জ্ঞানের কথা মুমিনের হারানো সম্পদ

হযরত শামসুদ্দীন বিন আহমদ বিন উসমান তুর্কীস্থানী (রহ.) পবিত্র ফযরের নামায থেকে শুরু করে পবিত্র আসরের নামায পর্যন্ত পবিত্র কুরআন শরীফের পাঁচটি খতম পূর্ণ করতেন। (শায্রাতুয্ যাহাব জি: ৬০২:৩০৩)
হযরত মুহীবুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর হিন্দী হানাফী (রহ.) প্রতিদিন একটি উমরা এবং পবিত্র কুরআন শরীফের একটি খতম পূর্ণ করতেন।
(শাযরাতুয্যাহাব জি. ৬০২ : ৩১০) brt হযরত শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ মিছরী আল আবরাক্বী (রহ.) প্রতিদিন চারটি উমরা এবং পবিত্র কুরআন শরীফের একটি খতম পূর্ণ করতেন। (শায্রাতুয্যাহাব জি. ৬০২ : ৩২৩)
শাযে়খ আব্দুল ওহাব শিরনী (রহ.) বলেন, একবার সাযি়্যদ আবুল আব্বাস হারিছী (রহ.) আমার নিকট তাশরীফ আনলেন। পবিত্র মাগরিবের নামাযের পর- পবিত্র কোরআন শরীফ তেলাওয়াত শুরু করলেন এবং পবিত্র এশার নামায পর্যন্ত কুরআন শরীফের পাঁচটি খতম পূর্ণ করলেন। শাযে়খ আব্দুল ওয়াহ্হাব শিরনী (রহ.) বলেন, আমি তাঁর তেলাওয়াত শুনছিলাম। (শায্রাতুয্যাহাব জি. ৬, পৃ. ১৭৫)
হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী আজমিরী (রহ.) রাত্রি বেলায় অল্প ঘুমাতেন। সাধারণত: তিনি পবিত্র এশার নামাযের অযু দ্বারা পবিত্র ফযরের নামায আদায় করতেন। পবিত্র কুরআন শরীফ দিনের বেলায় এক খতম এবং রাত্রি বেলায় এক খতম আদায় করতেন। (বয্মে ছুফীয়া পৃ: ৬৫)
হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.) সম্পর্কে সাযি়্যদ সাহাবুদ্দীন আব্দুর রহমান (রহ.) লিখেন- হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.) শেষ বয়সে পবিত্র কুরআন শরীফ হিফ্জ করেন। প্রতিদিন দু’বার পবিত্র কুরআন শরীফের খতম পূর্ণ করতেন। ‘‘রা-হাতুলকুলুব’’ নামক কিতাবের মধ্যে আছে যে, হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.) একবার হযরত কাদ্বী হামীদুদ্দীন (রহ.) এবং মাওলানা বদরুদ্দীন গজনভী (রহ.) এর সাথে দিল্লীর জামে মসজিদে এতেকাফ পালন করেন। এ সময় দিবারাত্রিতে দু’বার পবিত্র কুরআন শরীফের খতম পূর্ণ করেছেন। এক রাতে তিনি প্রস্তুতি নিলেন যে, দু’রাকাত নামাযের মাধ্যমে সারারাত কাটাবেন। ইরাদা অনুযায়ী পবিত্র এশার নামাযের পর হযরত কাদ্বী হামীদুদ্দীন (রহ.) ইমাম হলেন। খাজা সাহেব নিজে এবং মাওলানা বদরুদ্দীন গজনভী (রহ.) উভযে়ই মুক্তাদী হিসেবে তাঁর পিছনে দণ্ডায়মান হলেন। হযরত খাজা হামীদুদ্দীন (র.) প্রথম রাকাতে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম এবং আরো চার পারা পড়লেন। দ্বিতীয় রাকাতে পবিত্র কুরআন শরীফের দ্বিতীয় একটি খতম পূর্ণ করলেন। নামাযান্তে দোয়া করলেন, ‘‘এলাহী! আমাদের থেকে আপনার এবাদত হয়নি। তবে আপনার রহমতের বিনিমযে় আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।’’ (বয্মে ছুফীয়া, পৃ. ১০১)
পবিত্র কুরআন শরীফের অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যা আমরা শুরুতে উল্লেখ করেছি। আর তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ এতবেশী তেলাওয়াত হয় যা দুনিয়ার অন্য কোন কিতাব বা বই পুস্তক পড়া হয়না। যেমন- ১. দুনিয়ার প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ নামায আদায় করছে। যার মধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফ তেলাওয়াত হচ্ছে। ২. পবিত্র রামাদ্বানুল মুবারকে হাজার হাজার হুফ্ফাযে কেরাম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করছেন, একদল তেলাওয়াত করছেন, অপর একদল তেলাওয়াত শুনছেন। এভাবে অবিরত তেলাওয়াত চলছে। অতঃপর রাত্রি বেলায় হুফ্ফাযে কেরাম পবিত্র তারাবিহের নামাযের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন শরীফ মুসল্লিদেরকে শুনাচ্ছেন। ৩. প্রতিদিন মসজিদ এবং মাদ্রাসা সমূহে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, শিশু-কিশোর-যুবক এবং বৃদ্ধ লোকগণ পবিত্র কুরআন শরীফের শিক্ষাদানে এবং শিক্ষা গ্রহণে লিপ্ত আছেন। তাদের তেলাওয়াতের পরিসীমা পাওয়া খুবই দুষ্কর ব্যাপার। এছাড়াও অনেক লোক দৈনিক রুটিন মুতাবেক তেলাওয়াত করেন।
উপযুক্ত সংক্ষেপ আলোচনার দ্বারা এটাই বলা যায় যে, দুনিয়ার মধ্যে- পবিত্র কুরআন শরীফ ছাড়া আর কোন কিতাব নেই যা এতবেশী তেলাওয়াত হযে়ছে, হচ্ছে এবং হবে।
পবিত্র কুরআন শরীফের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আমরা উল্লেখ করেছি যে, সাযি়্যদুনা হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.) এর শাগরিদে রশীদ হযরত ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানী (র.) মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করে ফেলেছিলেন।
হযরত ইমাম শায়বানী (র.) এর পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করার ঘটনা এই যে, তিনি সাযি়্যদুনা হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.) এর দরসের বৈঠকে প্রবেশ করতে চেযে়ছিলেন। সাযি়্যদুনা হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.), হযরত ইমাম শায়বানী (র.)-কে বললেন, ‘প্রথমে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করে এসো’ সাযি়্যদুনা হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.) এর কথা শুনে ইমাম শায়বানী (র.) চলে গেলেন এবং সাত দিন পর্যন্ত দরসের মজলিসে উপস্থিত না হযে়- ৮ম দিনে উপস্থিত হযে় সাযি়্যদুনা হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.) এর খেদমতে আরয করলেন, ‘‘ আমি পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করে এসেছি।’’ (মানাকিবে ইমাম আবু হানিফা লিল ইমাম ফুরদী পৃ: ৪২৮)
হযরত মাওলানা সাযি়্যদ ফখর উদ্দীন আহমদ (র.) যিনি প্রথমে শাহী মুরাদাবাদ মাদ্রাসা অতঃপর দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মুদাররিস হযে়ছিলেন। তিনি পূর্ণ পবিত্র কুরআন শরীফ পঁিচশ দিনে মুখস্ত করেছিলেন। আর তাঁর এ মুখস্ত সম্পূর্ণ বিশুদ্ধভাবে স্মরণ ছিল।
(মাহ নামাহ নেদাযে় শাহী মুরাদবাদ কা তারীখ শাহী পৃ: ২৩৮)
হযরত ইয়াযুদ্দীন জামাআ আশ্শাফেয়ী (রহ.) এক মাসে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করেছিলেন। (শায্রাতুয্যাহাব জি; পৃ: ১৩৯)
দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতুবী (র.) পবিত্র হজ্জের সফরে শুধু এক মাসে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করে ফেলেছিলেন। ঘটনা এই যে, যখন তিনি পবিত্র হজ্জ পালনার্থে রওয়ানা দেন তখন জাহাজের মধ্যে পবিত্র রামাদ্বানুল মুবারকের চাঁদ দেখা গেল। সফরে সঙ্গীদের ইচ্ছে হল পবিত্র তারাবীহের নামায পড়ার। কিন্তু জাহাজের মধ্যে- পবিত্র কুরআন শরীফের কোন হাফিয ছিলেন না। স্বয়ং হযরত কাসিম নানুতুবী (র.)ও পবিত্র কুরআন শরীফের হাফিয ছিলেন না। সঙ্গীদের পীড়াপীডি়তে তিনি প্রতিদিন পবিত্র কুরআন শরীফের এক পারা মুখস্ত করতেন এবং পবিত্র তারাবীহের নামাযে মুসল্লীদেরকে শুনাতেন। এভাবে ত্রিশ দিন পূর্ণ পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করে পবিত্র তারাবীহের নামাযের মাধ্যমে লোকদেরকে শুনালেন। (সাওয়ানিহে কাসিমী মুরাত্বাবাহ মাও. ইয়াকুব নানুতুবী)
মাওলানা ফদ্বলে হক্ব খযে়রাবাদী (রহ.) শুধুমাত্র চারমাসে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করেছিলেন।
(নেযামে তা’লীম ও তরবিয়ত জি: ২ পৃ: ৪৪)
ক্বারী আমানুল্লাহ ছাহেব যিনি আফগানিস্থানের দুওবা বাগলান’ নামক স্থানে বসবাস করতেন। দারুল উলুম করাচী থেকে তিনি দাওরাযে় হাদীসের সনদ লাভ করেন। তিনিও শুধু মাত্র চারমাসে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করেছিলেন।
উবায়দুল্লাহ ইবনে ইয়াকুব হানাফী (রহ.) ছ’মাসে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করেছিলেন। (শায্রাতুয্যাহাব জি: ৮ পৃ: ২০৯)
মীর মুহিবুল্লাহ বিল গেরামী (র.)ও শুধু ছ’মাসে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করেছিলেন। (নেযামে তা’লীম ও তরবিয়ত জি: ২ পৃ: ৪৩)
‘আম্বিটি’ এর একজন বুযুর্গ শেখ আহমদ ফাইয়াদ্ব (র.) যিনি বৃদ্ধাবস্থায় মরণ শয্যায় শাযি়ত থেকে এক বৎসরে পূর্ণ পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করেছিলেন। (নেযামে তা’লীম ও তরবিয়ত জি: ২ পৃ: ৪৩) (চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

ইবাদতের বসন্তকাল রমজান

ঋতুরাজ বসন্ত যেমন প্রকৃতিতে অপার সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ এনে দেয়। তেমনি রমজান মাস পরওয়ারদেগারের পক্ষ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *