ছড়াসাহিত্যে শিশু-কিশোর ভাবনা

ছড়া হচ্ছে সাহিত্যের আদিমাতা। সাহিত্য জগতের সোপান হচ্ছে ছড়া। যারা সাহিত্য চর্চা করছেন তাদের অনেকেরই হাতেখড়ি কিন্তু ছড়া দিয়েই। আমার নিজেরও। শিশুদের ঘুমপাড়ানি থেকে শুরু করে বর্গিদের তাড়ানো পর্যন্ত ছড়ার বিশেষ ভুমিকা রয়েছে। আমরা ছোটবেলায় ছড়া শুনতে বেশ মজা পেতাম। আমরা এখনও ছড়া শুনতে কম যাইনা কেউ। ছড়া পাঠের মজাই আলাদা। আলাদা অনুভূতি আছে ছড়া পাঠে। ছড়া যেমন শিশুদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় ঠিক তেমনি বড়দেরকেও ব্যক্তি জীবনে সচেতন হতে অনুপ্রাণিত করে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিশুতোষ ছড়া ‘ভোর হোল দোর খোল’ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কবির ভাষায়-
ভোর হোল দোর খোল
খুকুমণি ওঠোরে,
ওই ডাকে জুঁই শাখে
ফুলখুকি ছোটরে।
এই ছড়ায় কবি যেমন ছোট্টমণিদের ঘুম থেকে জেগে উঠতে বলেছেন ঠিক তেমনি বড়দের জন্যও রয়েছে চেতনার অনুপ্রেরণা। জেগে ওঠার আহবান। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উদ্দিপনা। সচেতন হবার শিক্ষা। এগিয়ে চলার দিকনির্দেশনা।
ছড়ায় সমাজ সভ্যতার দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। ছড়ায় অনুপ্রাণিত করা হয় অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। ছড়া মমত্ববোধ জাগাতে ভুমিকা রাখে। ভুমিকা রাখে পারস্পরিক সহযোগিতার আহবানে এগিয়ে আসতে। পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের ভাষায়-
সবার সুখে হাসবো আমি
কাঁদব সবার দুঃখে,
নিজের খাবার বিলিয়ে দেব
অনাহারির মুখে।
কী চমৎকার কথা! কত আবেগ জড়ানো অনুভূতি! অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর কত বেশি আবেগী অনুপ্রেরণা। ছোট্টমণিরা যদি এসব শিক্ষামুলক ছড়া পড়ে তাহলে ওরা ভালো কিছু অর্জন করবে পারবে। সাম্যের সমাজ গড়তে এগিয়ে আসতে ওরা অনুপ্রাণিত হবে। ওদের অনুপ্রাণিত করবে সামনে এগিয়ে যেতে। ছড়ায় ছড়ায় খেলতে যাবে ছোটরা। ফুলবনে। কাশবনে। বাঁশবনে। ছড়ার বনে। ছড়ার সনে। ছড়া কাটবে আর প্রেরণা লুটবে। সামনে এগোনোর সাহস পাবে। বড় হবার উৎসাহ জোগাবে ছড়া। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-
আমি হব
সকাল বেলার পাখি,
সবার আগে
কুসুমবাগে
উঠবো আমি ডাকি।
এখানে কবি যেমন খোকাকে সকাল বেলার পাখি হয়ে জেগে উঠতে বলেছেন ঠিক তেমনি গভীরভাবে ভাবলে এটাও বলা যায় যে, আমরা যারা এখনও সচেতন নই কবি তাদেরকে খোকা ভাবছেন। বুঝতে বলেছেন জগতের সবকিছুকে। ভাবতে বলেছেন আরো গভীরে। তাই খোকাকে জেগে উঠতে বলেছেন যেমন, ঠিক তেমনি আমাদের সবাইকে জাগতে বলেছেন আপনার করে। বলেছেন সচেতন হতে। জাগ্রত হতে।
ছড়ায় রয়েছে জাদুকরি চমক। ছড়া বিবেককে নাড়া দেয় বেশ শক্তকরে। ছড়া জাগ্রত করে সমাজকে। জাতিকে। জাতিসত্ত্বাকে। তাইতো ছড়া সৈনিকের ভুমিকা পালন করে। নেতৃত্বের আসন দখল করে ছড়া। ছড়া এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখায়। নতুনকে জানতে অনুপ্রাণিত করে। বিশ্বজয়ের স্বপ্ন জাগায়। আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছড়ায় তার প্রমাণ পাই। কবি লিখেছেন-
থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।

দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে
কেমন করে করছে তারা
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।

পাতালপুরে নামবো আমি
উঠবো আমি আকাশপুরে
বিশ্বজগত দেখবো আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
কবির এই ছড়া আজকে অনেকদূরে নিয়ে গেছে আমাদেরকে। কী অসাধারণ চিন্তা কবির। একজন শিশুকে কবি আবিস্কারের নেশায় ডুবিয়ে দিলেন কীভাবে! সামনে এগিয়ে চলার উৎসাহ কত আবেগী। কবির স্বপ্ন আজ বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে। আজকে আকাশজয়ী আমরা। আমরা স্বপ্নজয়ী। আজকে মঙ্গলগ্রহে আমাদের পদচারণা। এটাইতো কবির সফলতা। কবির সৃষ্টির পূর্ণতা। তাই বলতে চাই, ছড়া কেবলমাত্র স্বপ্নই দেখায়না বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাতেও সহযোগিতা করে।
অতীতের সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধনের দেখা পাই কবিদের ছড়া-কবিতায়। ছোটদের নিয়ে কবিদের ভাবনা কত সুদূরের। অনেক গভীরের। কাল থেকে কালান্তরে কবিদের এগিয়ে চলা। নিরন্তর সম্মুখপানে। ক্রমাগত সামনে। স্বপ্ন সেতুর লক্ষ্যপানে। কবি সুফিয়া কামালের ‘আজিকার শিশু’ ছড়ায় দেখতে পাই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কবির ভাষায়-
আমাদের যুগে আমরা যখন
খেলেছি পুতুল খেলা,
তোমরা এ যুগে সেই বয়সে
লেখাপড়া কর মেলা।
বাস্তবিকই তাই এখন সত্যি। আমরা শিশুকালে যেমন হাসিখুশি ছিলাম এখন কিন্তু তেমনটি নাই। প্রকৃতির সহজাত শিক্ষা এখন সুদূরে। আমরা যে বয়সে হেসেখেলে সময় পার করতাম ঠিক সেই সময়ে এখন শিশুদের কাঁধে বইয়ের বস্তা। কবির চিন্তা কত গভীরে। কবিরা তাই সুদূরের স্বপ্ন বোনেন। ছন্দ ছড়ায় ছড়িয়ে দেন স্বপ্নের বীজ। ছড়া-কবিতায় বোপন করেন আগামীর স্বপ্ন। স্বপ্নের জানালা। স্বপ্ন দুয়ার।
শিশুরা সহজ সরল। বাঁকা-তেড়া বোঝেনা ওরা। ওরা সরলরেখায় চলতে ভালোবাসে। ওদের মনে কোন কালিমা নেই। ওরা নিস্পাপ। ওরা একেকটি ফুটন্ত গোলাপ। ওদের পাঁপড়িগুলো মেলানোর দায়িত্ব আমাদের। কবিদের। তাইতো ওদেরকে আলোকিত ভুবনের স্বপ্ন দেখাতে হবে। ওদেরকে আকাশের মত উদার করে গড়ে তুলতে হবে। ওরা কারো শত্রু নয়। ওরা সকলের বন্ধু। ওরা স্বপ্ন পাখি। ওরা সুখের নদী। ওরা বিকশিত শুভ্র কাশফুল। ওরা কাশবন। শিশুরা জোনাকজ্বলা বাঁশবন। কবির ভাষায়-
আমরা ফুল আমরা কুঁড়ি
আমরা সবুজ বাঁশবন,
স্বপ্ন পাখি জুড়াই আঁখি
সুখের নদী কাশবন।

সবুজ শ্যামল জীবন ঘেরা
বাংলা মায়ের চিত্র,
কোমল উদার ভালবাসার
আম জনতার মিত্র।

আকাশ পাহাড় ঝরনা ধারা
শাপলা ফোটা বিল,
একটানা সুখ সরল মনের
স্বপ্ন সুখের নীল।
(আমরা ফুল আমরা কুঁড়ি)
এসব সবুজচারী শিশুদের অনেক চাওয়া আছে। আছে ওদের প্রাণের আকুতি। ওদের চাওয়া যেমন নিজেদের জন্য ঠিক তেমনি জাতির জন্যও বটে। কারণ আজকের শিশুই আগামীর কাণ্ডারী। আগামীর স্বপ্ন নায়ক। দেশের মুল জনশক্তি। দেশ সেনা। সেনাপ্রধান। দেশ প্রধান। প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি। জাতির অভিভাবক। তাই নিজেদেরকে গড়তে ওদের চাওয়া-পাওয়ার অনেক কিছুই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই ধ্র“বতারার মত সত্য এবং সঠিক। বরং এটিই হওয়া দরকার। সময়ের দাবি। সময়ের সহজাত চাহিদা। কবির ভাষায়-
আমরা নবীন শিশু কিশোর
আমরা অবুঝ খোকা,
সরল পথের পথিক আমরা
চাইনা কোন ধোঁকা।

আমরা সবুজ পথহারা ভাই
পথের দিশা চাইগো,
আমরা যেনো সত্যিকারের
মানুষ হতে পাইগো।

আজকে যারা অনেক বড়ো
সকল কাজের কাজী,
তাদের কাছেই দাবি মোদের
রেখে গেলাম আজি।
(আমরা ফুল আমরা কুঁড়ি)
সত্যিই ছোটদের দাবি অনেক। অনেক পাওয়ার আশা ওদের। যৌক্তিক ওদের সকল দাবি মেনে নিতে হবে আমাদেরকে। আমাদের দেশের কর্ণধারদেরকে। কবিদেরকে। লেখকদেরকে। সাহিত্যিকদেরকে। ওদেরকে গড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে আমাদেরকেই। ওদের চাওয়ার মতো করেই সাহিত্য লিখতে হবে কবিদেরকে। সাহিত্যের জগৎ গড়তে হবে ওদেরকে সামনে রেখেই। ওদের স্বপ্নকে তুলে ধরতে হবে আপনার করে। একান্ত নিজের করে। ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে। আজকে তাই, ছড়া কেটে আমিও বলতে চাই-
ছড়া পাতায় আঁকতে হবে ওদের চাওয়া ছবি।
আজকে থেকে সেটি হোক সব কবিদের হবি।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *