলেন এবং একই কারণে সাউমেরীর কন্যা ফাতেমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। ঘটনাটি হজরত মূসা (আ.) এর দাম্পত্য জীবনের সাথে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। অতি উচ্চমাত্রার তাক্ওয়ার অধিকারী পিতা-মাতার ঘরেই মূলত : আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। (সাওয়ানেহে গওসে আযম)
(২য় পর্ব)
(শেষ পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *