মানুষ যখন পশুর অধম

মানুষ যখন পশুর অধম হয়, তখন সে হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতায় পশুকেও হার মানায়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অথচ সেই মানুষ কখনও-কখনও পশুর চাইতেও নিকৃষ্ঠ কর্ম করে। একই জাতিয় পশুরা প্রায়শ: নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব রক্ষা করে চলে। নিজেদের মধ্যে এরা তেমন হিংস্র হয় না। একজাতীয় পশু একে অপরকে হত্যা করে না। এসব করে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষেরা। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-সভ্যতায় মানুষের দৈনন্দিন অগ্রগতি হচ্ছে। বলা হয়, মানুষ সভ্য এবং আধুনিক হচ্ছে। যা-ই হোক, মানুষের মধ্যে হিংস্রতাও যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা’ বলা-ই যেতে পারে।
আমাদের বাংলাদেশের ঘটনা থেকে শুরু করি। সেই নবাবি শাসনামলের কথা। তখন এদেশে মহারাষ্ট্রের মারাঠা দস্যুরা এসে লুঠতরাজ করতো, মানুষ হত্যা করতো। এই দস্যু দলের নেতার নাম ছিল ভাস্করপণ্ডিত। নিশ্চয় বিদ্বান, বুদ্ধিমান; কিন্তু পেশা এবং নেশা ছিল লুণ্ঠন এবং নরহত্যা। এই দস্যুদলকে বলা হতো বর্গী। সেই কারণে তাদের হামলাকে বলা হতো বর্গীর হাঙ্গামা। সেকালে বাংলায় একটি ছড়া প্রচলিত হয়েছিল এরূপ-
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
‘বর্গী এলো দেশে,
খাজনা দেবো কিসে?
ধানফুরালো, পান ফুরালো
খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর করো
রসুন বুনেছি।’
এ-ছাড়াও ছিল বার্মার মগ দস্যুদের অত্যাচার। তারা এই অঞ্চলে এসে লুঠতরাজ করতো, মানুষ হত্যা করতো, অপহরণ করতো। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ লোকেরা উপদ্রুত অঞ্চলকে বলতো মগের মুলুক। ‘মগের মুলুক’ এখন বাংলাভাষায় বিশিষ্টার্থক শব্দের তালিকায় স্থান পেয়েছে। মগের মুলুক বলতে বোঝানো হয়-যেখানে অরাজকতা বিরাজ করছে এবং কোনো আইন শৃঙ্খলার বালাই নেই। ইতিহাসে জানা যায়, বাংলার নবাব আলীবর্র্দী খাঁ বর্গী এবং মগ দস্যুদের দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ-ছাড়াও ছিল পর্তুগীজ জলদস্যু ও ঠর্গীদস্যুদের অত্যাচার। সেকালে এদের কারণে মানুষ অশান্তিতে ভুগতো।
বার্মা (ব্রহ্মদেশ) এখন মিয়ানমার (মায়ানমার) নামে পরিচিত। এই দেশে একটি প্রদেশের নাম রাখাইন প্রদেশ। রাখাইন নামে এক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। এককালে এর নাম ছিল আরাকান। এটি একসময় একটি পৃথক রাজ্য হিসেবে শাসিত হতো। এখানে মগ সম্প্রদায়ের রাজারা রাজত্ব করতো। কখনও কখনও আরাকান রাজ্য মুসলমান কর্তৃক শাসিত হতো। ষোড়শ শতাব্দীর অন্যতম মুসলমান কবি আলাওল আরাকান রাজসভার সম্মানিত কবি ছিলেন। তিনি এখানে থেকেই বিখ্যাত হিন্দি মহাকাব্য ‘পাদুমাবৎ’ বাংলায় অনুবাদ করেন ‘পদ্মাবতী’ নামে। এ-ছাড়াও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শাহজাহানকে বন্দী করে সিংহাসন দখল করেন, তখন সম্রাটের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সূজা বাংলাদেশের শাসনকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। আওরঙ্গজেবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী দারাসিকোকে হত্যা করায় বাংলাদেশে থাকতেও সুজা সাহস করলেন না। তিনি সপরিবারে আরাকানে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি সিপাহী বিদ্রোহের পরাজয়ের পর ইংরেজ কোম্পানী কর্তৃক বন্দী হলে তাকে বার্মার রেংগুন শহরে নির্বাসিত করা হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রেংগুনেই তাকে সমাহিত করা হয়। প্রায় সাড়ে তিনশত বছর মোঘলেরা মহা প্রতাপে ভারত শাসন করলেও শাসন ক্ষমতা হারানোর পর এই বংশের কোনো অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায়নি। এ দেশে পরাজিতদের পরিণতি এমনিই হয়।

আরাকানে এক সময়ে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরীষ্ঠ। এদেরকে বলা হয় রোহিঙ্গা মুসলমান। এরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে সে দেশের সামরিক সরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসীরা নাগরিকত্ব পায়। ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পাওয়া আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশে আসেন সে দেশের সরকার কর্তৃক হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্তি নিয়ে। আর মিয়ানমারের হাজার হাজার বছরের বসবাসকারী রোহিঙ্গারা সে-দেশে নাগরিক নয়, বহিরাগতও নয়; যেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। তাই তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে সে-দেশের সেনাবাহিনী। অনেক দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয় সংখ্যাগুরুদের দ্বারা। সেখানে সরকারের পুলিশ-বাহিনী তাদের নিরাপত্তা দেয়। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। মিয়ানমারে মুসলমানকে দেশ থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারা অনুপ্রবেশকারী। তাই তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। তাদের দোকান-পাট লুণ্ঠন করা হচ্ছে। তাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাখাইন মগেরা, যাদের পূর্বপুরুষেরা বাংলাদেশে দস্যুতা করতো, মানুষ হত্যা করতো, অপহরণ করতো। ভাবাই যায় না, মানুষ কেমন করে এমন হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হতে পারে। তাও আবার অহিংস বুদ্ধের অনুসারী বলে পরিচয় দেয় তারা। তাদের বুদ্ধ বলতেন-অহিংসা পরমধর্ম। জীব হত্যা মহাপাপ। এখনতো দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের হিংস্র মানুষগুলোর মতো পশু আফ্রিকার জঙ্গলেও আছে কিনা সন্দেহ। হিটলারের (জার্মানি) নাৎসীবাহিনীকে হার মানিয়ে দিয়েছে এই বর্মী সেনাবাহিনী। দীর্ঘকালের সেনাশাসনের পর বিগত বছর বহু আন্দোলনের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মিয়ানমারে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অংসান সূচীর দল নির্বাচনে বিজয়ী হলেও, সূচী রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা পাচ্ছে না। কারণ, তাঁর স্বামী বিদেশি, ইংরেজ। তাই তিনি শুধু একজন উপদেষ্টা মাত্র। সেই কারণে কিনা, কিংবা মগ বলে কিনা জানি না, তিনিও এই নৃশংস অত্যাচার, নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ নীরবে অবলোকন করছেন, কোনো প্রতিবাদ করছেন না।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর পাশবিক অত্যাচার চলছে দীর্ঘকাল ধরে। বিগত বছরগুলোতে তারা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরনার্থী রয়েছে। তাই সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা নির্যাতনের সময়ে যারা আরাকান থেকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য বাংলাদেশে আসছে, সীমান্তরক্ষী বিজিবি তাদের মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের হাতে ফেরৎ পাঠাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মরিয়ম বেগম বলেন-অবজি আরাবে বর্মার মগর মেলেটারী অক্কলে গইজ্জে, ধন-সম্পদ লুট গরি ফেলাইয়ে। শুদ্ধ বাংলায় বলা যায়-বার্মার সৈন্যরা রোহিঙ্গাদের জুলুম করে, ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, বয়স্কা মেয়েদের উপর অত্যাচার করে, ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। অমতাবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় প্রার্থীরা বিজিবি সদস্যদের বলে-আমাদের গুলি ক’রে মেরে ফেলুন। ওদের কাছে ফেরৎ দেবেন না, ওরা বড়ো অত্যাচার করে। মিয়ানমারে এবার রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা আগের চাইতে অনেক বেড়ে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের সরকারের প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন-রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে। অথচ বিশ্ববিবেক আজ চুপ; কিন্তু আমরা চুপ থাকতে পারি না। আমরা মুসলমান। আমাদের দেশে ১৭ কোটি মানুষ আছে। না হয় আরো ৫০ লাখ লোক বাড়ল। (নয়াদিগন্ত : ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ দ্রষ্টব্য)
আমাদের দেশে যে-সকল বৌদ্ধ মগদের বসবাস, সম্ভবত : তারা ইংরেজ শাসনামলে এ অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করেছে। এদেরই পূর্ব-পুরুষদের বাংলাদেশে লুটপাট করা নবাব আলীবর্দী খাঁ বন্ধ করেছিলেন। নবাবী আমলে তারা এখানে বাসিন্দা হতে আসতো না। লুটতরাজ করতে আসতো। ইংরেজ রাজত্বে বসবাস শুরু করার কারণে একসময়ে তারা এখানের নাগরিক হয়ে গেছে। কে তাদেরকে তাড়ায়? কে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে চাচ্ছে? তারাও তো মানুষ এবং ১০০/১২৫ বছর ধরে অন্তত: তারা এ-দেশে বসবাস করছে। তারা মিশে আছে এদেশের আলো-বাতাস-মাটির সঙ্গে। তারা তাই এদেশেরই লোক। অথচ হাজার হাজার বছর ধরে মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গারা সে দেশের বাসিন্দা বলে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। কেন? তারা মুসলমান বলেই কি সেখানে বসবাসের অযোগ্য?
বস্তুত: আল্লাহর কিতাব আল্ কুরআনে ঘোষিত মুসলমানদের শত্র“রা চায় ইসলামবিহীন বিশ্ব গড়ে তুলতে। বেখবর মুসলমান সব আলামত দেখে শুনে তা’বুঝতে চাইছে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমানদের দেশ ফিলিস্তিনের কিয়দংশ দখল করে যাযাবর ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতিসংঘসহ খ্রিষ্টান রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সেই অবধি অদ্য পর্যন্ত নির্মম কসাই ইহুদিরা মুসলমান বসবাসকারীদের ফিলিস্তিনে হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া। পিএলও নেতা ইয়াসীর আরাফাত দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল আন্দোলন চালিয়ে গতায়ু হয়েছেন। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি জাতিসংঘ, স্বীকৃতি দেয়নি আমেরিকা, রাশিয়া। পাশে দাঁড়ায়নি কোনো মুসলিম রাষ্ট্র। অধূনা দেখা যাচ্ছে যে অমুসলমান মুসলমানদের যতোটা শত্র“, মুসলমান মুসলমানের শত্র“তা এর চেয়ে কিছু কম নয়। যারা (মুসলমান) বিধর্মীর সঙ্গে প্রীতির হাত মেলায় তারা আর মুসলমানদের আপনজন থাকে না। কুরআন পাকেও প্রকারান্তরে তা-ই বলা হয়েছে। বর্তমানে মুসলমানদের উপর দেশে দেশে, বিশেষত মিয়ানমারে অমানুষিক নির্যাতন চলার পরও বিশ্বমুসলিম নির্বিকার। এতেই প্রমাণিত হয় মুসলমানের উপর মুসলমানেরও দরদ নেই। বুঝলাম জাতিসংঘ অমুসলমানদের দখলে, কিন্তু মুসলমানদের সংগঠন ওআইসি কী ভূমিকা নিচ্ছে মিয়ানমারের নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষার জন্য? আছে বহু মানবাধিকার কর্মীদের বিভিন্ন নামের সংস্থা তাদেরই বা ভূমিকা কী? সবাই নীরব। কেননা রোহিঙ্গারা মুসলমান তারা জঙ্গীর জাত। মিয়ানমার সরকারও বলছে-তারা জঙ্গী দমন করছে। এ যেন ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিজগৃহে পরবাসী জীবন-যাপনেরও সুযোগ মিলছে না। তারা জঙ্গীপনা করবে কি করে, সেই দেশের সশস্ত্র বাহিনির সঙ্গে? এটা যারা বিশ্বাস করে তাদের নির্বোধ বললেও কম বলা হয়।
পৃথিবীর সকল দেশেই মুসলমান জঙ্গী। ইসরাইলের ইহুদিরা-মানুষ খুন, অপহরণ, জবর দখল করে অথচ তাদের নেতা আইজাক রবিন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়। নাশকতা, হত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ করলে মুসলমানদের জঙ্গী খেতাব দেওয়া যায়। এটা তারাও মেনে নিয়েছে। এখন মুসলমান মুসলমানকে বলছে জঙ্গী। ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুশরিকদের জঙ্গীপনা হলে সেটা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। তাকে কি আর জঙ্গীপনা বলা যায়?
বিশ্বমুসলিমের প্রতি ফরিয়াদ, তোমরা যদি ইসলামকে পছন্দ করো, তাহলে ইসলাম অনুযায়ী মুসলমানদের ভালোবাস। যেখানে মুসলমানরা বিধর্মীদের অত্যাচারে জর্জরিত, সেখানে যে উপায়ে হোক, তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াও, তাদের পাশে দাঁড়াও। মুসলমানদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অন্তরে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

Comments

comments

About

Check Also

ইডেন লাইফ কষ্টের

ইডেন নিযে় মুখ খুললে শেষ হবে না। কিসের লেখাপড়া? সতিত্ব নিযে় বেঁচে থাকাই দায়। শুধু …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *