প্রিয়ন্তির সারাবেলা

মা প্রিয়ন্তি একটু রান্নাঘরে যাও তো, ভাতটা মনে হয় পড়ে যাচ্ছে।
প্রিয়ন্তি যেখানেই থাকুক মা রামিশার কথা শুনেই দেয় দৌড় রান্না ঘরে। প্রিয়ন্তিরা তিন বোন, একজন একেক ধরণের। বড় বোন মিনতি পুরোটাই আলসিয়ে, এপাশ থেকে ওপাশ যেতেই তার সময় পার হয়। ছোট বোন পিনু কথায় পটু। কাজকর্মে বা পড়াশোনায় কোন মন নেই, সারাক্ষণ মুখে পট পট করে। ওর জন্যে কারো কথা মাটিতে পড়তে পারেনা। জবাব যেনো ওর মুখেই জমা হয়ে থাকে। আর প্রিয়ন্তি একেবারেই আলাদা। পড়ালেখায়ও ভালো। প্রিয়ন্তির সব চেয়ে আসল গুণ হলো ও খুব গুছানো। ঠিক বড় বোন মিনতির উলটো। নিজেতো কোন কাজ করবেই না, বরং ছোট বোনদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিবে।
পিনুকে কিছু বললে সে মুখের উপর বলে দিবে,,,
— তুমি বড়,তুমি আগে কাজ করো,পরে আমি করবো। আর কাজ কি করে করতে হয় আমায় শিখিয়ে দাও। তারপর করবো।
মিনতি তেমন সুযোগ করতে পারে না। পেছন দিয়ে প্রিয়ন্তিকে ডাকে,,,
— লক্ষী বোন আমার, আমার জন্যে একটু লেবুর শরবত করে নিয়ে আয়।
প্রিয়ন্তি মাঝে মাঝেই না বলে,কিন্তু না করে থাকতে পারেনা। ওর যে দয়ার শরীর। মা রামিশা প্রিয়ন্তির মাঝে নিজের মেয়েবেলা খুঁজে পায়। মেয়েবেলায় সেও এমন ছিলো। মিনতি কোন কাজ করেনা টেবিল গুছিয়ে রাখেনা কাপড় চোপড় ঠিক করে রাখেনা রামিশাকে সারাক্ষণ এগুলো করতে হয়। ঠিক তখনি মিনতি আবার ওকে ক্ষেপায়,,,
— প্রিয়ন্তি, প্রিয়ন্তি, দেখ মা আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। মা আমার টেবিল গুছিয়ে দেয়,মা আমার কাপড় ইস্ত্রি করে দেয়, আমার সব করে। আর তোর কিচ্ছুই করেনা।

তখনি প্রিয়ন্তির মন খারাপ হয়, একা বসে কি জানি ভাবে। রামিশা প্রিয়ন্তিকে দেখলেই বুঝে যায় নিশ্চয়ই মিনতি কিছু বলেছে। তখনি মিনতিকে দেয় বকা। বকা শুনে প্রিয়ন্তির মনটা হালকা হয়।
সকালে স্কুলে যাবে বলে প্রিয়ন্তি রাতে ঘুমানোর সময় ব্যাগ ঘুছিয়ে রাখে, ওয়ারড্রব এর উপরে স্কুল ড্রেস মোজা সহ সব রেডি করে রাখে। চুল বাঁধার জন্যে সাদা ফিতেটাও যতœ করে রাখে। নিজেই ঘড়িতে এলার্ম দেয়, ঠিক সময়ে উঠে নিজেই রেডি হয়। মাথায় চিরুনি দেয়। এর মাঝে মা উঠে এলে বেনি গেঁথে নেয়। আর মায়ের ব্যস্ততা দেখলে নিজেই চেষ্টা করে বেনি গাঁথার। স্কুলে যাবার পথে ব্যাগটা নিজেই কাঁধে নেয়।
আর মিনতি ঠিক ওর উলটো। সকালে উঠাতে হয় ধাক্কাতে ধাক্কাতে, ঊঠে ওয়াশরুমে বসেও সে ঘুমায়। সেখান থেকেও তাকে ডেকে আনতে হয়। স্কুল ড্রেস পরবে তো, জামা আছে বেল্ড নেই। বেল্ড আছে তো মোজা নেই। সব খুঁজে খুঁজে এনে দেয়ার পর দেখা যাবে ওর জুতাই খুঁজে পাওয়া যায় না। অত:পর খাটের নিচ থেকে বের হয় ওর জুতো।
মা রামিশা আগেই বলে দিয়েছে স্কুল থেকে এসে কি করবে। প্রিয়ন্তি তাই করে, গায়ের ড্রেসটা বারান্দায় রোদে শুকাতে দেয়, আর মিনতির জামা এক জায়গায় তো, সেলোয়ার অন্য জায়গায়। মোজা একটা টেবিলের উপর আরেকটা জুতোর ভিতর।
মা সারাদিন খেটে খেটে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, প্রিয়ন্তি এসে বলবে,,,
— মা, তোমার পা একটু টিপে দিব।
মেয়েটার এমন কথা শুনে মায়ের শরীরের কষ্ট দূর হয়ে যায়।
আর মিনতিকে কাজের জন্যে ডাকলে আসতে আসতেই সময় চলে যায়। আসলেও বিভিন্ন বায়না তার লেগেই থাকে। মিনতির টেবিলটা অনেক ময়লা হয়ে আছে, রামিশা সব বই সরিয়ে সাবান পানি দিয়ে এটা পরিষ্কার করে আর ভাবে,,,
এই ভাবে কবে প্রিয়ন্তির টেবিল পরিষ্কার করেছে মনেই নেই। প্রিয়ন্তি নিজেই সব করে রাখে। ঠিক তখনি প্রিয়ন্তি আসে,,,
— তুমি সারাক্ষণ ওর কাজ করো কেনো। ক্লান্ত হয়ে যাবে যে।
— আমি তো তোর কাজ করতে হয়না, আমার কিচ্ছু হবে না।
কাজের মাঝে প্রিয়ন্তি দৌড়ে আসে মায়ের কাছে,,,,
— মা, ও মা, তুমি কি আমায় ভালোবাসো। মা প্রিয়ন্তির মুখের দিকে চেয়ে উত্তর দেয়। মাঝে মাঝে বলে,,,
— ভালোবাসি এই একটু খানি।
হি হি হি করে হেসে চলে যায় প্রিয়ন্তি।
আবার অনেক সময় রামিশাকে বলে,,,
— ভালোবাসি মানে, এই এত্তখানি ভালোবাসি।
প্রিয়ন্তি তখনো হি হি হি করে হেসে অন্য রুমে চলে যায়। শুধু যে মা কে বলে তা নয়, বাবাকে বোনকে সবাইকে বলে। বাবা সব সময় একই জবাব দেয়। প্রিয়ন্তি জানে বাবা যে একই জবাব দিবে। যেই জবাব পায় তাই নিয়েই খুশি থাকে। সারারাত মায়ের পাশে না ঘুমাতে পারলে ওর ইচ্ছে করে ভোর বেলায় যেনো মা ওর পাশে এসে শুয়ে থাকে। রামিশা তাই করে, তখন প্রিয়ন্তি মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাবার ভান করে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *