যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ এবং বাংলার বুকে জন্ম গ্রহণ করেও তাদের কর্মপ্রতিভা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন, ইলমে ওহীর প্রচার-প্রসারে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন, খোদাদ্রোহী শক্তি ও নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনে যারা সামনের কাতারে থেকে আপোষহীন নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমাজ সেবায় যাদের রয়েছে অনন্য ভূমিকা, তাফসীর-ছিয়র, কবিতা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনায় যারা অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, এতিমখানা, ডিসপেন্সারী প্রতিষ্ঠায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে আলোচনায় সবার শীর্ষে যার নাম চলে আসে তিনিই প্রবাদ প্রতীম পুরুষ, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যুগশ্রেষ্ঠ আলিম, মুজাদ্দিদে জামান, মুরশিদে বরহক আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। এ মহামনীষীর বিশাল কর্মময় জীবনের যে কোন একেকটি বিষয় নিয়ে যদিও বিশাল গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব কিন্তু আমাদের দৈন্যতার কারণে আজ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। আল্লামা ফুলতলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এক বিস্ময়কর অনন্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর সে প্রতিভার সাথে যুক্ত হয়েছিল অকল্পনীয় কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়। যার ফলে তিনি ইহকাল ও পরকালের প্রকৃত সাফল্য করায়ত্ব করে নিজেকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিলেন। তাঁর সুগভীর জ্ঞানরাশি, প্রজ্ঞা ও অচিন্তনীয় মনীষার আলোক প্রভা দুনিয়ার দিকে দিকে যে প্রখর কিরণ দান করেছিল এক কথায় তা অতুলনীয়।
ওয়াহাবীবাদ, মওদুদীবাদসহ অন্যান্য ভ্রান্ত সম্প্রদায় সমূহের উদ্ভট ও কল্পিত মতবাদ সমূহের ভিত্তি ও যুক্তি উৎপাটন ও খণ্ডন করত: ইসলামের প্রকৃত ও সঠিক আদর্শ, শিক্ষাকে মুসলিম জাহানের সামনে তুলে ধরতে ও তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর তুল্য মহান ব্যক্তিত্ব খুবই বিরল। তিনি সমস্ত ভ্রান্ত ও অসার আকীদা এবং মতবাদগুলোকে শরয়ী ও আকলী দলীল দ্বারা সম্পূর্ণ অকেজো ও পর্যূদস্ত করেছিলেন। তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করলে একথা ভেবে অবাক হতে হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে কি অফুরন্ত ইলম এবং জ্ঞান ভাণ্ডারের অধিকারী করেছিলেন।
মুসলিম জাহানের মহা মনীষীদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা প্রত্যেকেই একেকটি বিশেষ অবস্থানে প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে কিরাত, ইলমে তরীকত এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতুলনীয় প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁর মত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব দুনিয়ার যে কোন এলাকায় খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাঁর জ্ঞান অর্জন, চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা-আলোচনা, মেহনত-রিয়াজত সর্বোপরি সত্য ও খাঁটি তত্ত্বোদঘাটনের কঠোরতম প্রচেষ্টা, শ্রম, কারাবরণ ও অকল্পনীয় সাধনায় আত্মনিয়োগ করত: তিনি যে সর্বমূখী অভিজ্ঞতা ও পরিপূর্ণতা লাভ করেছিলেন তার কোন তুলনা নেই। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারী উলামায়ে কেরামের অভিভাবক হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত ছিলেন।
মুসলিম বিশ্বের এ ক্ষণজন্মা মহামনীষীর কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক খ্যাতিমান লেখকগণের লেখনীতে প্রকাশ পেলেও তাঁর ব্যক্তিগত স্বভাব প্রকৃতি নিয়ে তেমন কোন আলোচনা এখনও চোখে পড়েনি। তাই এ নিবন্ধে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর স্বভাব প্রকৃতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু আলোচনার প্রয়াস মাত্র।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও সদালাপী। তাঁর হৃদয় ছিল স্বর্ণের মতই দুর্লভ ও দুর্মূল্য। যুগের এ ক্রান্তি লগ্নে তাঁর মত সচেতন, সাহসিকতার গুণে গুণান্বিত, প্রত্যুৎপন্নমতি ব্যক্তিত্ব সত্যিই বিরল। তিনি সত্যপ্রিয় ও স্পষ্ট ভাষী ছিলেন। সত্য কথা যতোই তিক্ত হোক না কেন তা বলতে কখনও কুণ্ঠিত হতেন না। তাঁর সত্যপ্রিয়তা ও স্পষ্ট ভাষণ এমনই ছিল যে হাজার হাজার লোকের সামনেও তা বলতে দ্বিধা করতেন না। তাঁর সাহসিকতা ছিল প্রবাদতুল্য। প্রমাণ স্বরূপ একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
১৯৫০ সালে আসাম সরকার মুসলিম এডুকেশন বোর্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে উলামায়ে কেরাম এর প্রতিবাদ জানাতে একত্রিত হলেন। কিন্তু নেতৃত্বদানে কেউ রাজি হলেন না। অবশেষে ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি উলামায়ে কেরাম নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর গতিশীল ও সাহসী নেতৃত্বে উলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান ফুঁসে ওঠেন। পরপর দু’টি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং চারদিকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তখন প্রাদেশিক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি করে এবং সৈন্যরা তাঁকে হৈন্য হয়ে খুঁজতে থাকে। এর পরও তিনি দমেননি। আসামের ডবকা নামক স্থানে অনুষ্ঠিত হয় ইসলাম প্রিয় জনতার মহা সমাবেশ। ছাহেব কিবলাহ হাতির পিঠে চড়ে উক্ত সমাবেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। সরকারী সৈন্যরা এ উদ্দেশ্যে তাঁকে ঘিরে রাখে যে সভামঞ্চ থেকে অবতরণ করলেই তাঁকে গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু তাদের আশার গুড়ে বালি দিয়ে মোনাজাতের ফাঁকে তিনি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যান। সৈন্যরা তাঁকে খুঁজে পেলনা। অতঃপর ক্ষুব্ধ হয়ে সরকার তাঁর উপর সরাসরি গুলির নির্দেশ জারি করে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা আবশ্যক যে কারও উপর সরাসরি গুলির নির্দেশ থাকার পরও আত্মগোপনে না গিয়ে সভা সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে আর স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। তবুও তিনি আত্মগোপনে না গিয়ে সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিতে থাকলেন। কিছু দিন পর নওয়াগাঁও জেলার লংকা নামক স্থানে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণকালের মহাসমাবেশ। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর অমিত সাহস নিয়ে উক্ত মহাসমাবেশে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দেন এবং সভা শেষে জনস্রোতের সাথে মিশে সভাস্থল ত্যাগ করেন। সরকারী সৈন্যরা তাকে গুলি করার সুযোগও পায়নি। এরকম আরও অসংখ্য অগণিত ঘটনা রয়েছে যা তাঁর অসম সাহসিকতার প্রমাণ বহন করে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অহংবোধ, দাম্ভিকতা, পরনিন্দা, পরচর্চা, ছিদ্রান্বেষণ এবং বিপদ-আপদে অস্থিরতা প্রকাশ ইত্যাদি ত্র“টি বিচ্যুতির স্বভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। অত্যন্ত ধীরস্থির চিত্তে ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার সাথে প্রতিকূল পরিবেশকেও নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে তাঁর কোন জুড়ি ছিলনা। শত সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতেও তাঁর নুরানী মুখমণ্ডলে মলিনতার কোন ছাপ দেখা যেতনা। তিনি অতিথিপরায়ণ ও গুণগ্রাহী মহান ব্যক্তি ছিলেন। গুণীজনকে তিনি খুবই কদর করতেন। এ কারণে আলেম, উলামা, জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত, গবেষক ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ সর্বদাই তাঁর নিকট যাতায়াত করতেন। তিনি প্রায়ই এদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। কথা ও কাজে তিনি ছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের মূর্ত প্রতীক। প্রতিশ্র“তি রক্ষায় তিনি ছিলেন অগ্রগামী। একবার তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামীয়ার সাংগঠনিক কাজে কিছু অর্থের প্রয়োজন দেখা দিলে এ অধম কিছু কর্মীসহ তাঁর সুযোগ্য নাতি জনাব গিলমান আহমদ চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর খেদমতে হাজির হলাম। সালাম কদমবুছি ও কুশল বিনিময়ের পর আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে আমি তা বললাম। তিনি আমার কথা শুনে এমন কিছু উপদেশ দিলেন যা শুনে আমাদের মনে দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস জন্মিল যে সহজেই আমাদের অর্থের প্রয়োজন মিটে যাবে। সবশেষে তিনি বললেন আমি তোমাদেরকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করব। এখন আমার কাছে দু’হাজার টাকা আছে, এটা নিয়ে যাও। সেদিন ছিল রোববার। বললেন পরবর্তী রবিবারে বাকী তিন হাজার টাকা এনে নিয়ে যেও। কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহের শনিবারেই অবশিষ্ট টাকা তিনি দিয়ে দিলেন। প্রতিশ্র“তি পূরণের কী অপূর্ব নিদর্শন।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সত্য ও ন্যায়ের প্রতি ছিলেন অবিচল ও নির্ভিক। দানশীলতা ও ন্যায় পরায়নতা ছিল তাঁর ভূষণ। তাঁর দানশীলতা ছিল এমনই যে, তিনি তাঁর সম্পত্তির এক বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর ভূমি) দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। আর এটাই তাঁর দানশীলতার সর্বোচ্চ উপমা নয় বরং এ নিবন্ধকের মনে হয় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সুযোগ্য সাতজন ছাহেবজাদা, প্রাণাধিক প্রিয় নাতী-নাতনীদেরসহ সুযোগ্য উত্তরাধিকারীদের সকলকেই আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর এসব নিঃস্বার্থ দানের বিনিময়ে পরকালে তাকে যেন উচ্চ মাকাম দান করেন।
এ মহান বুযুর্গ ও আত্মাধ্যিক রাহবারের যে গুণটি ধর্ম-বর্ণ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মানুষকে আকর্ষণ করত সেটা হল তিনি ছাত্র-শিক্ষক, মুরিদান, মুহিব্বীন ও মুতাআল্লীকিন সকলের সাথে আচরণের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতেন। তাদের অভাব অভিযোগ এবং দাবী-দাওয়া অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সহানুভূতি সহকারে শ্রবণ করতেন এবং বিচক্ষণতার সাথে তা সমাধান করতেন। প্রত্যেকেই ভাবত তিনি অন্যদের তুলনায় তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, চলা-ফেরার স্বভাব প্রকৃতিতে তিনি সর্বদা সুন্নাতে নববীর প্রতি খেয়াল রাখতেন। আল্লাহ তায়ালার খাছ এবং মনোনীত ব্যক্তিদের যে সকল আকর্ষণীয় গুণাবলী থাকে তা তাঁর মাঝে পুরোপুরি বিদ্যমান ছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদব-আখলাকের মূর্তমান দৃষ্টান্ত তাঁর মাঝে পেয়ে অসংখ্য অগণিত বনী আদম তাঁর নিকট ইলমে মারিফাতের দীক্ষা লাভ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছেন। প্রত্যেক সাক্ষাৎ প্রার্থীই তাঁর সুমধুর-মনোমুগ্ধকর অথচ শরীয়ত সম্মত কথাবার্তায় তাঁকে একজন হৃদয়বান অভিভাবক, বিচক্ষণ শুভাকাঙ্খী, নির্ভরযোগ্য আমানতদার ও সঠিক পথের দিশারী ভাবত। তাঁর শান্ত-সৌম্য নূরানী চেহারা, মাধুর্যপূর্ণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও অকৃত্রিম ব্যবহার এবং গাম্ভির্যতা অবলোকন করলে সর্ব সাধারণের মনে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে স্বতঃস্ফুর্ত আকাঙ্খা জাগত।
এ মহামনীষীর সময়ানুবর্তিতার বিষয়টি ছিল সবার জন্য শিক্ষণীয়। শেষ বয়সে প্রতি সপ্তাহের শনি ও রবিবার বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসায় কামিল জামাতের ছাত্রদের বোখারী শরীফের দরস দিতেন। এ অধম প্রায় দুই বৎসর তাঁর নিকট বোখারী শরীফের অধ্যয়ন করেছি। ঘড়ির কাঁটা যখন নয়টায় পৌঁছত তখনি তিনি ক্লাসে ঢুকতেন এবং পুরো এক ঘন্টা দরস দিয়ে সকাল দশটায় শেষ করতেন। দুই বৎসরের মধ্যে একদিন অসুস্থতার কারণে একটু ব্যতিক্রম ছাড়া আর কোন ব্যতিক্রম আমি দেখিনি। অসুস্থতাজনিত ব্যতিক্রমধর্মী সেই ঘটনাটা এখানে উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে ভেবে তা উল্লেখ করছি। সেদিন ছিল রোববার। তাঁর নির্ধারিত দরস গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলত। কে কার আগে ক্লাসে পৌঁছবে। ঐদিন আমরা সকলেই পৌনে নয়টায় ক্লাসে উপস্থিত। ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যখন নয়টার কাঁটা পেরিয়ে গেল অথচ ছাহেব কিবলাহ তাশরীফ আনেননি দেখে সকলের ভেতর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। পরে অসুস্থতার খবর শুনে সকলে মিলে যখন তাঁকে দেখতে গেলাম তখন আমাদেরকে দেখেই তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। এরপর বললেন আমি ভীষণ অসুস্থ, চেষ্টা করেও মাথা তুলতে পারিনি। যার ফলে তোমাদের দরসেও যেতে পারিনি। আমার জন্য দোয়া করো, যেন ঈমানের সাথে মওত নসীব হয়। তাঁর কথা শুনে আমরাও কাঁদতে শুরু করলাম এবং বললাম- ‘ছাব! আমাদের জন্য আপনি দোয়া করবেন।’ তিনি বললেন- ‘তোমরা আমার বাগানে ফোটা ফুল। আমি তোমাদের জন্য দোয়া করব নাতো কার জন্য দোয়া করব?’ অতঃপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ মোনাজাত করে বিদায় দিলেন। এই একদিন একটু ব্যতিক্রম ঘটেছিল তাও ভীষণ অসুস্থতার কারণে। তিনি এভাবেই সময়কে গুরুত্ব দিতেন।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন এক উঁচু স্থরের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর কামালিয়াতের স্থর এমনই ছিল যে তা লেখায় বুঝানো দুঃসাধ্য। তাঁর থেকে অসংখ্য কারামত প্রকাশিত হয়েছে। এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে কারামত আলোচনা করাও আদৌ সম্ভব নয়। যদি ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ¯েœহধন্য কোন ব্যক্তি তাঁর জীবন ও কর্ম বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনায় এগিয়ে আসেন তবে তা জাতির এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
পরিশেষে বলা যায় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একাধারে শ্রেষ্ঠ তাফসীরকারক, নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার, দরদী সমাজ সেবক, তরীকত পন্থীদের রাহবার, সত্যান্বেষী জ্ঞান তাপস, জ্ঞানীদের দীপ্তিমান সূর্য, একজন প্রকৃত নায়েবে নবী। এক ব্যক্তির চরিত্রে এমন অসংখ্য মহৎ গুণের সমাহার সত্যিই বিরল।
Check Also
নালায়ে কলন্দর : পূত হৃদয়ের নান্দনিক ছন্দবদ্ধ অভিব্যক্তি
মাহবুবুর রহীম আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) রচিত উর্দুভাষার কাব্যগ্রন্থ ‘নালায়ে কলন্দর’। ‘কলন্দর’ হচ্ছে কাব্য …