মিরাজের পবিত্র সওগাত

বিশ্বনিয়ন্তা মহান আল্লাহর দরবারে অযুত কোটি শোকরিয়া, যিনি আমাদেরকে তাঁর পিয়ারা হাবীব মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন। তিনি নবীদের নবী, রাসূলগণের রাসূল, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম সুন্দর। তাঁরই উম্মত হওয়ার জন্য অন্যান্য সব নবী রাসূলগণ তৃষার্ত ছিলেন চাতক পাখির মত। তাঁরই পবিত্র পরশে দুর্ধর্ষ আরব জাতি সোনার মানুষে পরিণত হযে়ছিল। তাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে অসংখ্য অগনিত মু‘জিযা সংঘটিত হযে়ছিল। তম্মধ্যে মি‘রাজ শরীফ হচ্ছে তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের অন্যতম একটি কালজয়ী মু‘জেযা।
মি‘রাজ শরীফে গিযে় নবীজি সরাসরি তাঁর প্রেমাস্পদের দীদার লাভে ধন্য হন। আল্লাহর দীদারের অতৃপ্ত বাসনা নিযে় যেখানে মুসা (আ:) তূর পর্বতে তাঁর কুদরতের একটুখানি নূরের তাজাল্লি দেখে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বেহুশ হযে় পডে়ছিলেন, সে সময় তূর পর্বতে মুসা (আ:) কে জুতা খুলতে হযে়ছিল। কিন্তু, আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে দাওয়াতপ্রাপ্ত হযে় আরশে আজীমে তার জুতা মোবারক নিযে়ই পরম প্রিয় বন্ধু আল্লাহর দীদার লাভ করেন গভীর ভাবে। সেদিন নবীর জুতা মোবারকের ধুলিকণায় আরশে আজীম ধন্য হযে়ছিল। আসমানে আরোহণের পূর্বে বায়তুল মোকাদ্দাসে সকল নবী রাসূল তাঁর পিছনে নামায আদায় করে তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন অবলীলায়। উম্মতের কান্ডারী, দরদী নবী মহান মালিক মাওলার সাথে মহামিলনের পরম আনন্দঘন মুহুর্তেও তাঁর মায়ার উম্মতকে ভুলে যাননি, বরং আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতে শরীক করেছেন। উম্মতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে উপটৌকন পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিযে় এসেছেন, যা পরিপূর্ণভাবে পালন করলে আল্লাহর দীদারের নিয়ামত লাভ করার পাশাপশি পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সাওয়াব আমলনামায় সংযুক্ত হয়।
নবুওয়াতের দশমবর্ষে একমাত্র আশ্রয়স্থল চাচা আবুতালিব ও প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-কে হারিযে় শোকে মুহ্যমান হযে় পড়লেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তবুও এই শোক বিহবল অন্তর নিযে় ইসলাম প্রচারে তাঁর বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু মক্কাবাসীদের কাছ থেকে ইসলাম গ্রহণে আশানুরূপ সাড়া না পেযে় তাওহীদ ও রিসালাতের সুমহান বাণী নিযে় হাজির হলেন তাযে়ফে। সেখানের নিষ্ঠুর লোকেরা ইসলামগ্রহণ তো দূরের কথা বরং তাঁকে নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ঠ করে তাঁর পবিত্র নূরানী বদন থেকে রক্তের ঝর্ণাধারা বহাল। দুষ্টু ছেলের দল পিছু লেগে তাঁকে পাথর বৃষ্টি মারল। রক্তাক্ত আহত শরীর মোবারক নিযে় অতি কষ্ট করে ফিরে এলেন মক্কায়। একদিকে আপনজন কেউ নেই। অন্য দিকে কাফিরদের পক্ষ থেকে লোমহর্ষক নির্যাতন। সব মিলিযে় দুঃখ-কষ্টের অকুল সায়রে ভাসতে লাগলেন প্রিয় নবী। ঠিক তখনি রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় বন্ধু রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রন পাঠালেন। সুপ্রসিদ্ধ বর্ণনানুযায়ী- নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে রজব মাসের ২৭তম রাতে নবীজির মি‘রাজ সংঘটিত হয়। পবিত্র কা‘বা ঘরের নিকটবর্তী উম্মে হানীর ঘর থেকে মোবারক এ সফরের শুভ সূচনা ঘটে।
জিবরাঈল (আ:) বেহেশতি পোশাক ও কুদরতী বাহন ‘বোরাক’ নিযে় হাজির হলেন। প্রযে়াজনীয় কাজ সেরে আল্লাহর দেয়া পোশাক পরিচ্ছদ পরে বোরাক যুগে পৌঁছে গেলেন বায়তুল মোকাদ্দাস। সেখানে দু’রাআত নামায আদায় করেন। অত:পর আবার যাত্রা শুরু করে ক্রমান্নযে় সাত আসমান অতিক্রম করেন এবং বিভিন্ন নবীদের সাথে সাক্ষাত করে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’য় পৌঁছান। সিদরাতুল মুনতাহা এসে সফরসঙ্গী জিবরাঈল (আ:) আর সামনে আগাবার অনুমতি পেলেন না। তাই এবার সবুজ রঙের বাহন ‘রফরফ’ এ আরোহন করে নবীজি একাকী রওয়ানা দিলেন মাশুক মাওলার দরবারে। পৌঁছে গেলেন প্রেমাস্পদের অতিকাছে, একেবারে সন্নিকটে।
আল্লাহপাক প্রিয় বন্ধুকে একান্ত সান্নিধ্যে পেলেন। উভযে়র মধ্যে সালাম আদান- প্রদান হল। আল্লাহপাক যখন নবীকে বললেন-‘হে নবী! আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।’ তখন সাথে সাথে দয়াল নবীজি তাঁর উম্মতকে দুআয় শামিল করে বললেন-‘আপনাদের উপর এবং আল্লাহ্র নেক বান্দাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ নবীজি দুআয় উম্মতকে শামিল করার পাশাপাশি তাদের জন্য নিযে় এলেন এক মহা মূল্যবান নিয়ামত পাঁচওয়াক্ত নামায। মি‘রাজ যেভাবে সকল পর্দা ছিন্ন করে মাওলাযে় হাকীকির সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটিযে়ছিল তদ্রুপ মুমিন বান্দার চিরস্থায়ী মি‘রাজ নামায তাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয় সহজেই। নবীজি তো বলেছেন- ‘নামায মুমিনের মি‘রাজ স্বরূপ।’ কিন্তু আমরা কি আমাদের নামাযকে মি‘রাজ করতে পেরেছি? নামাযে দাঁড়ানো মাত্রই আল্লাহপাকের ধ্যান-খেয়ালের পরিবর্তে দুনিয়াদারীর উদ্ভট সব চিন্তা-ভাবনা এসে বাসা বাঁধে অন্তরে। আমরা যদি একমাত্র আল্লাহপাকের ধ্যান-খেয়ালে মশগুল হযে় নামায আদায় করতে পারি তবেই আমাদের নামায মি‘রাজ হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মি‘রাজে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখানো হযে়ছে। জান্নাতে তিনি গরীব মানুষকে বেশি দেখেন ও জাহান্নামে মহিলাদের বেশি দেখেন। তাই আমাদের সকল কাজ-ই আল্লাহ তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে হবে। এই শপথে বলিয়ান হযে় আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রে সব অন্ধকার ও তাগুতি উপডে় ফেলি, চির শান্তি ও মুক্তির গ্যারান্টি ইসলামকে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করি। তবেই মি’রাজের স্বার্থকতা লাভ হবে, ধন্য হবে আমাদের জীবন ও জগত। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর প্রিয় হাবীবের উসিলায় কবুল করুন। আমিন।

Comments

comments

About

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *