আমারও একটি লাঠি এবং জায়নামাজ আছে। আমার লাঠিটি দিযে় ছোট খাট সবই করা যায়; কিন্তু এটি নিক্ষেপ করলে ‘সাপ’ হযে় যায় না; এমনকি নদীতে আঘাত করলে জলতরঙ্গের ওপর মহাসড়কও হযে় যায় না। অথচ মূসা (আ.) একই কাজ করলে সেটি ‘সাপ’ও হযে়ছিল, রাস্তাও হযে়ছিল। তাহলে আল্লাহর রাসূল মূসা (আ.)-এর এমন অস্বাভাবিক বিষয়টিকে কি বলতে হবে? মুজেযা।
আর আমার জায়নামাজটি কিছুদিন পরপর আমি ধৌত করি। পানিতে ছেডে় দিলে ভিজে চুপচুপ; তারপর ডুব। কিন্তু হযরত শাহজালাল (র.) এর জায়নামাজ তো সুরমা নদীতে ডুবে গিযে়ছিল না! এটিকে কি বলবেন? কারামাত। পার্থক্যটি সহজ ও সুস্পষ্ট অলৌকিক বিষয় নবী রাসূল থেকে প্রকাশ পেলে বলা হয় মুজেযা। অলীদের থেকে হলে কারামাত।
এছাড়া? এছাড়াও হতে পারে ‘সিহর’ বা যাদু। মূসা (আ.) এর বিরুদ্ধে ফেরাউনের যাদুকরেরা রশি দিযে় সাপ বানিযে়ছিল। এটি যাদু।
মুজেযা, কারামত এবং যাদু দেখতে প্রায় একই রকম। পার্থক্য হচ্ছে, ব্যক্তির কারণে। মুজেযা আর যাদু কাউকে অস্বীকার করতে দেখিনি। তবে অস্বীকৃতি আর অতি-অন্ধ-ভক্তি দেখেছি কারামত নিযে়। কারামত নিযে় কৌতুহল আমারও আছে। কৌতুহল কি দোষের? হ্যাঁ। তবে আমার অরুচি বাড়াবাডি়তে।
কারামত নিযে় কথা হলো এক ভদ্র লোকের সাথে। ভদ্রলোক এমন একটি সংগঠনের পদস্থ ব্যক্তি, যেখানে লেখা-পড়া করতে হয়। তিনি আবার হাফেজও বটে। মনে হলো দরবারী মুরীদগণের কারামাত-ভক্তিতে বিরক্ত হযে়ই তিনি এটি অস্বীকার করতে বসেছেন। কথা হলো এরকম
ঃ ইসলামে কি আসলে কারামত বলে কিছু আছে? এসব তো পীরদের মধ্যেই শুনি। সাহাবীদের তো নেই!
ঃ কারামত সাহাবীদেরও ছিল। হযরত ওমর (রা.) মিম্বরে জুমার খুতবার ভেতরে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলেছিলেন, ‘ইয়া সারিয়াহ! আল-জাবাল!! হে সেনাদল! পাহাড় থেকে সতর্ক হও। মানে আড়ালেই শত্রু! ৩০০ মাইল দূর থেকে সে আওয়াজ শুনে সতর্ক হলেন মুসলিম সেনাপ্রধান।
ঃ এটা তো হাদীস! কুরআনে কারামতের সমর্থন আছে?
ঃ হযরত মরিয়ম (আ.) এর জন্য বেহেশতের খাদ্য বাইতুল মুকাদ্দাসের মেহরাবে!
ঃ এটা তো নবীর মাযে়র ঘটনা …
আসলে অকাট্য উপমা ও দলীল দেখানোর পরও লোকটি স্বস্তি পাচ্ছিল না তাহাদের সাংগঠনিক রোগের কারণে। আবার এর বিপরীতে এমন ব্যক্তিও রযে়ছেন, যাদের নিকট ইসলামের অনেক জরুরি ফরজ বিষযে়র চেযে়ও কারামতের বয়ান করা ও শোনাই মুখ্য। এতে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কারামত কি অনিবার্য? কারামত কি চাইলেই দেখানো যায়?
এ প্রসঙ্গে বাযে়জীদ বোস্তামী (র.) বলেন, তুমি যদি কাউকে দেখ যে, সে পাখির মতো আকাশে উড়ছে। এ দেখেও তুমি প্রতারিত হযে়া না। তাকে বুজর্গ বলে ডাকলে ভুল হবে। পাখি সব সময় আকাশে ওডে়। তাই বলে কি পাখিকে বুজর্গ বলা যাবে? সামান্য পাখি যে কাজ করতে পারে, সৃষ্টির সেরা মানুষ তা করতে পারলেই কি বুজর্গ হযে় যাবে? অবশ্যই নয়। বরং দেখবে তার দৈনন্দিন জীবনে আল্লাহ পাকের হুকুম আহকাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্ধারিত সীমার মধ্যে তার সমস্ত কাজ সম্পাদিত হয় কি না। লোক শরীয়তের নিয়ম নীতি সম্পূর্ণভাবে মেনে চললে তার থেকে কোন কারামত সংঘটিত না হলেও তাকে অলিযে় কামেল মনে করতে হবে। আর যদি দেখা যায়, তার দ্বারা শরীয়তের নিয়ম-কানুন ঠিকমত পালন হয় না অথচ সে মুহূর্তের মধ্যে অনেক অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন করতে পারেন, তবে তার নিকট থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবে। কারণ, সে যাদুকর হতে পারে। তার সাহচর্যে গেলে শিষ্য হিসেবে পরিগণিত হবে।
এবিষযে় হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) আবুল কাশেম সুরগানী (র.) এর উদ্ধৃতি দিযে় বলেন, পানির ওপর দিযে় হেঁটে যাওয়া, বাতাসে উডে় যাওয়া, গোপন বিষয় অবহিত করা কারামত নয়; বরং আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে সর্বোতভাবে পরিচালিত করাই প্রকৃত কারামত। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক কাজে শরীয়তের অনুকরণ করে চলা এবং কোন অবস্থায়ই শরীয়তের বিরোধিতা না করাকে কারামত বলে। তিনি আরও বলেন, শয়তানের সহায়তায় অনায়াসে পানির ওপর দিযে় চলে যাওয়া যায়। যাদুকরও অলৌকিক ঘটনা দেখাতে পারে। এসব কারাতত নয়। তাই তুমি নিজ অস্তিত্ব ও আমিত্বকে বিসর্জন দিযে় এবং সকল প্রকার কৃপ্রবৃত্তি দমন করে যদি শরীয়ত অনুযায়ী চলতে পার, তবে বাঘের পিঠে ভ্রমণ করলেও কোনো দোষ নেই। আবার তুমি যখন তোমার কুরীপুকে আয়ত্বে এনেছ, এখন কারো গোপন বিষয় বলতে না পারলে, মুহূর্তের মধ্যে দুর্গম মরু অতিক্রম করতে না পারলেও তোমার নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাধারণ মানুষ এ সূক্ষ্ম তত্ত্ব বুঝতে পারে না। কারণ, তারা বাহ্যিক ও স্থূল ব্যাপার নিযে়ই ব্যস্ত থাকে।
এক লোক হযরত জুনাযে়দ বাগদাদী (র.) কে বললেন, হুজুর! লোকজন বলাবলি করে, আমরা পৌঁছে গিযে়ছি। অর্থাৎ, তারা বলতে চায় যে, তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছি। অতএব, এখন আর নামায-রোযার প্রযে়াজন নেই। হযরত বাগদাদী (র.) বললেন, যারা এগুলো বলে, তারা জাহান্নামে পৌঁছে গেছে; আল্লাহর নিকট পৌঁছতে পারেনি।
অতএব, কারামত যদিও সত্য; যেমনটি আকাইদে নাসাফীতেও বলা হযে়ছে কারামাতুল আওলিয়াযে় হাক্কুন, তদুপরি, এর চেযে় শরীয়তের আমল ও আকীদাকেই মুখ্যরূপে গুরুত্ব দিতে হবে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কারামত নিযে় আগ্রহ থাকায় দোষের কিছুই নেই। আল্লাহুম্ম আরিনাল হাক্কা হাক্কান ওয়ারযুকনা ইত্তেবায়াহ। আমীন!
Check Also
‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.
মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …