বড়পীর মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (র.) (২য় পর্ব)

গত সংখ্যার পর
বড়পীরের মায়ের গর্ভকালীন সময়ের স্বপ্ন
গর্ভ সঞ্চারের প্রথম দিন থেকেই তাঁর মাতা ফাতেমা আধ্যাত্মিকভাবে স্বপ্নে বিভিন্ন সুসংবাদ পেতে থাকেন। প্রথম মাসে হাওয়া (আ.), দ্বিতীয় মাসে ইবরাহীম (আ.)এর স্ত্রী হাওয়া (আ.) তৃতীয় মাসে ফেরাআউনের স্ত্রী হজরত আছিয়া (র.), চতুর্থ মাসে হজরত মরিয়ম (আ.), পঞ্চম মাসে হজরত খাদিজা (রা.), ষষ্ঠ মাসে হজরত আয়েশা (রা.), সপ্তম মাসে হজরত ফাতেমা (রা.), অষ্টম মাসে ইমাম হাসান (রা.) এর স্ত্রী এবং নবম মাসে ইমাম হুসাইন (রা.)এর স্ত্রী স্বপ্নে তাঁকে অভয়বাণী প্রদান করেন।

অলৌকিকভাবে কুরআনের অর্ধেক মুখস্থ
বড়পীরের জননী পনের পারা কুরআনের হাফেজ ছিলেন। তিনি প্রায় সব সময়ই এসব সূরা মুখস্থ তিলাওয়াত করতেন। মায়ের পড়া শুনেই তাঁর পনের পারা অলৌকিকভাবে মুখস্থা হয়ে গিয়েছিল। ফলে মক্তবে গিয়ে ওস্তাদজী বিসমিল্লাহ বলতেই তিনি একটানে পনের পারা মুখস্থ শুনিয়ে দিয়েছিলেন।

মায়ের ইজ্জত হেফাযত করলেন বড়পীরের রূহ
তিনি গর্ভে থাকতে তাঁর মায়ের কাছে ভিক্ষা চেয়েছিল এক কুমতলবি লোক। তাঁর মা আল্লাহর দ্বারস্থ হলেন। বড়পীরের রূহ বেরিয়ে গিয়ে বাঘ হয়ে লোকটিকে খতম করে দিল। মাতা বুঝতেই পারছিলেন না, বাঘ কোত্থেকে এল। আউলিয়াগণের কারামত তো বাস্তব সত্য।

জন্মের পরপরই অলৌকিক রোযা পালন
জন্মাবধিই তিনি পবিত্র রমযানে দিনের বেলা দুধপান করতেন না। একবার ঊনত্রিশে শাবান চাঁদ না দেখায় সমস্যা সৃষ্টি হলো। শহরের একজন বুযুর্গ লোকের পরামর্শে তাঁর মায়ের নিকট ফতোয়া চাওয়া হলো। ভেবেচিন্তে তিনি বললেন, যেহেতু তাঁর শিশু আবদুল কাদের দুধপান করেননি, তাই রোযা শুরু হয়ে গেছে। সে অনুযায়ী সবাই রোযা রেখেছিল।

শৈশবে গায়েবী আওয়াজ শ্রবন
ছোট্টকালে তার কোনো খেলাধূলোয় মন টানেনি, তা নয়; বরং ছেলেমি স্পৃহা জাগতেই তিনি শুনতে পেতেন গায়েব থেকে আওয়াজ-‘হে মুবারক শিশু। আমার দিকে আস।’ এরূপ গায়েবী বাণী শুনেই আমি ভয় পেতাম এবং দৌড়ে মায়ের কোলে যেতাম।’-বলে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন।

বাগদাদ যাত্রার প্রাক্কালে বিশেষ ঘটনা
বাগদাদেই তিনি উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। তবে বাগদাদ যাত্রার পূর্বে এক আরাফার দিনে তিনি তাদের গাভীটি পুষছিলেন, এমন সময় আরেকটি গায়েবী আওয়াজ শুনলেন-তোমাকে এ কাজের জন্য সৃষ্টিও করা হয়নি এবং এ বিষয়ে আদিষ্ট ও নও তুমি।

সত্য মুক্তি দেয়; মিথ্যা ধ্বংস করে
এ কারণে তিনি বাগদাদ যেতে আগ্রহী হন। কিন্তু পথিমধ্যে বাণিজ্যিক কাফের সাথে তিনিও দস্যুদের কবলে পড়েন। কিন্তু তাঁর সত্যবাদিতায় আশ্চর্য হয়ে ডাকাতদল তাঁর হাতেই ইসলাম গ্রহণ করেন। অর্থাৎ-সত্য মুক্তি দেয়, আর মিথ্যা ধ্বংস করে, এর বাস্তব পরাকাষ্ঠা দেখেছেন তিনি।

‘মুহিউদ্দীন’ উপাধি লাভ
বাগদাদ যেতে যেতে তিনি এক বৃদ্ধ মুমূর্ষু লোক দেখে তার সেবা করেন। এতে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমি সনাতন ইসলাম ধর্ম; আপনার দ্বারা আল্লাহ আমাকে পুনর্জীবন দিয়েছেন। তাই আপনি ‘মুহিউদ্দীন’ তথা দীনজীবিতকারী নামে আখ্যায়িত হবেন। অতঃপর এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ হন।

বাগদাদে গায়েবী ‘স্বর্ণমুদ্রা’ প্রাপ্তি
বাগদাদে তখন চলছিল দুর্ভিক্ষ। তাঁর মায়ের দেয়া যে চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল, তাও শেষ। এক রকম অনাহারেই দিন কাটছিল। ক্ষুধার তীব্রতায় নদীর পানি, গাছের পাতা, ঘাস, শাক-সবজি খেয়েও জীবন বাঁচিয়েছেন। কখনও বেহুশ হয়ে পড়ে যেতেন। লোকেরা মৃত ভেবে দাফনের ব্যবস্থা করত; আবার জেগে উঠতেন। একদিন গায়েবী আওয়াজ পেলেন, মুদ্রা ধার করতে। তিনি বললেন, কিভাবে আমি ঋণ শোধ করব? গায়েবী আওয়াজ হলো, আমিই শোধ করে দেব। অতঃপর তিনি রুটির দোকান থেকে বাকিতে রুটি খেতে থাকলেন। কিছুদিন পরে তিনি গায়েবী ইঙ্গিতে কতগুলি স্বর্ণমুদ্রা পেলেন এবং এর দ্বারা ঋণ পরিশোধ করেন।

নিরবচ্ছিন্ন কঠোর সাধনায় বড়পীর
হজরত শায়খ আবুল ফাতাহ নাহ্রভী (র.) বলেন, আমি চল্লিশ বছর যাবৎ গাউসুল আযম (র.)-এর খেদমতে অবস্থান করেছি। তিনি রাতের প্রথম ভাগ নামাজে অতিবাহিত করতেন, দ্বিতীয় ভাগ আল্লাহর যিকরে কাটাতেন এবং তৃতীয় ভাগ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করতেন। অতঃপর একটি দীর্ঘ সিজদায় পড়ে ললাট ঘর্ষণ করতেন।
বড়পীর স্বয়ং তাঁর অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেন-ইরাকের মরু প্রান্তর ও বনে জঙ্গলে আমি সুদীর্ঘ পঁচিশটি বছর একাকি কাটিয়েছি। দিবা-রাত্রি একমাত্র আল্লাহর যিক্র ব্যতীত এসময় আমার আর কোনো কাজ ছিল না। বছরের পর বছর আমি এশার ওজু দ্বারা ফজর পড়েছি। অসংখ্য রাত এমনভাবে অনিদ্রায় কাটিয়েছি যে, এক নিমিষের জন্যও চক্ষুমুদিনি। বহুবছর ধরে রাতে আমি নফল নামাজে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করেছি। নিদ্রার আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য কনকনে শীতের মধ্যে সারারাত খোলা আকাশের নিচে ছাদের ওপর নামাজে কাটিয়ে দিয়েছি। এ সময় আমার পোশাক ছিল মাত্র একটি পশমি জুব্বা। খালি পায়ে আমি কন্টকময় প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম। আমার পায়ের তালু চালুনীর ন্যায় শতছিদ্র হয়ে যেত। তখনই ছিল আমার ভরা যৌবনের যুগ। (তোহফায়ে কাদেরিয়া ও আখবারুল্ আখইয়ার)
তিনি আরও বলেন-এ অবস্থায় শয়তান আমাকে বিচলিত ও পথভ্রষ্ট করার জন্য সব ধরনের ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমার জিহাদ ও রিয়াজাতে শয়তান আমার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়েছে।
মূলত : তাঁর এই সাধনায় হেরার নিমগ্ন ইবাদতের অনুসরণই দেখা যাচ্ছে।

গজপ্রতি এক দীনার মূল্যের কাপড়ের কাহিনী
বাগদাদের বিখ্যাত কাপড় বিক্রেতা শায়খ আবুল ফযল বলেন, একদা গাউসুল আযমের খাদেম আমার দোকান থেকে তাঁর জন্য গজপ্রতি এক দীনার মূল্যের কাপড় কিনে নিল। আমি ভাবলাম, ফকীর-দরবেশগণ এমন দামি কাপড় ব্যবহার করলে রাজা-বাদশাগণ কিরূপ কাপড় পরিধান করবেন? তিনি বলেন, বড়পীর কাশফের মাধ্যমে আমার হাব-ভাব বুঝে আমাকে বললেন, হে আবুল ফযল! আল্লাহ তাআলা স্বয়ং আমাকে যা আদেশ করেন, আমি তা-ই পালন করি। কাপড়ের বিষয়ে আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে।

বক্তৃতা করতে রাসূল (স.)-এর আদেশ :
৫২১ হিজরীর ১৬ শাওয়াল বড়পীরকে রাসূল (স.) স্বপ্নযোগে বলেন-তুমি লোক সমাজে কথা বলছ না কেন। মূলত : তাঁর গভীর সাধনার জীবনে তিনি জনগণের সাথে জিজ্ঞাসার উত্তর ব্যতীত দীর্ঘ উপদেশ-ওয়াজ করতেন না। তিনি ভাবতেন, অপরিপক্ক অবস্থায় উপদেশ দেয়া ঠিক নয়। কিন্তু রাসূল (স.) কে তিনি জবাবে বললেন, আমি তো অনাবর (ইরানের ভাষা ফারসী); বিখ্যাত আরবদের (ইরাকের ভাষা আরবী) সামনে আমি কী করে বক্তব্য করব? অতঃপর রাসূল (স.) বললেন, ‘আচ্ছা! মুখ খোল।’ এবার বড়পীর মুখ হাঁ করলে রাসূল (সা.) তাঁর মুখে ফুঁ দিলেন (আধ্যাত্মিক-ভাবে)। আর সেদিনই যোহরের পর মসজিদের মিম্বরে বসে তিনি কিছু উপদেশমূলক কথা বললেন। এতে শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়ে এমনভাবে রেখাপাত করল, যাতে সমগ্র বাগদাদ শহরে তার ওয়াজের প্রভাব ও চাহিদা সৃষ্টি হলো।
চলবে

(১ম পর্ব)
(শেষ পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

আল্লামা ছাহেব কিবলার সামাজিক খেদমত

এম এ বাসিত আশরাফ ফার্সী কবি বলেছেন:তরীকত বজুয খেদমতে খালক্বে নেসতবসুজ্জাদা তাসবীহ ওয়া দালকে নেসত।ভাবানুবাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *