সাত কারী ও চৌদ্দ রাভী

প্রিয় নবীজী (সা.) ইলমে কিরাআত হাসিল করলেন রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে। সাহাবায়ে কিরাম হাসিল করলেন নবী করীম (সা.) থেকে। তাঁদের কাছ থেকে তাবিঈনে ইযাম, এমনি করে ইলমে কিরাত আসতে থাকল আমাদের যামানার দিকে। ভারত উপমহাদেশ বড়ই সৌভাগ্যবান এজন্য যে, আরবী ভাষার কুরআন শরীফ আল্লাহ প্রদত্ত নিয়মে নবী করীম (সা.) যেভাবে তিলাওয়াত করতেন তারই অনুসৃত নিয়মে তিলাওয়াত পারঙ্গম এক প্রদীপ ইলমে কিরাআতের আলোয় উজ্জল করে গেলেন এ উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল। আল্লাহ প্রদত্ত এ মহান নিয়ামত হচ্ছেন উস্তাদগণের উস্তাদ, কুতবুল আউলিয়া হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)। ইলমে কিরাআত তথা কুরআন পাকের খিদমতে তাঁর কঠোর শ্রম আর অঢেল সম্পদ কুরবানীর ফল হচ্ছে ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। এ প্রতিষ্ঠান ক্রমবর্ধমান গতিতে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষার খিদমত আনজাম দিয়ে যাচ্ছে। দারুল কিরাতের সাথে সম্পৃক্ত সকলে কমবেশি সাত কারী এবং চৌদ্দ রাভীর কথা শুনেছেন। নবী করীম (সা.) থেকে কুরআন শরীফের পঠন রীতি মুতাওয়াতির তথা মিথ্যার আশংকামুক্ত ভাবে সাতটি ধারায় পাওয়া যায়। যে মহান সপ্ত মনীষীর মাধ্যমে এ ধারাগুলো বিকশিত হয়েছে সাত কারী বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়। তাদের কাছ থেকে অসংখ্য মনীষী রীতিগুলো রপ্ত করে বর্ণনা করেছেন এরা হচ্ছেন রাভী (বর্ণনাকারী)। সাতজন কারী সাহেবের প্রত্যেকের দু’জন করে বিশিষ্ট বর্ণনাকারী রয়েছেন। চৌদ্দ রাভী বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়।
উল্লেখ্য যে, ইলমে কিরাআত মূলত: চারটি অঞ্চল ভিত্তিক প্রসিদ্ধি পায় যথা:- মক্কা শরীফ, মদীনা শরীফ, কূফা এবং শাম। সাত কারী ও চৌদ্দ রাভী এ চার অঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ত। তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপনা করা হলো।
১. নাফে মাদানী (র.) [نافع بن عبد الرحمن الليثي المدني]
তিনি মদীনা শরীফের কারী। তাঁর নাম ও বংশ লতিকা- আবূ আবদির রহমান নাফে বিন আবদির রহমান বিন আবি নুয়াইম বিন শুয়ূব আল্ লাইছি।
তিনি ইসফাহান বংশোদ্ভূত ছিলেন। ৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। গায়ের রং ছিল কালো। কিরাআতের বিভিন্ন ধারার পণ্ডিত ছিলেন। ৭০ বছর যাবত মদীনায় কিরাত শিক্ষা দেন। ইমাম নাফে মাদানীর মুখ থেকে মেশকে আম্বরের ঘ্রাণ বের হতো। তিনি বলেন- আমি একদিন স্বপ্নে নবী করীম (সা.)-কে দেখলাম আমার মুখের মধ্যে তিলাওয়াত করছেন। এরপর থেকে এ ঘ্রাণ শুরু হয়েছে। তিনি কানে শুনতেন না কিন্তু কুরআন শরীফের তিলাওয়াত পরিস্কারভাবে শুনতে পারতেন।
তাঁর শিক্ষকমণ্ডলী
সত্তরজন তাবিঈ ইযাম থেকে তিনি ইলমে কিরাআত লাভ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- ১. হযরত আব্দুর রহমান বিন হুরমুয আল আরাজ। ২. আবু জাফর ইয়াযিদ বিন কা’কা’। ৩. শায়বা বিন নাস্সাহ ৪. মুসলিম বিন জুনদুব আল হুযালী। ৫. ইয়াযিদ বিন রূমান প্রমূখ।
ছাত্র
তাঁর অসংখ্য ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- ১. আবূ বকর বিন আবি ওয়ায়েছ ২. ইসহাক বিন মুহাম্মদ ৩. ইসমাঈল বিন জাফর ৪. মুহাম্মদ বিন ওমর ওয়াকিদী ৫. ইয়াকুব বিন ইবরাহীম প্রমূখ।
প্রসিদ্ধ দুজন রাভী:
এক. ইমাম ওরশ (ورش)
এটা তাঁর উপাধী। অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার কারণে তিনি এ উপাধী লাভ করেন। তাঁর নাম- আবূ সাঈদ উসমান বিন সাঈদ আল মিসরী [أبو سعيد عثمان بن سعيد المصري] । তিনি ১১০ হিজরীতে মিশরে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৫৫ হিজরীতে মদীনা শরীফে আগমন করে নাফে মাদানী (র.)-এর খিদমতে এসে চারবার সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে শুনান। অত:পর মিশরে চলে যান।
দুই. ইমাম কালুন (قالون):
কালুন শব্দটি রোমীয়, অর্থ হচ্ছে অতিউত্তম। তাঁর তিলাওয়াত অত্যন্ত মাধূর্যপূর্ণ ছিল বিধায় তিনি এ উপাধী লাভ করেন। তাঁর নামধাম হচ্ছে- আবূ মুসা ঈসা বিন মায়না [أبو موسى عيسى بن مينا] । তিনি ১২০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২২০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। ১৫০ হিজরীতে নাফে মাদানীর কাছ থেকে ইলমে কিরাআত লাভ করেন।
২. ইবনে কাছীর (র.) [أبو معبد عبد الله بن كثير الداري]
তিনি মক্কা শরীফের কারী। তাঁর নাম ও বংশ লতিকা- আবূ মা’বাদ আব্দুল্লাহ বিন কাছীর বিন ওমর বিন আবদিল্লাহ বিন থাঞ্জান বিন ফায়রুযান বিন হুরমুয আল মক্কী আদ্ দারী। ৪৫ হিজরীতে পবিত্র ভূমি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ১২০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।
প্রসিদ্ধ দুজন রাভী:
এক. আবুল হাসান আহমদ বিন মুহাম্মদ আল বায্যী [أبو الحسن أحمد بن محمد البزي] : তিনি মসজিদে হারাম শরীফের মুয়াজ্জিন ছিলেন। ১৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৫০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।
দুই. কুনবুল (قنبل): এটি তার উপাধি। তাঁর নাম আবূ আমর মুহাম্মদ বিন আবদির রহমান আল মাখযূমী [أبو عمر محمد بن عبد الرحمن المخزومي]। তিনি ১৯৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
৩. আসিম কুফী (র.) [أبو بكر عاصم بن أبي النجود الأسدي الكوفي ]
তিনি কুফা অঞ্চলের কারী। তাঁর নাম ও বংশ লতিকা: আবূ বকর আসিম বিন আবিন নুজুদ আল আসাদী আল কুফী। তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায়নি। ১২৭ হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন।
প্রসিদ্ধ দুজন রাভী:
এক. ইমাম হাফ্স (র.) : তাঁর নাম ও বংশ লতিকা- আবূ আমর হাফ্স বিন সুলায়মান আল বায্যায আল কূফী [أبو عمر حفص بن سليمان البزاز الكوفي]। তিনি ৯০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা দ্বিতীয় বার আসিম কূফী (র.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তিনি মায়ের সাথে আসিম কূফী (র.)-এর ঘরে আসেন এবং এখানে লালিত পালিত হন। ১৮০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।
দুই. আবু বকর শুবা ইবনে আইয়াশ [أبو بكر شعبة بن عياش] : তাঁর নাম ও বংশ লতিকা: আবূ বকর শুবা বিন আইয়াশ বিন ছালিম আল হান্নাত আল আসাদী আল কূফী। তিনি ৯৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় বোন কান্না-কাটি শুরু করলে তাঁকে শান্তনা দেওয়ার জন্য আবূ বকর (র.) বলেন- কাঁদছ কেন? চেয়ে দেখ ঐ কুরআন শরীফের দিকে, আমি তিলাওয়াত করে আঠার হাজারবার খতম করেছি।
৪. হামযা বিন হাবীব আল কুফী (র.) [حمزة بن حبيب الكوفي]
কূফা অঞ্চলের আরেকজন কারী সাহেব হলেন হামযা। তিনি হামযা বিন হাবীব বিন আম্মার বিন ইসমাঈল আল কূফী। আসিম ও আমাশের পরে তিনিই কুফার শীর্ষস্থানীয় কারী ছিলেন। তিনি আরবী ভাষা সাহিত্য, ফারায়েয ইত্যাদি শাস্ত্রের পণ্ডিত ছিলেন। হাফিযে হাদীসও ছিলেন। ইরাক থেকে হালওয়ানে তেল রপ্তানী করতেন এবং সেখান থেকে ইরাকে ঘি আমদানী করতেন। তিনি ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
দুজন রাভী:
এক. খাল্লাদ বিন খালিদ আল আহওয়াল (র.) [خلاد بن خالد الأحول] : তিনি ১৩০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২২০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তিনি উঁচু পর্যায়ের একজন সূফী ছিলেন। অধ্যাপনা তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত ছিল।
দুই. খালফ বিন হিশাম [خلف بن هشام] : তিনি ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। দশ বছর বয়সে কুরআন শরীফ হিফয সমাপন করেন। ১৩ বছর বয়সে বিভিন্ন বিষয়ের ইল্ম অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি উঁচু পর্যায়ের একজন সূফী সাধক এবং উলূমে শরীআর পণ্ডিত ছিলেন। ২২৯ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।
৫. আলী বিন হামযা আল কিসাঈ (র.) [علي بن حمزة الكسائي]
কূফার আরেকজন কারী সাহেব হচ্ছেন আলী বিন হামযা আল কিসাঈ (র.)। তাঁর নাম ও বংশ লতিকা হলো- আলী বিন হামযা বিন আবদিল্লাহ বিন বাহমান বিন ফায়রুয আল কিসাঈ আল কূফী। তিনি ১১৯ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৯ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।
দুজন রাভী :
এক. আবুল হারিছ আল লায়ছ বিন খালিদ আল বাগদাদী: [أبو الحارث الليث بن خالد البغدادي] : তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ২৪০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছেন।
দুই. আবূ ওমর হাফ্স বিন ওমর আদ্ দাওরী: [أبو عمر حفص بن عمر الدوري] : তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ২৪৬ হিজরী সনের শাওয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন।
৬. আবূ আমর আল মাযিনী (র.) [أبو عمرو المازني]
আবু আমর আল বসরী হচ্ছেন বসরা অঞ্চলের প্রসিদ্ধ কারী। তাঁর নাম ও নসবনামা- যাব্বান বিন আলা বিন আম্মার বিন আল উরয়ান বিন আবদিল্লাহ বিন আল হুসাইন বিন আল হারিছ বিন জুলহুমা বিন খিজাঈ আল মাযিনী আত্তামীমী। তিনি ৬৭/৭০ হিজরীতে মক্কা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। অত:পর পিতার সাথে বসরায় চলে যান এবং সেখানেই লালিত পালিত হন। তিনি ১৫৪ মতান্তরে ১৫৫ মতান্তরে ১৫৭ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।
দুজন রাভী:
এক. আবূ ওমর হাফ্স বিন ওমর আদ্ দাওরী: [أبو عمر حفص بن عمر الدوري] : তার সম্পর্কে উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
দুই. আস্সূসী (السوسي): তিনি হলেন আবূ শুআইব সালেহ বিন যিয়াদ আস্সূসী আল আহওয়াযী [أبو شعيب صالح بن زياد السوسي الأهوازي]। তাঁর উপনাম আবূ শুয়াইব। তাঁর জন্ম সন সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রায় নব্বই বছর বয়সে ২৬১ হিজরীতে ইন্তি-কাল করেন।
৭. ইবনে আমির আশ শামী (র.) [ابن عامر الشامي]
তিনি শাম অঞ্চলের কারী। তাঁর নাম আব্দুল্লাহ বিন আমির বিন ইয়াযিদ বিন তামীম বিন রবীয়া আল ইয়াহসাভী আশশামী। তিনি ৮ম হিজরী মতান্তরে ২১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুপ্রসিদ্ধ একজন তাবিঈ ছিলেন। তাঁর উস্ত-াদগণের মধ্যে সাহাবী হযরত আবুদ্দারদা উয়াইসির বিন যায়দ বিন কায়স (রা.) অন্যতম ছিলেন। উমর বিন আবদিল আযীয (রা.)’র যুগের আগে ও পরে দীর্ঘদিন উমাইয়া জামে মসজিদে ইমামতি করেন। আমীরুল মুমিনীন ওমর বিন আবদিল আযীয (রা.) তাঁর ইকতিদা করে নামায আদায় করেছেন। তিনি একদিক থেকে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন অন্যদিক থেকে দামেশকের বিচারপতি এবং ইলমে কিরাতের উস্তাদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দুজন রাভী:
এক. হিশাম বিন আমির বিন নুসায়র আসসুলামী: [هشام بن عامر بن نصير السلمي] : তাঁর উপনাম ছিল আবুল ওলীদ। তিনি ১৫৩ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৪৫ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তিনি দামেশকের খতীব, মুহাদ্দিস ও মুফতীর দায়িত্ব পালন করেন।
দুই. ইবনু যাকওয়ান আল কুরাশী: [ابن ذكوان ‏القرشي] : তিনি আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন বশর ইবনু যাকওয়ান বিন ওমর আল কুরাশী আদ্ দিমাশকী। তাঁর উপনাম ছিল আবূ আমর। তিনি ১৭৩ হিজরীর আশুরার দিনে জন্মগ্রহণ করেন। উমাইয়া জামে মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। সমসাময়িক ইরাক, হিজায,শাম, মিশর এবং খুরাসান অঞ্চলে তার সমকক্ষ কোন কারী ছিলেন না।
দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা রঈসুল কুররা, উস্তাদগণের উস্তাদ আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তাঁর ইলমে কিরাতের তিনটি সনদ মাধ্যমে হযরত আছিম কুফী (র.)-এর কিরাত অনুসারে শিক্ষা লাভ করেন এবং দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট সংশ্লিষ্ট সকলেই এই ধারার কিরাআত শিক্ষা লাভ করে আসছেন। উল্লেখ্য, সাতকারীর মধ্যে আরব এবং আজমে আসিম কুফী (র.)-এর কিরাআত সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা হয়।

Comments

comments

About

Check Also

কুরবানী : আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মোক্ষম সুযোগ

মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস প্রমাণ করে যে দুনিয়ার সব সভ্য জাতি ও সম্প্রদায় কোনোনা কোনোভাবে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *