পবিত্র কুরআন কি শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য?

পবিত্র কুরআনের প্রতিটি বর্ণ নাজিল হয়েছে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য। তাই (১) কোরান শুদ্ধ করে তেলাওয়াত করা, (২) ভালকরে ভাবার্থ হৃদয়ঙ্গম করা ও (৩) বাস্তব জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে অনুস্বরণ করা প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য। তবে ভাল করে ভাবার্থ হৃদয়ঙ্গম করা সবার জন্য সম্ভব নয় এবং তা সবার উপর ফরজও নয়। কিন্তু শুদ্ধ করে পড়া ও আল কুরআনের নিদের্শনা পরিপূর্ণভাবে মান্য করা সকল মুসলমান নর নারীর উপর ফরজ।
আমরা প্রথমে যদি তেলাওয়াতের দিকে লক্ষ্য করি; তাহলে দেখি প্রায় ৯০% মুসলমান শুদ্ধ করে কুরআন তেলাওয়াত জানে না। কোনদিন কি ভেবে দেখেছি তার কারণ কি? তা ভাবার মুসলিম নেতা ও বক্তাদের সময় নেই। বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের যে কোন একটি মসজিদে মুসল্লিদের তেলাওয়াতের মান যদি জরিপ করা হয় শতকরা ৫% মুসল্লির ক্বিরাত নামাজ শুদ্ধ হবার মত হয় কি না আমার সন্দেহ। বাংলাদেশের একজন মুসলিম অভিভাবক চিরাচরিত সকালের মক্তবে বা মসজিদে তাঁর আদরের ছেলে-মেয়েকে কুরআন শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বলেন আমার সন্তানরা কুরআন খতম করেছে এতে আমি মহাখুশি। কিন্তু অভিভাবক কি জানেন যে, প্রায় শতাধিক ছাত্র -ছাত্রীকে একজন সম্মানিত ইমামের পক্ষে শুদ্ধ করে কুরআন শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। তাই ভুলেভরা শিক্ষা নিয়ে মক্তব থেকে ছেলে-মেয়েরা বের হয়। প্রায় ৯০% ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে ভর্তি হয় ভাগ্যবান দুএকজন মাদ্রাসায় যায় এবং বাকী সব ঝরে পরে। তারপর শুরু হয় জীবনযুদ্ধ আর কুরআন শুদ্ধ করার সময় থাকে না। তাই এই ভুলে ভরা তেলাওয়াতে চলে নামাজ, চলে বাকী সব ধর্মীয় কাজ। একজন অভিভাবক মক্তবের শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে যে আত্মতৃপ্তিতে বসে আছেন তা কি যথাযথ হল? কুরআন কি শুধু এই আনুষ্ঠানিকতার জন্য এসেছে?
আমার যুক্তরাজ্যে বসবাস করার সুবাদে বিশ্বের বিভিন্ন। দেশের মুসলমানদের দেখার সুযোগ হয়েছে। এখানে আরাবীয়ান, সোমালিযান, আলজেরিয়ান, টার্কিশ, আফ্রিকা এশিয়া সহ সব দেশের মুসলিম ছেলে মেয়েদের ইসলামী শিক্ষার যে দক্ষতা দেখি তাতে অবাক হই। একজন মক্তব পড়ুয়া ছাত্র উন্নত লেহেনে খুবই শুদ্ধ করে কুরআন তেলাওয়াত করে, শুধু তাই নয় জুজ আমপারাসহ কুরআনে গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো (সুরা মূলক, ইয়াসিন, রাহমান, ওয়াকিয়া ও মুজ্জাম্মিল অর্থ সহ মুখস্ত জানে। স্কুলে বা কলেজে পড়ে কিন্তু মসজিদে এসে জামাত না পেলে নিজেই ইমামতি করে নামাজ পড়ায় এমন কি ইমাম না থাকলে খুৎবা পর্যন্ত দেয়। জীবন চলার পথের নিত্যপ্রয়েজনীয় অনেক হাদীস আরবী ইবারতসহ অর্থ জানে। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ইতিহাস এমনভাবে জানে যে আমার দেশের সকল আলেমগণ তা জানেন না। কথায় কথায় কুরআন ও হাদীসের রেফারের্ন্স সহ বর্ণনা করে। আমি রীতিমত অবাক হয়ে ভাবি হায়! আমার দেশের মক্তব-মসজিদে ওদের তুলনায় কি যে শিখানো হয়? এটা কি ইমাম সাহেবদের ব্যর্থতা না আমাদের মসজিদ পরিচালনার ব্যর্থতা? অবশ্যই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও পরিচালনার ব্যার্থতা শতভাগ। কারণ এক দু জন ইমাম দ্বারা সুচারু রূপে এসব শিক্ষা দেয়া মোটেই সম্ভব নয়।


এখন আসি কুরানের নির্দেশ বাস্তবজীবনে কতটুকু পালন করছি তা একটু বলি। আমাদের দেশে কোনু অনুষ্ঠান শুরু করতে খোঁজা হয় শুরুতে কিছু তেলাওয়াত করার জন্য। প্রথমে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করার পর বাকী সব কর্মসূচী পালন হয় কুরআনবিরোধী। যেমন বিদ্যালয়ের ক্রিয়া বার্ষিকিতে শুরুতেই তেলাওয়াত হল পরে নাচ, গান, অপসংস্কৃতি, পর্দার খেলাফ ইত্যাদি চলে, যা তেলাওয়াতকৃত কুরআন নিষেধ করেছে। ওরসের নামে প্রথম ফাতেহা পাঠ মানে তেলাওয়াত করা হয় এর পর যা হয় তা একটিও কুরআন সম্মত নয়। বিয়ে শাদীতে একটু তেলাওয়াত করে নিকাহ বা আকদ করা হয় তার পর কুরআন নিষিদ্ধ গায়েহলুদ, মেহদীসন্ধ্যা, আলোকসজ্জা ও খাদ্যের অপচয় যা হয় তা রীতিমত কুরআনে সাথে যুদ্ধ বললে ভুল হবে না। আমার কাছে মনে হয় এসব কাজে বা অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াত করে তার বিপরীতে যা করা হয় তা কুরআন অবমাননার সামিল। মনে হয় কুরআন তেলাওয়াত করে কুরআনকে বলা হয় দেখ তোমার সামনে তোমাকে অপমান করছি তাতে আমাদের কিছুই আসে যায় না। একদিন চলার পথে নবীজি মদীনার পণ্ডিত সাহাবী হযরত যিয়াদ ইবনে লবিদ (রা.)-কে বললেন-হে যিয়াদ! এমন একদিন আসবে কুরআনে ইলিম তলিয়ে যাবে। যিয়াদ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.) আমরা কুরআন পড়ি; আমাদের বাচ্চাদের কুরআন শিখাই, বাচ্চারা বংশপরস্পরায় ভবিষ্যত প্রজন্মকে কুরআন শিখাবে তাহলে কুরআনের ইলিম উঠে যাবে কিভাবে? নবীজি বললেন -হে যিয়াদ তোমার মা তোমাকে কেন যে কষ্ঠ করে গর্ভে ধারণ করল। তোমাকে তো আমার মদীনার সাহাবীদের মধ্যে একজন পণ্ডিত সাহাবী মনে করতাম। তুমি কি দেখনি ইয়াহুদী নাসারারা তাদের তৌরাত ইনজিল পড়ে কিন্তু আমল করে না। অর্থাৎ একদিন আমার উম্মৎ কুরআন পড়বে কিন্তু আমলে থাকবে না। আজ তাই হচ্ছে।
প্রিয় পাঠক! তাই আজই আমাদের কিছু ভাবার বিষয় ও কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজন। শুধু কুরআন আনুষ্ঠানিকতায় না রেখে বাস্তব জীবনে পালন করা অবশ্য কর্তব্য এবং আমাদের মক্তব-মসজিদের পাঠদান পদ্ধতি স্বনাতন রীতি ছেড়ে ঢেলে সাজানো একান্তই কর্তব্য। না হয় কুরআন শুধু আনুষ্ঠিকতায় পড়ে থাকবে অচল হয়ে। বলুন তো কুরআন কি শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য?

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *