হজের রাজনৈতিক ও অন্যান্য তাৎপর্য

নির্বাচিত আয়াত ও হাদীস
আয়াত : তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে থাক আর (ফরয কাজে খরচ বর্জন করে) নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ কর না। সূরা বাকারা ২:১৯৫।
আয়াত : মানুষের মধ্যে যার সেখানে (কাবা ঘরে) যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হাজ্জ করা তার অবশ্য কর্তব্য। সূরা আলে-ইমরান ৩:৯৭।
হাদীস : হযরত আবু উমামা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন ঃ যাকে শক্ত অভাব অথবা অত্যাচারী শাসক অথবা গুরুতর রোগ বাধা দেয়নি, অথচ সে হজ্জ না করেই মরতে বসেছে, সে চাইলে ইহুদী হযে় মরুক অথবা সে যদি চায় তো খৃস্টান হযে় মরুক। দারিমী, সূত্র : মিশকাত, কিতাবুল হাজ্জ, হাদীস নং৩০।
হাদীস : হযরত ওমর রা. বলেন ঃ হজ্জের শক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ হজ্জ না করে, তবে কসম করে বলে দাও যে, সে হয় ইহুদী হযে় মরবে, না হয় খৃস্টান হযে় মরবে। তিনি রা. আরও বলেন, আমার মন চায়, সারা দেশে এই কথা ঘোষণা করে দেই, যে ব্যক্তি সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করল না, তার ওপর যেন কাফেরদের মত জিযিয়া কর বসানো হয়। কেননা সে মুসলমান নয়, সে মুসলমান নয়। শায়খুল হাদীস মাওলানা হাফেজ মোহাম্মাদ জাকারিয় ছাহারানপুরী র. : ফাজাযে়লে হজ্জ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
হাদীস : হুজুর স. থেকে একটি দুর্বল সনদে বর্ণিত, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে খরচ করে না, সে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কাজে খরচ করতে বাধ্য হবে। যে ব্যক্তি কোন পার্থিব কারণে হজ্জ করতে দেরি করে ফেলল, হাজীগণ হজ্জ থেকে ফিরে আসার আগে তার সে প্রযে়াজন পূর্ণ হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের সাহায্যে পা উঠায় না, তাকে কোন গোনাহের কাজে সাহায্য করতে হবে, যেখানে কোন কল্যাণ নেই। আত তারগীব ওয়াত তারহীব : ফাজাযে়লে হজ্জ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
হাদীস : প্রিয় নবীজী স. বলেন ঃ পেরেশান অবস্থা, চুল-দাডি় এবং ময়লাযুক্ত কাপড়ই হল হাজীদের পরিচয়। এই সূরতের ওপরই আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে থাকেন যে, দেখ! আমার বান্দারা ধূলায় ধূসরিত ও এলোমেলো চুল-দাডি় নিযে় আমার দরবারে হাজির হযে়ছে। Ñফাজাযে়লে হাজ, চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
হজের মূল তাৎপর্য
প্রকৃতপক্ষে হজ দু’টো দৃশ্যের নমুনাস্বরূপ এবং হজের প্রতিটি কাজে ঐ দুই দৃশ্যই লুকাযি়ত আছে। প্রথমতÑ হজ একটি পরিপূর্ণ মৃত্যু এবং মৃত্যুর পরবর্তী পর্যাযে়র নমুনা। দ্বিতীয়তÑ হজ প্রেম ও মহব্বত প্রকাশ করবার এবং রূহকে প্রকৃত প্রেম ভালবাসায় রঙিন করবার নমুনা।
ক্স মৃত্যু যেমন ঘরবাডি়-আপনজন থেকে চিরতরে বিচ্ছেদের নাম, হজও তেমনি সবকিছু ফেলে এবং সবার কাছে থেকে বিদায়গ্রহণেরই নাম। বাহন যেন জানাযার খাটের বিকল্প আর বাহনের গতি যেন জানাযার খাটে চডে় কবরের দিকে যাওয়ারই প্রতীকী রূপ। কবরে যায় নেক ও বদ আমল; একটা শান্তিদায়ক, অন্যটা যন্ত্রণাদায়ক। তেমনি হজের সফরে থাকে কিছু সফরসঙ্গী, যাদের কতক হয় আন্তরিক ও সহমর্মী; কতক হয় খিটখিটে, হঠকারী ও কলহপ্রিয়, যারা সফরের প্রতি মঞ্জিলে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি করে।
ক্স হজের দ্বিতীয় বৃহত্তর তাৎপর্য হচ্ছেÑ এটি এশক ও মহব্বতের সফর। কাজেই দুুঃখ-কষ্ট, চিন্তা-পেরেশানি, ভয়-ভীতি সব কিছুই হয় এক আনন্দের খোরাক। হজের এহরাম বাঁধা হল প্রকৃত প্রেমিক হওয়ার এক অপূর্ব নিদর্শন। না মাথায় টুপি, না শরীরে জামা, না সুন্দর পোশাক, না সুগন্ধি; বরং ফকীরী বেশে পাগলের সূরতে সদা চঞ্চল ও উদাসীন অন্তরে, সিলাইবিহীন গামছার মত সাদা চাদরে সে কি এক অপরূপ দৃশ্য। তাই ওলামাযে় কেরামের মতে, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ই এহরাম বেঁধে বের হওয়া ভাল। প্রিয় নবীজী স. বলেন ঃ পেরেশান অবস্থা, চুল-দাডি় এবং ময়লাযুক্ত কাপড়ই হল হাজীদের পরিচয়। এই সূরতের ওপরই আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে থাকেন যে, দেখ! আমার বান্দারা ধূলায় ধূসরিত ও এলোমেলো চুল-দাডি় নিযে় আমার দরবারে হাজির হযে়ছে। এইভাবে মাঠঘাট, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, বন-জঙ্গল এবং জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে কান্নাকাটি করতে করতে পাগলের মত লাব্বায়ক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক, লা শরীকা লাকা লাব্বায়ক ‘আমি হাজির আছি, আমি হাজির আছি, ইয়া আল্লাহ! আমি হাজির আছি, তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাজির আছি’ এই আওয়াজে চিৎকার দিতে দিতে, রোনাজারি করতে করতে পৌঁছে। এক হাদীছে আছে, হজের অর্থই হল, খুব চিৎকার দেয়া এবং কোরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। অন্য হাদীসে আছে, হুজুরে আকদাস স. এরশাদ করেন, হযরত জিবরাঈল আ. আমাকে বলেছেন ঃ আপনার সাহাবীদেরকে বলুন, তারা যেন লাব্বায়ক জোর করে বলে। প্রেমিকদের ধর্মই হল জোর করে কান্নাকাটি করা। এভাবে উদাস এবং পেরেশান অন্তরে ক্রন্দনরত অবস্থায় অবশেষে মাহবুবের শহরে পৌঁছে যায় এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে। যেন বহুদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সশরীরে জান্নাতের বাগানে প্রবেশ করল।
হজের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাৎপর্য এবং আন্তর্জাতিক অর্জিতব্য বিষয়
আল্লাহ পাকের যে কোন হুকুমের মধ্যে হাজার হাজার হেকমত বা রহস্য লুকিযে় থাকে, মানুষের জ্ঞান যেখান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ব্যক্তি যতই চিন্তা করবে, ততই রহস্যাবলী উদঘাটিত হতে থাকবে। হজের মধ্যে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন ধরনের হেকমত আবিষ্কার করেছেন। কযে়কটি এরকম
১. যে কোন শাসক নিজের প্রজাদের বিভিন্ন স্তরের লোকদেরকে বছরে কমপক্ষে একবার একই স্থানে সমবেত করার ইচ্ছা পোষণ করেন। হজের মধ্যে সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি বিদ্যমান।
২. মুসলিম জাতির উন্নতির জন্য বিভিন্ন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদগণ যদি সমষ্টিগতভাবে কোন কর্মসূচি গ্রহণ করতে চান, তবে হজের মৌসুমই তার উৎকৃষ্ট সময়।
৩. মুসলিম দেশগুলোর মুসলমানদের মধ্যে আপস, একতা ও সম্পর্ক স্থাপনের জন্য হজের চেযে় উৎকৃষ্ট সময় আর হয় না।
৪. ধনী-গরিব-এর ব্যবধান ঘুচিযে় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পথে ‘ব্যর্থ পুঁজিবাদ’বিরোধী সাম্যবাদীদের যাবতীয় পরিকল্পনা এবং স্কীম সারা বিশ্বের যে কোন অঞ্চলে চরমভাবে ব্যর্থ হযে়ছে। ইসলামের যে কোন বিধান, বিশেষ করে হজ সে সাম্যবাদী উদ্দেশ্যকে পরম সার্থক করে দেখিযে়ছে। এখানে আমীর-ফকীর, উঁচু-নিচু, মালিক-শ্রমিক, হিন্দী-আরবী, তুর্কী-চীনা ভেদাভেদহীনভাবে একই অবস্থায়, একই বেশভূষায়, একই আমলে, বেশ কিছু সমযে়র জন্য একত্রে জীবনযাপন করে এবং এই সাম্যচেতনা নিযে় ঘরে ফেরে।
৫. জাতীয় সপ্তাহ বা পক্ষ পালনের জন্য মানুষ কত ব্যবস্থা, কত শত প্রচার এবং খরচপত্র করে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য ইসলামী উদ্দেশ্যে বিনাপ্রচারে হজের মাস যিলহজ-এর প্রথম পনের দিন পক্ষপালনের একটি অনুপম ও অতুলনীয় সুযোগ।
৬. পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের হেফাজত এবং দর্শন, বিশেষ করে আম্বিয়াযে় কেরামের স্মৃতিসমূহ স্বচক্ষে দেখার জন্য হজের সফরই হল অপূর্ব ব্যবস্থা; বলা যায় এটি ইতিহাসচর্চার এক অনন্য ব্যবস্থা।
৭. সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য হজের চেযে় উপযুক্ত সময় আর হয় না; কারণ, যে কোন দেশের শিল্পপণ্য, আবিষ্কার ও উৎপন্ন দ্রব্যের এক অভাবনীয় সমাবেশ একমাত্র হজের মৌসুমেই হযে় থাকে।
৮. পারস্পরিক সহযোগিতার ধাপ ছাড়াই হজ ধনী-গরিবের সহঅবস্থান ও সহযোগিতার অপূর্ব সুযোগে পরিণত হয়।
৯. হজের সমাবেশ হতে পারে সুশৃঙ্খল পরিকল্পনার মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের এক অভাবনীয় সুযোগ।
১০. হজের মহাসমাবেশ ও আন্তর্জাতিক ঐক্য ইসলামের দুশমনদের অন্তরে কশাঘাতের চাবুক হযে় কাজ করতে পারে।
১১. বিশ্বমুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, ভালবাসা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা কাযে়ম করার জন্য হজই হতে পারে বৃহত্তম উপলক্ষ।
১২. অন্যদের খরচবহুল আপত্তিকর মেলা’র মোকাবেলায় হজ হচ্ছে ইসলামের পবিত্র ও অনন্য মিলনমেলা, যেখানে খেলতামাশার পরিবর্তে তাওহীদী শক্তি ও আল্লাহপ্রেমের সীমাহীন চর্চা হযে় থাকে।
১৩. হজ হচ্ছে স্বধর্মের প্রবর্তকের (নবীজীর স.) রওজা যিয়ারত এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি ও বৃদ্ধির সহজ সুযোগ।
১৪. হজের সমাবেশকে ইসলামের কেন্দ্রভূমি মক্কা-মদীনার শক্তিবৃদ্ধি ও শান-শওকত প্রদর্শনের বেনজীর ব্যবস্থাই বলতে হবে। অন্য কোন ধর্মে বা মতাদর্শে এই ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও এই মাত্রা কিংবা এর কাছাকাছি মাত্রা অর্জন করতে পারেনি।

মূল অবলম্বন : মাওলানা হাফেজ মোহাম্মদ জাকারিয়া ছাহারানপুরী (রহ.)-রচিত ‘ফাজাযে়লে হাজ্জ’ বা হাজ্জের ফযীলত গ্রন্থ;
অনুবাদ: মাওলানা মোহাম্মদ ছাখাওয়াত উল্লাহ (রহ.)।

Comments

comments

About

Check Also

হজ ফরয ইবাদত : বিনোদন নয়

হজ ইসলামের পঞ্চম রুকন বা স্তম্ভ। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান, তাদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *