আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকার ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। এ পরিসংখ্যান বইয়ের পাতায় দেখলেও বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য খুব কম হয়েছে। জন্ম সিলেটে। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি বছরের একটা সিজনে হাওর এলাকায় ধান উৎপাদন হয়, বাকি বেশিরভাগ সময় শত শত একর জমি খালি পড়ে থাকে। সিলেটের কৃষি বলতে বছরের একটা সময় ধান এবং চা পাতার ব্যাপক উৎপাদন তাছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। সিলেটের মানুষও কার্যত বাংলাদেশের অন্য এলাকার মানুষের সাথে কার্যত বিচ্ছিন্ন তাই কৃষি সম্পর্কে তেমন একটা জানার সুযোগ কখনো হয়নি। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। বিভিন্ন এলাকার বন্ধু-বান্ধবের সাথে পরিচয় হলো, কৃষি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানার সুযোগ হলো। একটা বন্ধুর কথায় বেশ অবাক হলাম। সে আমাকে জানালো তাদের এলাকায় একটি কৃষি খামার আছে যার আনুমানিক আয়াতন ১০০ একর। শুনে প্রথমে বেশ অবাক হলাম। ১০০ একর জায়গাজুড়ে খামার! তাও পেপে, শরিফা, ড্রাগন ফল, লিচু, আমের। বন্ধুটির বাড়ি ঈশ্বরদী। তাই ঈশ্বরদী ভ্রমনের লোভ সামলাতে পারলাম না। সময়ে সুযোগে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে ঈশ্বরদী, পাবনার পথে ছুটে চললাম। ছোটবেলায় পাবনা নাম শুনলেই সবার আগে মনের মধ্যে পাগলা গারদের ছবি ভেসে উঠতো। তবে এবার লক্ষ্য ভিন্ন। পাবনা যাচ্ছি, তবে পাগলা গারদ ভ্রমণে নয়। কৃষি বিপ্লব দেখতে। ঈশ্বরদী পাবনা পৌছে বন্ধুর বাসায় রাত্রিযাপন শেষে নির্দিষ্ট একটি খামার প্রত্যক্ষ করার লক্ষ্যে পরেরদিন রওয়ানা হলাম। খামারের নাম ‘মা-মনি কৃষি খামার’। খামারের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব শাহজাহান আলী বাদশাহ। যিনি ‘পেপে বাদশাহ’ নামেই অধিক পরিচিত। খামারে পৌছার আগেও আমি জানতাম না আমি কি প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি। ধারণা ছিলো কি আর এমন হবে!। খামারে পৌঁছে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। বিশাল এলাকা কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা। প্রথমে ঢুকতেই চোখে পড়লো পেয়ারা বাগান। সারি সারি করে পেয়ারা গাছ লাগানো। আমি নিজেকে প্রথমেই যে প্রশ্ন করলাম পেয়ারাও কি এভাবে চাষ করা হয়? পেয়ারা গাছের যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করলো তা হলো পেয়ারা গাছের প্রত্যেকটি পেয়ারা পলিথিনের প্যকেট দিয়ে মোড়ানো। আমি অবাক হয়ে স্বত্বাধিকারীর ছোট ভাইকে প্রশ্ন করলাম-এর কারণ কি। তিনি যে উত্তর দিলেন তা খুব চমৎকার।
এই পেয়ারা বাগানের কোন পেয়ারায় কোনো ধরণের রসায়নিক কিটনাশক ব্যাবহার করা হয় না। পেয়ারা জন্মের পরেই পেয়ারাটিকে পলিথিনের ব্যাগে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। এবং তিনি বললেন ঢাকা পাঠানোর আগ পর্যন্ত এইসব ফল ফ্রুটে কোন ধরণের ক্ষতিকারক কিছু ব্যাবহার করা হয় না। ঢাকায় চালান পৌঁছার পর এতে কোন ক্ষতিকারক রসায়নিক মিশ্রণ করা হলে তিনি অবগত নন। বিশাল বড় পেয়ারা বাগান, তার মধ্য দিয়ে সরু মেঠো পথ পায়ে হেঁটে আমরা পাড়ি দিলাম। তারপর সামনে আসলো পেপে বাগান। বিশাল এলাকা জুড়ে পেপে বাগান। একেকটি গাছে ১৫-২০ টি করে পেপে ঝুলছে। তখনি আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন ডিগবাজি খেলো ‘স্বত্বাধিকারীকে সবাই পেপে বাদশাহ নামে জানে কেন?’ প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলাম সাথে থাকা জনকে। খুব সুন্দর একটি ইতিহাস জানলাম। অনুপ্রাণিত হলাম। উক্ত খামারের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব শাহজাহান আলী বাদশাহ যাকে সবাই পেপে বাদশাহ নামেই জানে তিনি জীবনে অনেক পরিশ্রম, সংগ্রাম করেই আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে তিনি স্নাতক সম্মান সমাপ্ত করার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) থেকে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি তার পৈত্রিক ভিটায় ফিরে যান। বাবার রেখে যাওয়া জমিতে তিনি কৃষি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় মাত্র ৫বিঘা জমিতে তিনি পেপে চাষ শুরু করেন। শিক্ষিত মানুষ তারসাথে তিনি কৃষিতে অনেক ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করেছেন তাই সাফল্য তার অবধারিত ছিলো। প্রথম দফায়ই তিনি সফল হন। এই সাফল্য তাকে এনে দেয় খ্যাতির চুড়া। পেপে চাষ করে তিনি কৃষিতে বাষ্ট্রীয় স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। তারপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষুদ্র ঋণ সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে তার খামারের আয়াতন বাড়াতে শুরু করেন। একে একে পেয়ারা বাগান, শরিফা বাগান, ড্রাগন ফলের বাগান, লিচু বাগান সহ বিভিন্ন ফলফ্রুটের বাগান গড়ে তুলেন। কৃষিতে তারপর তিনি আবার আরো দুইটি পদক লাভ করেন। কিন্তু প্রথমবার যেহেতু তিনি পেপেতে রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছিলেন তাই তিনি পেপে বাদশাহ নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। একে একে পেপে বাগান হয়ে, ড্রাগন ফলের বাগান, শরিফা বাগান, লিচু বাগান ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। আমাকে অবিভূত করলো এখানকার পরিবেশ। আমিও মনে মনে কৃষিতে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। তা খুব একটা স্থায়ী হয়নি। যাই হোক খামার থেকে বের হয়ে যখন বন্ধুর বাসস্থানের পথে চলছিলাম তখন অন্যমনস্ক ভাবে আশেপাশে লক্ষ্য করছিলাম। আবাদি জমির একটা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশও খালি নেই। কোথাও লিচু বাগান, কোথাওবা আম বাগান আবার কোথাও কোথাও সিজনের বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত খামার। খুব অবাক হয়ে আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম ‘তোদের এই জমিগুলো কি কখনো খালি থাকে না?’ সে অবাক হয়ে বললো: খালি থাকবে কেন বোকা? বছরজুড়ে কোন না কোন কিছুর আবাদ হতেই থাকে। মনে কর, কোন জমিতে ধান চাষ হলো, সেই জমির ধান চাষের সিজন শেষ হতেই ভিন্ন চাষ শুরু হয়ে যায়। কখনো সরিষা চাষ, কখনো বা আলু চাষ লেগেই থাকে। অবাক হলাম খুবই। কিন্তু কৃষি বিপ্লবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম সিলেটের মানুষের স্বভাবের কারণে। সিলেটের মানুষের ধারণা কখনো একজন শিক্ষিত মানুষ নিজেকে কৃষিখাতে জড়াতে পারে না। সিলেটের মানুষের একটাই চিন্তা ব্যবসাপাতি কিছু করবো নতুবা দেশের বাহিরে চলে যাবো। অদ্ভুত সিলেটি সমাজ! আমার মনের শিকল আজ ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে সিলেটে একটি কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে মানুষকে দেখিয়ে দেই। সেই সুযোগ যদি কখনো আসে! আমাদের মন মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পিছনে বাংলাদেশের কৃষির অবদান অপরিসীম। কৃষি বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত। কৃষিকে আর অবহেলা নয়, আসুন কৃষিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। কৃষি অনেক লাভজনক খাতও বটে। শিক্ষিত মানুষ, সঠিক ট্রেনিং নিয়ে কৃষিখাতে জড়ালে সফলতা আসবেই। শাহজাহান আলী বাহশাহ সাহেবের কথাই ভাবুন: শিক্ষিত হয়ে সঠিক প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি কৃষিক্ষেতে নেমেছিলেন, আজ তিনি সফলতার ফেরীওয়ালা। আজ তিনি কোটিপতি। কৃষি তাকে এনে দিয়েছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান। পাবনা থেকে শুরু করে সমস্ত বাংলাদেশে তার খ্যাতি বিরাজমান। সময় এখন অর্থনৈতিক বিপ্লবের, বিপ্লবটা না হয় কৃষি দিয়েই শুরু করা যাক। সফলতা তার দুয়ার আমাদের জন্য খুলে দিয়েছে, শুধু অপেক্ষা প্রবেশের!
Check Also
আনন্দ-সংকটে সুনামগঞ্জ ভ্রমণ
২ সপ্তাহ আগে এক জায়গায় বসা অবস্থায় সিদ্ধান্ত হয় আমরা ২দিনের ট্যুরে সুনামগঞ্জ যাব। মামুন …